
গণতন্ত্র তখনই পূর্ণতা পায় যখন নাগরিকরা শুধু শিক্ষিতই নয়, বরং মানবিক গুণাবলির অধিকারী হয়। সাধারণভাবে উচ্চশিক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জীবন উপভোগ করার শিক্ষা, যা কেবল পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জীবন ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, “শিক্ষা শুধু জীবনের উপকরণ নয়, জীবন উপভোগ করার শিক্ষাও বটে।” বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় কেবল মুখস্তনির্ভর শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করছে।
শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য কিছু প্রশ্ন মুখস্ত করে এবং নির্দিষ্ট সূত্র অনুসরণ করে শিক্ষকদের সহায়তায় পরীক্ষায় ভালো ফল করে আসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। এই প্রতিযোগিতা তাদের জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর পরিবর্তে শিক্ষা থেকে বিমুখ করে তুলছে। অভিভাবকের চাপ এবং ভবিষ্যতের রুটি-রুজির চিন্তায় তারা এই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এর মতে, “বাংলাদেশে যে উপায়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাতে আদর্শিক শিক্ষার ছায়াপাত সামান্যই” (সূত্র: প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের এই প্রবণতা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ক্ষুন্ন করছে। জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, “মানুষের কর্ম ও জীবনধারার ওপর সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে।” শিক্ষাব্যবস্থা যখন সৃজনশীলতা ও মানবিকতার চর্চা থেকে দূরে সরে যায়, তখন সমাজে অমানবিকতা ও অসততা বিস্তৃত হয়।
শিল্প, সংস্কৃতি ও মানবিক শিক্ষা:
শিল্প মানুষের আত্মাকে সমৃদ্ধ করে এবং তাকে নতুন চিন্তা ও অনুভূতির জগতে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, “শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মনের সুষ্ঠু বিকাশ।” শিল্প, সংগীত, নাটক, চিত্রকলা, এবং সাহিত্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিকতার বীজ বপন করে।
শিক্ষার বাস্তবিক প্রয়োগ ও মনুষ্যত্বের বিকাশ:
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের পরিবর্তে শুধুমাত্র পাস করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করে, তা তাদের সৃজনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধকে কমিয়ে দেয়। ফরাসি দার্শনিক জঁ-জ্যাক রুশো বলেছেন, “মানুষ স্বাধীন জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্র শৃঙ্খলিত।” শিক্ষাব্যবস্থায়ও এই শৃঙ্খলা লক্ষ্য করা যায়, যেখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে শুধুমাত্র সনদ অর্জনেই সীমাবদ্ধ থাকে।
মানবিক সমাজ গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি, এবং পরমত সহিষ্ণুতা শেখানো অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষা যদি জীবনকে উপভোগ করার পাশাপাশি মানবিকতা ও নৈতিকতার চর্চায় সাহায্য করে, তবে শিক্ষাব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে সফল হবে।
উপসংহার:
শিক্ষা শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের উপায় নয়, এটি জীবনের গভীর সৌন্দর্য ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানবিকতা, নৈতিকতা, ও শিল্পের সৌন্দর্য চর্চা করাই একটি সুশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি।
লেখক পরিচিতি: ডক্টর মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক, ড. দিপু সিদ্দিকী নামে পরিচিত। অধ্যাপক এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। ইমেইল: dipu.siddiqui@gmail.com