সক্রেটিসের শিক্ষা দর্শন এবং ড. ইকবালের তাৎপর্যময় পদক্ষেপ – ড. দিপু সিদ্দিকী

সক্রেটিসের শিক্ষাদর্শন ও আধুনিক বাংলাদেশে ড. এইচ বি এম ইকবালের শিক্ষাবান্ধব উদ্যোগ

ভূমিকা

শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির ভবিষ্যৎ গঠনের প্রধান হাতিয়ার। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত শিক্ষা মানুষের আত্মজ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। আধুনিক বিশ্বে শিক্ষাকে যখন বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে কেবলমাত্র ধনিক শ্রেণির জন্য সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে, তখন কিছু দূরদর্শী চিন্তাবিদ শিক্ষাকে সবার জন্য উন্মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন। বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব ড. এইচ বি এম ইকবাল সেই পথিকৃতদের একজন, যিনি সক্রেটিসের শিক্ষাদর্শন অনুসরণ করে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন।

সক্রেটিসের শিক্ষা দর্শন ও গুরুত্ব

সক্রেটিসের শিক্ষাদর্শনের মূল ভিত্তি ছিল প্রশ্ন-উত্তর পদ্ধতির মাধ্যমে যৌক্তিক চিন্তার বিকাশ ঘটানো। তিনি মনে করতেন, শিক্ষা হলো সত্যের সন্ধান এবং আত্মজ্ঞান অর্জনের পথ। তার অন্যতম উক্তি:

“আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না”

এটি বোঝাতে চায় যে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রথমেই নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করা প্রয়োজন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমেই প্রকৃত শিক্ষার বিকাশ ঘটে।

সক্রেটিসের অনুসারী প্লেটো তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাকাডেমি’ শহর থেকে দূরে স্থাপন করেছিলেন যাতে কোলাহলমুক্ত পরিবেশে জ্ঞানচর্চা করা যায়। অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন:

“প্লেটো কেন শহর থেকে অনেক দূরে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়েছিলেন? একটা কারণ হচ্ছে, সমাজের যে কোলাহল, যে হট্টগোল, এগুলো থেকে বাইরে গিয়ে চিন্তা করা… বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই নির্ধারণ করবেন তাঁরা কী পড়াবেন, ছাত্ররাই নির্ধারণ করবেন যে শিক্ষকেরা তাঁদের কীভাবে পড়াবেন।”

এই দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই ড. এইচ বি এম ইকবালের শিক্ষামূলক কার্যক্রমে।

ড. এইচ বি এম ইকবালের শিক্ষাবান্ধব উদ্যোগ

ড. এইচবিএম ইকবাল

ড. এইচ বি এম ইকবাল একজন সফল শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষানুরাগী। তিনি ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে রয়েল ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং পরে মমতাজ বেগম ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (মাস্ট) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামীণ শিক্ষার বিকাশে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

১. নিভৃত পল্লীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত

সক্রেটিসের শিক্ষাদর্শনের আলোকে, ড. ইকবাল শহরের বাইরে, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করেছেন। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার বাঁশগাড়ী গ্রামে প্রতিষ্ঠিত মমতাজ বেগম ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (মাস্ট) এই দৃষ্টান্তের উজ্জ্বল নিদর্শন।

২. ব্যবসামুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস

বর্তমানে বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ টিউশন ফি নির্ধারণ করে মূলত ধনী শ্রেণির জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ড. ইকবাল তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা সহজলভ্য করেছেন।

৩. গবেষণাধর্মী শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ

ড. ইকবাল মনে করেন, শুধু পাঠ্যপুস্তকনির্ভর শিক্ষা নয়, বাস্তবমুখী শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমেই প্রকৃত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি সম্ভব। তাই তিনি প্রজেক্ট-বেজড লার্নিং এবং বিশ্ববাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে পাঠ্যক্রম প্রণয়নের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।

৪. একাডেমিক স্বাধীনতার প্রয়োগ

সক্রেটিস ও প্লেটোর মতো, ড. ইকবালও বিশ্বাস করেন একাডেমিক স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছেন।

 

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় ড. ইকবালের ভূমিকা

ড. এইচ বি এম ইকবাল বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি বেসরকারি পর্যায়ে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং একাধিক স্কুল-কলেজ স্থাপন করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

 

১. রয়েল ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা (RUD)

ঢাকার প্রাণকেন্দ্র তেজগাঁও শিল্প এলাকায় অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী দক্ষতা উন্নয়নে প্রজেক্ট-বেজড লার্নিং মডেল চালু করা হয়েছে।

গবেষণা কার্যক্রমের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

২. মমতাজ বেগম ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (মাস্ট)

গ্রামীণ শিক্ষার বিকাশে এটি একটি নতুন দৃষ্টান্ত।

মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ উন্মুক্ত করা হয়েছে।

ভবিষ্যতে এখানে মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

উপসংহার

ড. এইচ বি এম ইকবাল সক্রেটিসের শিক্ষাদর্শন অনুসরণ করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন। ব্যবসামুক্ত, গবেষণাধর্মী ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রসারে তার অবদান অনস্বীকার্য।

 

আমাদের দায়িত্ব হলো, তার এই শিক্ষাদর্শন বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা। গবেষণামুখী প্রকল্প গ্রহণ, যুগোপযোগী প্রোগ্রাম চালু রাখা এবং শিক্ষাকে বিশ্বমানের করার লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করাই হবে প্রকৃত সম্মাননা।

 

“একজন প্রকৃত শিক্ষাবিদ শুধু শিক্ষকই নন, তিনি সমাজের দিশারী।”

ড. এইচ বি এম ইকবাল এই দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম উদাহরণ, এবং তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

তথ্যসূত্র:

১. সক্রেটিস ও প্লেটোর শিক্ষা দর্শন।

২. অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খানের বক্তৃতা।

৩. রয়েল ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা ও মমতাজ বেগম ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কার্যক্রম।

৪. আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড।

লেখক: প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক (দিপু সিদ্দিকী) ডিন- কলা অনুষদ রয়েল ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা।a.siddique@royal.edu.bd

 

Share: