বাংলাদেশে শিক্ষা সংস্কার: গণতন্ত্র, সংস্কৃতি এবং মানবিক সমাজ গঠনে শিক্ষা ও ধর্ম দর্শন – ড. দিপু সিদ্দিকী

ডক্টর দিপু সিদ্দিকী, ডিন, ফ্যাকাল্টি অব আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সাইন্সেস অ্যন্ড  চেয়ারপার্সন ডিপার্টমেন্ট   অব এডুকেশন,আরইউডি
ড. দিপু সিদ্দিকী, ডিন, ফ্যাকাল্টি অব আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সাইন্সেস অ্যন্ড চেয়ারপার্সন ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন,আরইউডি

গণতন্ত্র তখনই পূর্ণতা পায়, যখন নাগরিকরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতই নয়, বরং মানবিক গুণাবলির অধিকারী হয়। সাধারণভাবে উচ্চশিক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জীবন উপভোগ করার শিক্ষা, যা কেবল পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জীবন ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, “শিক্ষা শুধু জীবনের উপকরণ নয়, জীবন উপভোগ করার শিক্ষাও বটে।” বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় কেবল মুখস্তনির্ভর শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করছে।

 

শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে বাছাইকৃত প্রশ্ন মুখস্ত করে এবং নির্দিষ্ট সূত্র বা প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষকদের সহায়তায় পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। এই প্রতিযোগিতা তাদের জ্ঞানের লাভের বিস্তৃত সুযোগ ও পরিসরকে সীমাবদ্ধ পরিধিতে আবদ্ধ করে ফেলে। শুধু তাই নয় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষার্থীতে নিজ জীবনকে ক্ষুদ্র পরিসরে শৃঙ্খলিত করে তুলে।ফলে বোধিজ্ঞান প্রাপ্তি থেকে মনের অজান্তে অনেক দূরে সরে যায়। শিক্ষার্থীরা জীবনমুখী সুস্থ ধারার জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আনন্দমুখী শিক্ষা লাভের সুযোগ হারিয়ে জ্ঞ্যানার্জন বৃদ্ধির পরিবর্তে শিক্ষাবিমুখ হয়ে পড়ে। শিক্ষা দর্শনের সারমর্ম বা তাৎপর্য বোধগম্য না হওয়ায় শিক্ষার্থীরদের মনে শিক্ষাগ্রহণ কার্যক্রম নিরানন্দময় হয়ে ওঠেছে। অভিভাবকের চাপ এবং ভবিষ্যতের রুটি-রুজির চিন্তায় তারা এই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এর বক্তব্য প্রণিদানযোগ্য। তাঁর মতে, “বাংলাদেশে যে উপায়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাতে আদর্শিক শিক্ষার ছায়াপাত সামান্যই” (সূত্র: প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের এই প্রবণতা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ব্যাহতই করছে না বরং উদ্বেগজনকভাবে ক্ষুন্ন করছে। জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, “মানুষের কর্ম ও জীবনধারার ওপর সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে।” শিক্ষাব্যবস্থা যখন সৃজনশীলতা ও মানবিকতার চর্চা থেকে দূরে সরে যায়, তখন সমাজে অমানবিকতা ও অসততা বিস্তৃত হয়।

 

শিল্প, সংস্কৃতি ও মানবিক শিক্ষা:

শিল্প মানুষের আত্মাকে সমৃদ্ধ করে এবং তাকে নতুন চিন্তা ও অনুভূতির জগতে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, “শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মনের সুষ্ঠু বিকাশ।” শিল্প, সংগীত, নাটক, চিত্রকলা, এবং সাহিত্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিকতার বীজ বপন করে।

 

শিক্ষার বাস্তবিক প্রয়োগ ও মনুষ্যত্বের বিকাশ:

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের পরিবর্তে শুধুমাত্র পাস করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করে, তা তাদের সৃজনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধকে কমিয়ে দেয়। ফরাসি দার্শনিক জঁ-জ্যাক রুশো বলেছেন, “মানুষ স্বাধীন জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্র শৃঙ্খলিত।” শিক্ষাব্যবস্থায়ও এই শৃঙ্খলা লক্ষ্য করা যায়, যেখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে শুধু সনদ অর্জনেই সীমাবদ্ধ থাকে।

 

মানবিক সমাজ গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:

মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি, এবং পরমত সহিষ্ণুতা শেখানো ও চর্চা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা যদি জীবনকে উপভোগ করার পাশাপাশি মানবিকতা ও নৈতিকতার চর্চায় সাহায্য করে, তবে শিক্ষাব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে সফল হবে।

 

কোরআনে বলা হয়েছে:

“তোমরা কি তাদের মতো হতে চাও, যারা কিতাব বহন করে কিন্তু বোঝে না? (আল-জুমুআ: ৫)”

এখানে আল্লাহ তা’আলা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে শিক্ষা শুধু বাহ্যিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বুঝতে এবং জীবনের সঠিক পথে পরিচালিত হতে হবে। হাদিসেও উল্লেখ আছে:

“জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ।” (ইবনে মাজাহ ২২৪)

এই শিক্ষার মধ্যে কেবলমাত্র বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নয়, বরং নৈতিকতা, মানবিক গুণাবলি এবং আধ্যাত্মিকতাও অন্তর্ভুক্ত।

 

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যেখানে শুধুমাত্র মুখস্থনির্ভর শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রকৃত মর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

 

ইসলামী চিন্তাবিদ ইবনে খালদুন তার “মুকাদ্দিমা” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানী করে তুললেও, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির গুরুত্ব অপরিসীম।

 

শিক্ষাব্যবস্থা ও মানবিকতার বিচ্যুতি

 

ইসলামে শিক্ষার ব্যাপারে বলা হয়েছে, শিক্ষার মূলে আছে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:

“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা জ্ঞান দান করেন, আর যাকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাকে অনেক কল্যাণ দান করা হয়েছে।” (সূরা বাকারা, আয়াত ২৬৯)

তাই শিক্ষার প্রকৃত অর্থ হলো নৈতিক শিক্ষা ও জ্ঞানের সমন্বয়। যখন শিক্ষাব্যবস্থা মানবিকতা ও সৃজনশীলতা চর্চা থেকে দূরে সরে যায়, তখন সমাজের মূল মূল্যবোধ দুর্বল হয়ে পড়ে।

 

মানবিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

 

ফরাসি দার্শনিক জঁ-জ্যাক রুশো বলেছেন, “মানুষ স্বাধীন জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্র শৃঙ্খলিত।” ইসলামের দৃষ্টিতেও সৃজনশীলতা ও স্বাধীন চিন্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী পণ্ডিত ইমাম গাজ্জালি বলেছেন:

“শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, নৈতিকতা বিকাশ এবং মানবতার কল্যাণে কাজ করা।”

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের পরিবর্তে তাদের শৃঙ্খলিত করে ফেলছে। এটি শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, যা মানবিক সমাজ গঠনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করছে।

 

মানবিক সমাজ গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

 

একটি সুশীল সমাজ গঠনে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং পরমত সহিষ্ণুতা শেখানো অত্যন্ত জরুরি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:

“তোমরা ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা কর এবং মিথ্যা এড়িয়ে চল।” (সূরা নিসা, আয়াত ৫৮)

এছাড়াও, হাদিসে বলা হয়েছে:

“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ, যার আচার-ব্যবহার উত্তম।” (বুখারি ও মুসলিম)

শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শুধুমাত্র পেশাগত দক্ষতা অর্জন নয়, বরং একজন শিক্ষার্থীকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

 

 

গণতন্ত্র ও মানবিক শিক্ষা

 

ইসলামের শিক্ষা অনুসারে, মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ লাভ করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন:

“আর তিনি কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন এবং যা কিছু তোমরা জানতে না, তা শিক্ষা দেন।” (সুরা বাকারা, ২: ১৫১)

এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক গুণাবলিতে পরিপূর্ণ করা। শিক্ষাকে শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে, মানবিক ও নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে।

শিক্ষা মানে শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং জীবনকে উপলব্ধি করার এবং জীবন উপভোগ করার ক্ষমতা। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রকৃত মর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার গুরুত্ব

ইসলামিক স্কলার ইবনে কায়্যিম (রহ.) বলেছেন:

“শিক্ষা হলো আত্মার খাদ্য এবং অন্তরের প্রশান্তির মাধ্যম, যার মাধ্যমে মানুষ সঠিক পথ চিনতে পারে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।”

এই শিক্ষার গুরুত্ব আমাদের বর্তমান সমাজে অনেকাংশে উপেক্ষিত হচ্ছে। পবিত্র কোরআনে শিক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলা হয়েছে:

“তুমি পড়, তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আলাক, ৯৬: ১)

এখানে আল্লাহ শিক্ষা অর্জন করার এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে সংযোগ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন।

