গণতন্ত্র, রাজনীতি, জনগণের আস্থা সংকট এবং উত্তরণ — প্রফেসর ডক্টর দিপু সিদ্দিকী

ড. দিপু সিদ্দিকী
লেখক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে; যে সংগ্রাম ছিল গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসেও জাতি আজ এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি—যেখানে রাজনীতি জনগণের আস্থার উৎস না হয়ে পরিণত হয়েছে শঙ্কা, সন্দেহ ও বিতৃষ্ণার প্রতীক হিসেবে।

 

১৯৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের পর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি ও বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই মহান লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের চেয়ে শ্লোগানেই সীমাবদ্ধ থেকেছে বেশি। যাদের হাতে ছিল নেতৃত্বের ভার, তাদের অনেকে দুর্নীতির মাধ্যমে নিজস্ব সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। দরিদ্র ঘরের সন্তানরা রাতারাতি হয়ে উঠেছেন কোটিপতি, আর সেই সম্পদের উৎস যে নৈতিক নয়, তা আজ আর গোপন নয় কারো কাছে।

 

রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের করাল ছায়া কেবল গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করেনি, ভেঙে দিয়েছে জনগণের আস্থার স্তম্ভও। প্রতিবার নির্বাচনের আগে সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখে—বৈষম্যহীন সমাজ, কর্মসংস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের নিশ্চয়তা। কিন্তু ফলাফল কী? কিছু দিনের মধ্যেই সেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় গেয়ে ওঠে হায়দার আলীর কালজয়ী গান: “কি দেখার কথা ছিল, কি দেখছি!”

 

রাজনীতির এই অবক্ষয়ের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, শুরুটা এতটা কালো ছিল না। ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন সৎ, ত্যাগী এবং জনগণের দুঃখ-কষ্টে একাত্ম। রাজনীতি তখন ছিল ব্রতের মতো এক পথ—যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, জাতির কল্যাণই ছিল মুখ্য। আইনজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদরা রাজনীতিকে একটি সেবামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতেন। ধনী পরিবারের অনেক সদস্যও বিলাসিতা ছেড়ে যুক্ত হয়েছেন রাজনীতির মহৎ সংগ্রামে।

কিন্তু আজকের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। রাজনৈতিক দলগুলো এখন ক্ষমতা রক্ষার জন্য পেটোয়া বাহিনী গড়ে তোলে, জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে এবং দুর্নীতিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। ফলে সাধারণ মানুষ রাজনীতিকে এখন আর সম্মানের চোখে দেখে না।

একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আলোচনায় সাংবাদিক মোঃ আলম অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে বলেছেন:

জনগণের আস্থা এখন আর মুখের বুলি বা প্রতিশ্রুতিতে নেই। মানুষ চায় বাস্তব কাজ, চায় জবাবদিহিতা। দুর্নীতির দায় এড়াতে চাইলে দলগুলোকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

এই সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি একটি সমাজগত সমস্যা। যখন আমরা দেখতে পাই, সাংবাদিক, শিক্ষক, সমাজকর্মী—সবার মুখে হতাশার প্রতিধ্বনি, তখন বোঝা যায় আস্থার এই সংকট কতটা গভীর। জনগণের বিচ্ছিন্নতা এতটাই প্রকট যে, এখন আর কোনো রাজনৈতিক বক্তৃতা তাদের উদ্দীপ্ত করে না; বরং তারা বাস্তব কর্মফলের অপেক্ষায় থাকে।

তবে এই হতাশার মধ্যেও উত্তরণের পথ খোলা আছে।

প্রথমত, রাজনীতিকে একটি পেশা নয়, একটি সেবা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

তৃতীয়ত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলীয় অবস্থান স্পষ্ট ও কার্যকর হতে হবে—কোনো আপস নয়।

চতুর্থত, তরুণ সমাজকে রাজনীতির ইতিবাচক চর্চায় যুক্ত করতে হবে—মূর্খ, অসৎ, অপরাধপ্রবণ লোকেরা রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করলে আস্থার সংকট কেবল ঘনীভূত হবে।

পঞ্চমত, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে আরও সক্রিয় হতে হবে, তবে সেটি হতে হবে নিরপেক্ষ, দেশ ও মানুষের পক্ষে।

একটি জাতির রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি দুর্বল হয়, তবে উন্নয়ন কখনোই টেকসই হবে না। বাংলাদেশ উন্নয়নের নানা সূচকে এগোলেও গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক আস্থার প্রশ্নে পিছিয়ে আছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে না পারলে উন্নয়নের ফলস্বরূপ বৈষম্য আরও বাড়বে এবং সমাজে সৃষ্টি হবে অনাস্থা ও বিদ্বেষের ভয়াবহ চক্র।

 

শেষ কথায় বলা যায়, রাজনীতি হলো জাতির চালকচক্র। সেখানে যদি দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও মিথ্যাচার আধিপত্য করে, তবে জনতার আস্হা ভেঙে পড়বে, যেমনটি আজ হয়েছে। কিন্তু যদি সত্যিকারের নেতৃত্ব, জবাবদিহি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে রাজনীতি চর্চা হয়—তবে নিশ্চয়ই একদিন এই হতাশার গান থেমে যাবে, এবং নতুন করে শুরু হবে গণমানুষের মুক্তির সুর।

 

— লেখক: প্রফেসর ড. দিপু সিদ্দিকী

ডিন, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ,রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা

 

Share: