মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে ইতালি। প্রায় ৩৪ হাজার মানুষের মৃত্যুর পর স্বাভাবিক হচ্ছে দেশটির জীবনযাত্রা। এমন সময় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশ ক’জন প্রবাসীর শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়ায় তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে সাময়িকভাবে বিমান চলাচল বন্ধ করেছে দেশটি।
গেল সপ্তাহে ইতালির গণমাধ্যমেও বাংলাদেশিদের নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। দেশটির প্রভাবশালী একাধিক সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করে, মাত্র ৩ হাজার টাকায় বাংলাদেশে করোনার নেগেটিভ সনদ পাওয়া যায়। এসব সনদ দিয়ে বাংলাদেশিরা ইতালি যাচ্ছেন।
করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধসহ সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা এবং রোমের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা। সংবাদমাধ্যমটি বাংলা ভার্সনে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ইতালির ইমিগ্রেশন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশিদের দেশটিতে আজীবন নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে।
অবশ্য করোনায় আক্রান্ত বাংলাদেশিরা দেশটিতে যাওয়ার চেষ্টা করায় ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত চরম ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তারা জানিয়েছেন, ভুয়া করোনা সনদ নিয়ে রোমে আসা সত্যিই দুঃখজনক।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তে বলেছেন, অন্য দেশের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্য জাতি খেসারত দিতে পারে না। আমরা অনেক কষ্ট করে করোনা মোকাবিলা করেছি। গত ৬ জুলাই একটি বিশেষ ফ্লাইটে ২৭৪ জন বাংলাদেশি রোমে যান। তাৎক্ষণিকভাবে এ যাত্রীদের মধ্যে ৩৬ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। তাদের কাছে পাওয়া যায় করোনার জাল সার্টিফিকেট। এখন ৩৬ থেকে বেড়ে এখন ৭৭ জনে পৌঁছেছে।
এর পরপরই ইতালি বাংলাদেশিদের যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি ইতালি যেতে পারবেন না। এই অবস্থায় ইতালির লাজ্জিওতে ৩৫ হাজার বাংলাদেশির করোনা টেস্টের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এরমধ্যে সোমবার (১৩ জুলাই) থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের পাশে একটি অস্থায়ী
ক্যাম্পে এই টেস্ট শুরু হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে
আব্দুল মোমেন বলেন, গুটি কয়েক লোকের জন্য দেশের বদনাম হচ্ছে।
এদিকে, ইতালিতে বিশেষ ফ্লাইটে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ভুয়া
করোনা সার্টিফিকেটের পাশাপাশি এবার ভুয়া রেসিডেন্ট করার অভিযোগ পাওয়া
গেছে। এ অভিযোগে অন্তত ৬শ’ প্রবাসীকে খুঁজছে পুলিশ।
করোনাকালে বাংলাদেশ থেকে ইতালি ফেরত অন্তত কয়েকশ’ প্রবাসীকে খুঁজছে স্থানীয় পুলিশ। এ সব প্রবাসীর প্রতি দুজনের মধ্যে একজনের রেসিডেন্ট ভুয়া পাওয়া যাওয়ায় তাদের খুঁজছে পুলিশ।
এছাড়া বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজার প্রবাসী আটকা পড়ায় ইতালির আনকোনা এবং ভেনিসের জাহাজ শিল্পে কর্মরত বহু শ্রমিক চাকরি হারাচ্ছেন।
এরমধ্যেই আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইতালিতে জরুরি অবস্থার সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে সংসদে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তে। এছাড়া বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের সাথে বিমান যোগাযোগের ব্যাপারে ১৪ জুলাই সিদ্ধান্ত হবে বলেও জানান তিনি।
কন্তে বলেন, আমি বলিনি যে সরকার জরুরি অবস্থা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। সবার সম্মতিক্রমে জরুরি অবস্থা বাড়বে নাকি সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জরুরি অবস্থা থাকলে প্রয়োজন হলে আমরা যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব। তবে আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি।
এদিকে দেশ থেকে ফেরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে রোমে করোনা ভাইরাস ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশি অধ্যুষিত তরপিনাত্তারায় বেশ কয়েকজন প্রবাসী নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। এতে করে আবারও উদ্বেগ বাড়ছে প্রবাসীদের মধ্যে।
অন্যদিকে ইতালিতে আবারও বাড়তে শুরু করেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এজন্য প্রবাসীদের বিশেষ করে বাংলাদেশিদের দায়ী করছে স্থানীয় গণমাধ্যম ও কর্মকর্তারা। নতুন সংক্রমণ রোধে আরও বেশি কড়াকড়ি আরোপের দাবি জানিয়েছেন তারা।
রোববার (১২ জুলাই) ইতালির পত্রিকা ‘ইল মেসেজারো’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইতালির সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত কাজ করছে না। বিদেশ থেকে আগতদের মাধ্যমে সেখানে করোনার বিস্তার ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। দেশটিতে ইতোমধ্যেই নতুন করে সহস্রাধিক অভিবাসী করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন।
পত্রিকাটি জানিয়েছে, গত কয়েকদিনে লাজিও শহরে অন্তত ১২৪ বাংলাদেশি অভিবাসী করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। এছাড়া ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, পেরু, ব্রাজিল, মেক্সিকোর কিছু নাগরিকের শরীরেও পাওয়া গেছে এই ভাইরাস। এমিলিয়া-রোমাগনা অঞ্চলেও দ্রুত ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। একই অবস্থা ভেনেতো, ক্যাম্পানিয়া, ফ্রিউলি, ট্রেনটিনো এলাকাতেও।
নতুন করে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপকে অপর্যাপ্ত উল্লেখ করে তার কড়া সমালোচনা করেছেন দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিরোধ বিভাগের পরিচালক জিয়ানি রেজা।
তিনি বলেন, বহিরাগতদের মাধ্যমে বিস্তারের কারণে বেশ কিছু অঞ্চলে সংক্রমণের সূচক কোটা-১ ছাড়িয়ে গেছে। অঞ্চলগুলো নতুন করে সংক্রমণ দেখছে, কারণ তারা (অভিবাসী) বাইরে থেকে ইতালিতে ঢুকছে। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্পেরাঞ্জা (রবার্তো স্পেরাঞ্জা) কি তাদের আগমন বন্ধ করেছেন, পুরোপুরিভাবে? কিছু নমুনা দেখানোর জন্য তিনি করেছেন ১৩টি দেশের জন্য, বাংলাদেশ থেকে পেরু পর্যন্ত।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা বলেন, এরইমধ্যে শত শত মানুষ ইতালি প্রবেশ করেছেন। ফলে লাজিও শহরে বাংলাদেশি অভিবাসী সম্প্রদায়ের (তিন হাজারের বেশি) মধ্যে ব্যাপক হারে নমুনা পরীক্ষা অভিযান চালাতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয়, ‘নিষিদ্ধ’ দেশের তালিকাও অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ইতালিতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ছে জরুরি অবস্থা
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত দেশটি (ভারত) স্পেরাঞ্জার কারণে (নিষেধাজ্ঞা থেকে) বেঁচে গেছে।
তিনি বলেন, আক্রান্তের সংখ্যা ‘প্রতীকী’ মাত্র। যেমন, গত শনিবার (১১ জুলাই) লাজিও শহরে ১৯ জন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন, এরমধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই বহিরাগত। যাদের মধ্যে আট জন বাংলাদেশি, যারা নিষেধাজ্ঞার আগে ইতালি ঢুকেছেন; দুজন ভারতের, একজন মিসরের ও একজন হাঙ্গেরির নাগরিক।
করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি প্রতিরোধে যাতায়াত নিষিদ্ধ দেশের তালিকা আরও বড় করার দাবি জানিয়েছেন ইতালির বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্যাপক হারে করোনা সংক্রমিত দেশের নাম ওই তালিকায় না থাকা খুবই দৃষ্টিকটু। তারা দ্রুত এ ধরনের দেশগুলোর সঙ্গেও যাতায়াত বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।