অথচ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষার এই সঙ্কট শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক অপ্রতিরোধ্য মনোবৃত্তির জন্ম দিচ্ছে, যেখানে পরীক্ষার ফলাফলই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীর প্রকৃত জ্ঞানতৃষ্ণা নিম্নমুখী হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে পর্যায়ক্রমে একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক এবং মানবিক হিতাহিত জ্ঞান এক পর্যায়ে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। নৈতিক শিক্ষাহীন শিক্ষার্থীর মন অর্জিত শিক্ষাসনদ বিত্তবৈভব অর্জন এবং ক্ষমতার মসনদ পাবার উন্মত্ততায় মেতে ওঠে। সমাজ,সংস্কৃতি, ধর্ম সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেকে ভাবতে থাকে। লাজ লজ্জার তোয়াক্কা না করে অপপ্রতিরোধ্য গতিতে সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য গড়ার বাসনায় মানুষরূপী মন সারাক্ষণ উদগ্রীব হয়ে উঠে। মানবীয় মস্তিষ্কে ভয়ঙ্কর রূপে প্রভাবক হয়ে ওঠে করে দানবীয় নিউরন। দানবীয় মেধার বিচ্ছুরণে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় রাষ্ট্রের সর্বত্র। মিথ্যা অহংকার আর বিকৃত এই মানব দেশের বাইরে নিজ দেশের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ-সম্পদ পাচার করে নির্দ্বিধায়। পাচারে দ্বিধাহীন এই সকল দুর্বৃত্তরা দিনাতিপাত করলেও পত্নী, উপপত্নী ও সন্তানরা বিলাসিতায় জীবন কাটায়। অবৈধভাবে কানাডার বেগমপাড়া কিংবা সুইস ব্যাংকে সীমাহীন ব্যাংক ব্যালেন্স এদের মানসিক বিকারগ্রস্তদের লক্ষণ প্রকাশ মাত্র। এরা অর্থ পাচারকারী কিংবা নিছক দুর্নীতিবাজ নয়। এদের সিংহভাগ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত সনদধারী। এরা মূলত চিন্তা এবং চেতনায়ও দুর্বৃত্তপরায়ণ। অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল বিত্ত-বৈভব এদের ভাগ্যে শান্তি কিংবা স্বস্তি এনে দিতে পারেনি। জীবনকে উপভোগ করার শিক্ষা লাভে ব্যর্থ হওয়ায় দিনশেষে তারা আজ কালাতিপাত করছে। প্ররকৃত অর্থে এরা খুবই অসহায় বটে।দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় ডিগ্রি, সমাজে খ্যাতি ও ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত স্বীয়দেহে সন্তপর্ণে থাকা সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মীয় লেবাসে মোড়া সৌন্দর্যের শ্মশ্রুও ছেঁটে ফেলতে হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে যদি শিক্ষা না নিতে পারি তাহলে আজকে ব্যক্তির কদর্যতা যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে পুরা রাষ্ট্রের কদর্যতা এরূপেও বিশ্বে উন্মোচিত হবে এই ভাবনা কিন্তু অমূলক হবে না। তাই জনগণকে প্রকৃত স্বাধীনতা উপভোগ করতে হলে তার চিন্তার স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। পথে পথে নিরাপত্তা বেষ্টনীবুহ্যর বদলে জীবনকে উপভোগ করার পথ তৈরি করে দিতে হবে। মানুষ মানুষের নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে পারে। কোন পোশাকী শক্তি দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিদ্র করা যায় না। নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় জীবন উপভোগ করার একমাত্র পথ সভ্য মার্জিত জীবন চর্চাকারি সংস্কৃতিবান নাগরিক তৈরির জীবনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা।

আলোচ্য বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার সুবিধার্থে নিম্নে উল্লেখিত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

শিক্ষাব্যবস্থা ও মানবিকতার বিচ্যুতি

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার উল্লেখ করেছেন, “সংস্কৃতির প্রভাব মানুষের কর্ম ও জীবনধারার ওপর অত্যন্ত গভীর।” শিক্ষাব্যবস্থা যখন মানবিকতা ও সৃজনশীলতা চর্চা থেকে দূরে সরে যায়, তখন সমাজের মূল মূল্যবোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা শুধু মুখস্ত বিদ্যার জগতে আটকে যায় এবং সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে মানুষকে উপকার করে এবং অন্যের কল্যাণে কাজ করে।”

কল্যাণময় শিক্ষার কথা কিন্তু সর্ব ধর্মে বলা আছে যে শিক্ষা মানুষের কল্যাণ করে না সে শিক্ষা মূল্যহীন।

উপসংহার

শিক্ষা শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের উপায় নয়, এটি জীবনের গভীর সৌন্দর্য ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানবিকতা, নৈতিকতা, ও শিল্পের সৌন্দর্য চর্চা করাই একটি সুশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। ইসলামী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানবতার উন্নতি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানবিকতা, নৈতিকতা এবং শিল্পের চর্চা করা একটি সুশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। তাই, বাংলাদেশে শিক্ষা সংস্কার অত্যন্ত জরুরি, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম শুধু কর্মমুখী ও প্রার্থিবজ্ঞান অর্জন করেই সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং আধ্যাত্মিকজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে।

লেখক পরিচিতি: ডক্টর মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক, ড. দিপু সিদ্দিকী নামে পরিচিত। অধ্যাপক এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। email: dipu.siddiqui@gmail.com

 

 

Share: