
বাংলাদেশের বিজয়ের ৫৪ বছর পূর্ণ হলো। একটি জাতি যখন এতদূর পথ পাড়ি দেয়, তখন পেছন ফিরে তাকানো যেমন জরুরি, তেমনি ভবিষ্যতের পথচলাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত এই স্বাধীনতা শুধু একটি ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়; এটি ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করার স্বপ্নে লালিত জাতি গঠনের একটি দিকনির্দেশনা।
অগণিত প্রাণের আত্মত্যাগ এবং মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয় শুধু একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়, বরং একটি বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের শপথ। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক ও তার মতো অনেক আদর্শবাদী ব্যক্তিত্ব এই স্বপ্নই দেখেছিলেন। তাদের স্বপ্ন ছিল একটি মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, এবং নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত জাতি রাষ্ট্র গঠনের।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হকের স্বপ্ন: জাতি রাষ্ট্র গঠনের দিকনির্দেশনা
আব্দুল হক, একজন স্বশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা এবং সমাজ চিন্তক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন সম্ভব ছিল, যদি স্বাধীনতার শুরুতেই জাতি রাষ্ট্র গঠনের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হতো। তার মতে, প্রাথমিক শিক্ষায় দেশপ্রেম, নৈতিকতা, এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টির মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল সমাজ তৈরি করা সম্ভব। শিশুদের মধ্যে পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের বীজ বপন করাই একটি জাতির মূল ভিত্তি তৈরি করে।
তার মতানুসারে, শিক্ষা ব্যবস্থার সাম্যতা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। বৈষম্যের সূত্রপাত এখান থেকেই হয়েছে। ধনী ও গরিবের জন্য ভিন্নধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে একটি দ্বৈত সমাজ। সমান সুযোগ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষার অভাবে আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে।
৫৪ বছরের বাস্তবতা: বৈষম্যের প্রাচীর ভাঙতে হবে
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বাংলাদেশ বৈষম্য মুক্ত হতে পারেনি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকড় এতটাই গভীর যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আজও পূর্ণতা পায়নি। দুর্নীতি, শ্রেণী বৈষম্য, এবং নৈতিকতার অভাব একটি উদার ও মানবিক সমাজ গঠনের পথে প্রধান অন্তরায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ তখনই স্বার্থক হবে, যখন জাতি বৈষম্যের শিকড় উপড়ে ফেলে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন করবে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং দেশপ্রেম ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা শুরু করতে হবে পরিবার থেকে।
অঙ্গীকার: বৈষম্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার
বিজয়ের ৫৪ বছরে দাঁড়িয়ে জাতির জন্য একটিই অঙ্গীকার থাকা উচিত—একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার। এটি শুধু একটি স্বপ্ন নয়, বরং স্বাধীনতার মূল চেতনা। একটি আদর্শ জাতি রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াসেই বেঁচে থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ।
আজকের বিজয় দিবসে আমাদের শপথ হোক, জাতিরাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে ন্যায়, সাম্য এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করার।
লেখক পরিচিতি:
অধ্যাপক ড. দিপু সিদ্দিকী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।