ঈদের উৎসব ও অনুভূতি -কামরুল ইসলাম

কামরুল ইসলাম

র্মের কঠিন কঠোর আচারপ্রথার পর সকলের মিলনে, উৎসবমুখর হয়ে ওঠে গৃহ, উপাসনালয়, সামাজিক প্রাঙ্গণ। জগতসংসারে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বহু ধর্মের আর্বিভাব ঘটেছে। বিশেষ জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মের আচার প্রথায় মিলিত হয়ে জনজীবনে ঐক্য সৃষ্টি করে। যার প্রেরণা ও উৎস অনুভবের পরম দ্রষ্টা / স্রষ্টা কতৃর্ক নির্ধারিত বলে মনে করেন।

পরম কৃপায় কালে কালে ধর্মপুরুষের আর্বিভাব ঘটেছে। মানবের কল্যাণকর জনক হিসেবে তাঁকে মনে করা হয়। মঙ্গলশক্তির বাণীময় প্রচেষ্টায় মানবসমাজ পরস্পরের সাথে সামাজিক আচার প্রথায় শান্তির অন্বেষণ করে। কতক বিধিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন। এই প্রথা পদ্ধতির সাথে সকল ধর্মের যেমন কিছু ঐক্য আছে, বৈপরীত্যও ঠিক তেমনি আছে। তথাপি কঠিন প্রথার পর যখন উৎসবে মিলিত হয়, তখন স্বধর্মের অধিবাসীর সাথে অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যে শান্তি আনন্দ প্রবাহিত হয়। মনের ভেতর অচেনা পারলৌকিক জীবনের শান্তি অন্বেষণ করে। ফলে যেকোন ধর্ম উৎসব শান্তি আনন্দে মিলিত হয়।

ঈদের উৎসব শান্তি ও আনন্দের। এই সত্য অনুধাবন করে মিলন উৎসব হোক সকল ধর্ম বর্ণ জাতির। ধর্ম জন্মগতভাবে নির্ধারিত উত্তরাধিকারের প্রথা বহন করে। পারিবারিক এই সত্যকে কেহ অস্বীকার করতে পারেনা । কিন্তু আমরা ‘মানুষ’ বলেই সকল মানবের সাথে যদি মিলিত হতে পারি, ধর্ম উৎসব তখন সার্থক হয়ে ওঠে।

 

ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের প্রধান উৎসব ঈদ, যার একটি ঈদউল ফিতর, অন্যটা ঈদ উল আযহা। মাসখানেক কঠোর অনুশাসনের পর ঈদউলফিতর পালিত হয়। এই ঈদ নিয়ে নতুন কাপড় পরিধান,মাঠে, মসজিদে একত্রিত হয়ে নামাজ ও প্রাথর্না সভায় মিলিত হয়ে ইহকাল ও পরকালের শান্তি কামনা করা হয়। ঈদ উল আজহা’র মধ্যদিয়ে ত্যাগের মহিমা উদ্ভাসিত হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, কতক যুগ ধরে কুরবানী নিয়ে যে উন্মাদনা, প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করছি, তা আনন্দের নয়। বৈষম্যের সংকটকে তুলে ধরছে। তথাপি ঈদ উল আযহা’র মূল উদ্দেশ্য যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্য সকলে সচেষ্ট থাকবেন।

 

ঈদের সত্য উপলব্ধির ব্যাখ্যা দিয়েছেন, খানবাহাদুর আহছানউল্লাহ তাঁর গ্রন্থে, ‘ প্রকৃত প্রজাতন্ত্র সর্ব্বপ্রথমে মদিনায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরুষ ও স্ত্রী, যুবক ও বৃদ্ধ, মুক্ত ব্যক্তি ও দাস সকলই সমান অধিকার ভোগ করিত; ‘.. মোছলমানগণ খৃস্টান ও ইহুদী জাতির প্রতি যেরূপ উদারতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন, কোন ধর্ম্ম, এমনকি বত্তর্মান শাসন- প্রথাও তাহার অনুকরণ করিতে সমর্থ হয় নাই।’… ‘ স্পেনের খৃস্টানগণ এবং ইহুদীগণ দলে দলে উত্তর আফ্রিকায় গিয়া মোছলেমদিগের আশ্রয় প্রার্থনা করিত।’ অর্থাৎ ধর্ম বিধিমালার ভেতর সকল ধর্মের অধিকার সমানভাবে সুরক্ষিত ছিল । ঈদ মুসলিম সম্প্রদায়ের হয়েও অন্যের সাথে শান্তি সৌহার্দ্য সম্পর্ক স্থাপনে কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি ।

 

বাংলাদেশ, ভারত সহ যেসব দেশে মুসলিম সম্প্রদায় আছে, মানবের সাথে মানবের এমন হৃদ্যতা উৎসবের মাধ্যমে গড়ে উঠুক। পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত আছে, ‘ ‘খোদা হইতে প্রত্যেক বস্তুর উৎপত্তি এবং তাহাতেই প্রত্যেক বস্তুর প্রত্যাবৃত্তি।’ এই অমোঘ নিয়ম সকল ধর্মেই লক্ষ্য করা যায়। আর ধর্মের নিয়ম আচারে যোগসূত্র স্থাপন করেছে পরমাত্মার অনুভূতি। এই অনুভূতির উচ্চকিত অন্তরতম প্রকাশ প্রেমে। স্রষ্টার প্রতি প্রেম। মানবের প্রতি প্রেম। জীবের প্রতি প্রেম। ধর্মযাজকের প্রতি প্রেম। প্রকৃতির প্রতি প্রেম। বিশ্বজগতের প্রতি প্রেম। এই প্রেমই পবিত্র ও স্বার্থপরহীন। প্রেমেই স্রষ্টা ও সৃষ্টির পরমাত্মার মিলন ঘটে। ‘ কোরআনে বর্ণিত আছে, তাহাদিগকে বল, যদি তোমরা খোদাতায়ালাকে ভালোবাস, খোদাতায়ালা তোমাদিগকে ভালোবাসিবেন।’ ‘ হাদিছে বর্ণিত আছে, কেহ মোমেন বা বিশ্বাসী নহেন, যাহারা প্রেম না করেন।’ ( খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ রহ:)

এসবের সাথে মক্কায় অবতীর্ণ পবিত্র কোরআনের ‘ সুরা আল-বালাদ’ উল্লেখ করতে পারি,

‘ পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু,

১. আমি এই নগরীর শপথ করি,

২. এবং এই নগরীতে আপনার কোন প্রতিবন্ধকতা নেই,

৩. শপথ জনকের ও যা জন্ম দেয়,

৪. নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি, ৫. সে কি মনে করে যে, তার উপর কেউ ক্ষমতাবান হবে না,

৬. সে বলে, আমি প্রচুর ধন-সম্পদ ব্যয় করেছি,

৭. সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখে নি,

৮. আমি কি তাকে দেইনি চক্ষুদ্বয়,

৯. জিহবা ও ওষ্ঠদ্বয়,

১০. বস্তুত: আমি তাকে দু’টি পথ প্রদর্শন করেছি,

১১. আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কি?

১৩. তা হচ্ছে দাসমুক্তি,

১৪. অথবা দুর্ভিক্ষ দিনে অন্নদান,

১৫. এতিম আত্মীয়কে,

১৬. অথবা ধূলি-ধূসরিত মিসকীনকে,

১৭.অত:পর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দয়ার,

১৮. তারাই সৌভাগ্যশালী,

১৯. আর যারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে তারাই হতভাগা,

২০. তারা অগ্নিবেষ্টিত অবস্থায় বন্দী থাকবে’ ( পৃ ১৪৫৭, পবিত্র কোরআনুল করীম, মদীনা মোনাওয়ারা, ১৪১৩ হি: তে প্রকাশিত)

 

এতো দয়া ও প্রেমের প্রকাশ, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। যা সত্য, তারই প্রকাশ প্রেমে, অভিব্যক্তি দয়ায়। সকল ধর্মের ভেতর এমন উপলব্ধি অনুভব করি।

 

উপনিষদের সাংখ্যে নিরীশ্বর শাস্ত্র, বেদান্তে ব্রহ্ম ‘ একমেবাদ্বিতীয়ম্’; যা গীতার মতে ‘ প্রকৃতি ও পুরুষ, জড় ও চিৎ উভয়ই ব্রহ্ম বা পররমাত্মার প্রকার।’ ‘ জগতে যাহা কিছু আছে, তাহা হয় প্রকৃতি, না হয় পুরুষ। প্রকৃতি ও পুরুষ যখন ব্রহ্মেরই বিধা বা প্রকার, তখন এক ব্রহ্ম ভিন্ন আর কিছুই নাই। তিনিই একমেবাদ্বিতীয়াম। তিনি ব্যতীত ‘ বহু ‘ নাই।’ (খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ রহ:)

এই ভাবনার ইসলামের সুফীবাদের অপূর্ব মিল, ‘ ‘ ‘সকলের মধ্যে তিনি এবং তিনি ব্যতীত অন্য সত্তা নাই।’

আজ ঈদ উৎসবের দিনে ভাবতে ইচ্ছে করে, আমাদের অন্তর সত্তার ভেতর প্রেমের মঙ্গল শক্তি শোভা বর্ধন করুক, যে আলো পরিপূরকরূপে সকল ধর্মের সাথে ঐক্যসুরে এগিয়ে যেতে পারে। ভারতবর্ষে ‘ একদা কত সহস্র-বৎসর পূর্বে মানুষ এই কথা বলিয়াছে–

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম আদিত্যবর্ণং তমস: পরস্তাত।

আমি সেই মহান পুরুষকে জানিয়াছি, যিনি জ্যোর্তিময়, যিনি অন্ধকারের পরপারবর্তী।’ ( ধর্ম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

আমরা উৎসবের সময় মানবিক বিষয়াদি তুলে আনতে চাই।

যীশু যখন বলেন, ঈশ্বর সকলের পিতা। তখন তাঁর উপর সীমাহীন অত্যাচার ও ক্রশেবিদ্ধ হরার ঘটনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে । কালে কালে যীশুর বাণীই সত্যরূপে প্রতিভাত হয়েছে।

 

হযরত মুহম্মদ স: ইসলামের বাণী সাম্য প্রচার করতে গিয়ে প্রতিকূলতায় পড়েন। তথাপিও তাঁর অমিয় বাণী শান্তির পথে নিবেদিত হয়েছে ।

মুসলিমরা যখন উদার হয়ে জ্ঞানের পথে অগ্রসর হলেন, তখন বিশ্বে নানা আবিষ্কারের পথিকৃত হয়ে উঠলেন । ৯০০-১১০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলিমরা শ্রেষ্ঠ ছিল । চিকিৎসায় আলরাজি (৮৬৫-৯২৫) ১১৩ টি বড় ও ২৮টি ক্ষুদ্র গ্রন্থ লেখেন, ইবনে বতুতা( ৯৮০-১০৩৭) ৯৯টি গ্রন্থ লেখেন। এঁদের গ্রন্থ দ্বাদশ থেকে সপ্তাদশ শতক পর্যন্ত পাশ্চাত্যে চিকিৎসার মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিজ্ঞানে আল বিরুনী, দর্শনে কবি ওমর খৈয়াম, জ্যোর্তিবিদ্যায় আবু মাশার, ভূগোলবিদ্যায় আল খোয়ারিজমি, ইতিহাসে ইবনে খালদুন, আইন শাস্ত্রে আবু হানিফা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। স্থাপত্যকলা, শিক্ষায় যে উদার মনোভাবে ছিল, সেখানে ধর্মগত বিভেদ ছিল না। বরং বিশ্বমানবিকবোধ প্রকট রূপটি লক্ষ্য করা যায়।

ঈদের আনন্দের দিনে, সকলের মধ্যে বিশ্ব মানবিকবোধ জাগ্রত হোক। সকলের সাথে সম্প্রীতি, শান্তি সম্পর্ক স্থাপন করাই মূল লক্ষ্য হোক । জাতিগতভাবে বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগণ বাঙালি। এই জনজাতির ভেতর হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান, জৈনসহ সকল ধর্মের জন উপস্থিতি বিদ্যমান আছে। এটাই মঙ্গলশক্তি। সকলে একে অপরের সাথে প্রেম, দয়ার মিলনবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে । এই বাঙালির মিলনে ঈদ উৎসব হবে শান্তির ।

 

ঈদ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা অনুচিত। দেশ বিদেশে কুরবানীর কারণে বর্জ্য অপসারনকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেই সমাজ রাষ্ট্রে শান্তি বিরাজ করে। এমনকি যাঁরা মুক্ত চিন্তার, ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তাঁদের প্রতিও সহনশীল থাকতে হবে। সৃষ্টির সেবাই, প্রকৃত ধর্ম।

রাষ্ট্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্টের প্রতি সেবা অপরিহার্য বলে মনে হয়েছে। মানব জীবনের সার্থকতা তখনই, যখব রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা পায়।

ঈদের অনুভব কোন করুণাকে আবর্তিত করে প্রচলিত হয়নি। মানুষই মুখ্য হয়ে সকলের জন্য উৎসবে পরিণত হয়েছে। খাদ্য বন্টনের রীতি-পদ্ধতি সত্যিই বিস্ময়কর।

কল্যাণ হোক।

ঈদ মোবারক।

কামরুল ইসলাম

ঢাকা।

Share: