শওকত ওসমান: সাহিত্যকর্ম ও সমাজচিন্তা – অধ্যাপক ডক্টর দিপু সিদ্দিকী

শওকত ওসমান বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি শুধু একজন কথাসাহিত্যিক নন, একজন সমাজসংস্কারক, একজন ভাবুক যিনি নিজের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা সংকটকে উন্মোচন করেছেন।

১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার খানাকুল থানার অন্তর্গত সবল-সিংহপুর গ্রামে শওকত ওসমান জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, মাতা গুলজান বেগম। শওকত ওসমানের শৈশব কেটেছে দাদী খুশীমনের আদর স্নেহে যত্নে। তিনি তাঁর দাদীকে ম্যাক্সিম গোর্কির নানীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, ‘আমার দাদী ছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কির নানীর মতো।’ (শওকত ওসমান, স্বজন স্বগ্রাম, ১৯৮৬:২৬) তাঁর দাদী ছিলেন সহজ সরল, অতি নিরীহ। দশ পর্যন্ত গুনতে পারতেন না। অথচ তিনি অপরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারতেন। মানবতার সেই কোমল ছায়ায় শওকত ওসমান দশ বছর কাটিয়েছিলেন। সবল-সিংহপুরেই তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল। শুধু পরিবারের আপনজনদের স্নেহ-মায়া-মমতা নয়, এলাকার পাড়াপ্রতিবেশি-আত্মীয়স্বজন সবাই তাঁকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। তাদের ভালোবাসাতেই পেয়েছিলেন জীবন চলান অনুপ্রেরণা।”-( শত ওসমানের ছোটগল্প: শিল্পরূপ অন্বেষা- রকিবুল হাসান , চিন্তা সূত্র পত্রিকা) আর সেসব কথা তিনি লিখেছেন তাঁর ‘স্বজন স্বগ্রাম’ গ্রন্থে।

শওকত ওসমান

শওকত ওসমান তাঁর লেখার মাধ্যমে সমাজের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরেছেন, যা তার সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তার ভাষায়, “আমি লেখক নই, আমি ‘ঝাড়-দার’।” অর্থাৎ, তিনি সমাজের জঞ্জাল সাফ করার কাজ করেছেন নিজের লেখার মাধ্যমে।

তাঁর পৈতৃকপ্রদত্ত নাম শেখ আজিজুর রহমান। কিন্তু তিনি পিতার প্রদত্ত নামের স্থলে সাহিত্যিক নাম ‘শওকত ওসমান’ ধারণ করেন। এরও বিশেষ একটা কারণ রয়েছে। শওকত ওসমানের সমসাময়িককালে আজিজুর রহমান নামে আর একজন কবি ছিলেন। তিনি কবি-গীতিকার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ফলে দুজনের একই নাম হয়ে যায়। নিজের নাম পরিবর্তনে এটা একটা কারণ হতে পারে। তবে এটা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ ওরকমও কিছু নয়। তাঁর ছদ্মনাম গ্রহণে অবচেতন কোন কারণও থাকতে পারে-শওকত ওসমান নিজেও তা বলেছেন। তাঁর বড় বোন ছিলেন। নাম সুফিয়া থাতুন। তিনি তাঁর নাম শওকত আলী রাখতে চেয়েছিলেন। শওকত ওসমান বড় বোনের নামটিই গ্রহণ করেন তবে শওকত আলীর ‘আলী’র জায়গায় তিনি ওসমান যোগ করে দেন। এভাবেই শেখ আজিজুর রহমান শওকত ওসমান হয়ে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে শওকত ওসমানের নিজের বক্তব্য:

‘আজিজুর রহমান নামে আর একজন কবি ছিলেন। আর ছদ্মনার গ্রহণের পেছনে হয়তো অবচেতন কোন কারণ থাকতে পারে। আমার জানার কথঅ নয়। আমার এক বোন ছিলেন। নাম সুফিয়া থাতুন। তিনি শওকত আলী রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। আমি আলির জায়গায় ওসমান যোগ করেছিলাম। ১৯৩১, ঠিক চুয়ান্ন বছর আগে তিনি পৃথিবী ছেগে চলে গেছেন। তাঁর স্মৃতি আমার ছদ্মনামের সঙ্গে জড়িত।’ (হুমায়ুন আজাদ, ‘কথাসাহিত্যের পথিকৃত শওকত ওসমান’, ‘রোববার’, ঢাকা, ৭ম বর্ষ, ২৯ সংখ্যা, ২১ শে এপ্রিল, ১৯৮৫, পৃ. ৩১)

শওকত ওসমান এর অপ্রকাশিত কবিতা

“বাংলাদেশের অসৎ আমলা ও রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন কায়দায় দেশের অর্থ, সম্পদ অন্য দেশে পাচার করেন। অন্যদিকে বিদেশিরাও বাংলাদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। এর চাইতে কয়েক গুণ বেশি অর্থ পাচার করেন বাংলাদেশিরা নিজেরাই। এতে করে এদেশে অবক্ষয়ের চরমরূপ ধারণ করেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবক্ষয়েরও চরিত্র বদলাচ্ছে। একসময় মনে করা হতো ঘুষ-তোষামদকে চূড়ান্ত অবক্ষয় ভাবা হতো। শওকত ওসমান সহ অনেক লেখকের গল্পে এ সত্য ধারণ কওে আছে। পরবর্তীতে অবক্ষয়ের যাত্রা ও মাত্রা বহুবিস্তৃতি ঘটেছে। শওকত ওসমানে গল্পে সমাজের উঁচুস্তর থেকে নিম্নস্তরের বিভিন্ন পেশাজীবীর নানারকম অপরাধ-দুর্নীতির চিত্র ধরেছেন। তাঁর ‘ইলেম’, ‘মনিব ও তাহার কুকুর’, ‘জনারণ্য’, ‘সাবালক’, ‘গরু চোরের প্রায়শ্চিত্ত’, ‘খলিফা’, ‘গোয়েন্দা কাহিনীর খসড়া’, ‘জবর খাতির’, ‘এক কাফন চোরের কাহিনী’, ‘দস্যু-দারোগা সংবাদ’, ‘কুটিলা ভবেৎ’, শিবগঞ্জের মেলা’, ‘স্বৈরিণী’, ‘তিন পাপী’, ‘দানসত্র’ প্রভৃতি গল্পে ঘুষ, মাদক, লাম্পট্য, সাংবাদিকের প্রতারণা, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি প্রভৃতি বিষয় মূল উপজীব্য।-রাকিবুল হাসান”

শওকত ওসমান ছিলেন নিরলস পরিশ্রমী একজন সাহিত্যসাধক। কাজী নজরুল ইসলামকে যা আকৃষ্ট করেছিল। তিনি শওকত ওসমানের জীবন ও সাহিত্যসাধনায় প্রীত হয়ে আশীর্বাদ করে লিখেছিলেন-

‘আছে সত্যের পূর্ণ স্বরূপ

চূর্ণিত পরমাণুতে,

আছে দেহাতীত অজানা অরূপ,

তোমারই বদ্ধ তনুতে।’

(মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ৪৯)

শওকত ওসমানের সাহিত্যজীবন:

শওকত ওসমানের সাহিত্যজীবন শুরু হয়েছিল কবিতা দিয়ে, তবে তার পরিচিতি মূলত গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং স্মৃতিকথার মাধ্যমে। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি, যিনি সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা থেকে সৃষ্টিকর্ম করেছেন। তার সাহিত্যে বৈচিত্র্য ও গভীরতা লক্ষ্যযোগ্য। তিনি সমাজের শোষণ, নিপীড়ন, ধর্মীয় মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

তার প্রথম গল্পটি ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় কলকাতার মাদ্রাসা-এ-আলিয়াতে। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘জননী’,দুই মুসাফির’, ‘সৌদামিনী মালো’ প্রভৃতি। শওকত ওসমানের গল্প ও উপন্যাসে জীবনের নানা দিক, বিশেষত গরিব মানুষের সংগ্রাম ও সমাজের দ্বন্দ্ব গভীরভাবে উঠে এসেছে। তাঁর সৃষ্টির মূল বিষয় ছিল মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায় ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা।

শওকত ওসমান বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য রত্ন। তার সাহিত্য শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং এটি সমাজের উদ্দেশে একটি শক্তিশালী বার্তা। তার লেখায় মানবিকতা, নৈতিকতা এবং সমাজে শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রয়েছে। তার সাহিত্যকর্ম যুগে যুগে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এবং সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষে প্রেরণা হয়ে থাকবে।

কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ২৫তম মৃত্যু বার্ষিকীতে পিবজা ‘র নেতৃবৃন্দ

শওকত ওসমানের সমাজ:

সচেতনতা এবং অগ্রগামী জীবন চিন্তা ও জিজ্ঞাসা তাঁর শিল্পীমানসের গুরুত্বপূর্ণ দিক। তার রচনাবলীতে ব্যঞ্জনাধর্মী রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার অসাধারণ। তাঁর সাহিত্যে দেশকালের প্রভাব রয়েছে ব্যাপকতর। শ্রেণী-দ্বন্ধের যন্ত্রণা বৈষম্য-সমস্যার কথাই তিনি শুধু বলেন নি, তার সমাধানের উপায় কোন পথে, কীভাবে- তাও তিনি দেখিয়েছেন। দায়িত্ববোধসম্পন্ন এবং দেশপ্রেম এর এক অনন্য লেখকসত্তার নাম শওকত ওসমান।

কলকাতা-জীবনে তাঁর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তৎকালীন ‘বুলবুল’ সম্পাদক হবীবুল্লাহ বাহার। ‘বুলবুল’ পত্রিকার অফিসে বহু কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে সাক্ষাৎলাভ ঘটেছিল এবং তাঁদের অনেকের সঙ্গেই হৃদ্যতা পূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ‘১৯৩০ এর দশকের শেষ এবং চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে যুক্তবাংলার লেখক বুদ্ধিজীবীরা সাহিত্য ও সংস্কৃতির কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলার সমাজপ্রগতিকে উর্মিমুখর ও গণমানুষের মুক্তির মন্ত্রণাদানের প্রয়াস পান। এ সময় কলকাতাং ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ (১৯৪২), ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘ’ (২৯ মাচ, ১৯৪২), গণনাট্য সংঘ্য প্রভৃতির মাধ্যমে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, লেখকরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। (বসু, অক্টোবর বিপ্লব ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য, ১৯৮৯:১৮৮) এই সমস্ত সংঘ-সমিতি নিয়ে কলকাতায় একটা অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্মতলা স্ট্রিটের ৪৬ নম্বর চারতলা বাড়িতে। এখানে ‘ইয়থ কালচারাল ইন্সটিটিউট. এবং ‘পরিচয়’ পত্রিকার অফিস ছিল। ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘের নিয়মিত সাহিত্যৈ বৈটখ হতো বুধবারে। এ বৈঠকে যোগ দিতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, গোপাল হালদার, হীরেণ মুখোপাধ্যায়, গোলঅম কুদ্দুস, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। শওকত ওসমান এই ৪৬ নম্বও ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। ফলে শওকত ওসমানের প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার উম্মীলন ঘটেছিল ‘একটি সাবলীল রাজনেতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মধারার উৎসনির্ঝর থেকে তিনি পেয়েছিলেন এই প্রেরণা। ফলে মুক্তবুদ্ধিচর্চা, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এবং ধর্মান্ধতার প্রতি তাঁর বিদ্বিষ্ট মনোভঅব ববরাবর প্রকাশ পেকেছে। বিভাগপূর্বকালে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য ও রাজনৈতিক চেতনায় এই বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বাংলা সাহিত্যে বহুমুখী অনন্য এক প্রতিভার নাম শওকত ওসমান। তার রচিত গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, কবিতা, আত্মজীবনী, স্মৃতিখণ্ড, শিশুতোষ, কাব্য, সম্পাদনা গ্রন্থ শতাধিক। তাঁর লেখার বিষয়বস্তু বহুমাত্রিকতায় পূর্ণ। বিষয়বস্তু নির্বাচনে যেমন তিনি সচেতন ছিলেন, তেমনি তিনি রচনার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও মননশীলতায় ক্ষেত্রেই দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা।

পরাধীনতা গ্লানিবোধ, স্বাধীনা সচেতন, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, দারিদ্র, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, শোষণ-বঞ্চনা, সামাজিক অবক্ষয়, শিক্ষঅর বৈরি পরিবেশ, নারীনিগ্রহ ও নিারী নির্যাতন, শ্রেণিচেতনা, পারিবারিক জীবনের নানাবিধ সমস্যা-সংকট-মনস্তাত্ত্বিকতা, ধনতান্ত্রিকতায় আত্মকেন্দ্রিকতা-ভোগবাদিতা-বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রভৃতি বিষয় তাঁর গল্পের উপজীব্য।

শওকত ওসমান রচিত ছোটগল্পে ছোটগল্প গ্রন্থগুলোতে মানুষের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম দরদ এবং ভালোবাসার চিত্র তুলে ধরেছেন।

ছোটগল্প গুলো হলো- জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২), মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬), ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্ধী (১৯৯০), হন্তারক (১৯৯১), প্রস্তর ফলক (১৯৬৪), সাবেক কাহিনী (১৯৫৩), জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), পুরাতন খঞ্জর (১৯৮৭), নেত্রপথ (১৯৬৮),উভশৃঙ্গ (১৯৬৮), পিজরাপোল (১৩৫৮ ব.), রাজপুরুষ (১৯৯৪),উপলক্ষ্য, এবং তিন মির্জা (১৯৮৬), বিগত কালের গল্প (১৯৮৭)।

প্রবন্ধ লেখার মধ্যেও তার দক্ষতা ছিল অতুলনীয়।তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ-সমুদ্র নদী সমর্পিত (১৯৭৩), ভাব ভাষা ভাবনা (১৯৭৪), সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই (১৯৮৪), ইতিহাসে বিস্তারিত (১৯৮৫),, মুসলিম মানসের রূপান্তর (১৯৮৬), নিঃসঙ্গ নির্মাণ (১৯৮৬), পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৮৬), উপদেশ কূপদেশ (১৯৯২,) মন্তব্য মৃগয়া (১৯৯৪), মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা (১৯৯৫), অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ (১৯৯৫), আর এক ধারাভাষ্য (১৯৯৬), অনেক কথন (১৯৯১) প্রভৃতি।

গল্প কবিতা প্রবন্ধ উপন্যাস এর পাশাপাশি নাটক রচনায় পারঙ্গম ছিলেন তিনি।

নাট্যসাহিত্যের বিকাশের ধারায় শওকত ওসমানের বিশেষ অবদান রয়েছে। তাঁর নাটকগুলো-আমলার মামলা (১৯৪৯), পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৯০), তস্কর ও লস্কর, কাঁকরমণি (১৯৪৯), বাগদাদের কবি (১৯৫২), এতিমখানা (১৯৫৫), ক্রীতদাসের হাসি (রামেন্দু মজুমদার সহযোগে, ১৯৬৮), নষ্টতান অষ্টভান (১৯৮৬), জন্ম-জন্মান্তর (১৯৮৬), তিনটি ছোট্ট নাটক (১৯৮৯)।

শিশুতোষ গ্রন্থ রচনাতেও তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ওটেন সাহেবের বাংলো (১৯৪৪), মস্কুইটো ফোন (১৯৫৭), ক্ষুদে সোশালিস্ট (১৯৭৩),পঞ্চসঙ্গী (১৯৮৭), তারা দুইজন (১৯৫৮), ডিগবাজি, প্রাইজ ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৯), জুজুগগা (১৯৮৮), ছোটদের নানা গল্প (১৯৮৪), ছোটদের কথা রচনার কথা (১৯৮৩) প্রভৃতি। তাঁর অনূদিত গ্রন্থ নিশো (১৯৪৮-৪৯), লুকনিতশি (১৯৪৮), স্পেনের ছোটগল্প (১৯৬৫), মলিয়ার পাঁচটি নাটক (১৯৬৫), বাগদাদের কবি (১৯৫৩) (নাটক), টাইম মেশিন (১৯৫৯),পাঁচটি কাহিনী (লিও টলস্টয়, ১৯৫৯),ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা (১৯৭৩), পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ (১৯৮৫), সন্তানের স্বীকারোক্তি (১৯৮৫)। তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘হবীবুল্লাহ বাহার’ (আনোয়ারা বাহার চৌধুরী সহযোগে, ১৯৭০), ‘ফজলুল হকের গল্প’ (১৯৮৩)।

শওকত ওসমানের গ্রন্থ ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে। ক্রীতদাসের হাসি’র ইংরেজি অনুবাদ. A Slave Laughs (১৯৭৬)। রাজা উপাখ্যানের ইংরেজি অনুবাদ The King and the Serpents (১৯৮৫), Selected Stories (১৯৮৫)। জননী উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ Janani (১৯৯৩)। রাজসাক্ষীর অনুবাদ The State Witness। শওকত ওসমান কবিতা লিখলেও কবিতাতে কখনোই মনোযোগী ছিলেন না। তাঁর বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ আছে। আত্মব্যঙ্গ কাব্য: নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত (১৯৭৫), ব্যঙ্গকাব্য: শেখের সম্ভরা (প্রথমখণ্ড, ১৯৯৪, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৯৫)।

তাঁর স্মৃতিকথা গ্রন্থগুলো- স্বজন স্বগ্রাম (১৯৯৬), কালরাত্রি খণ্ডচিত্র (১৯৮৬), গুডবাই জাস্টিশ মাসুদ ( ১৯৯১), স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর (১৯৯২), উত্তরপর্ব মুজিবনগর (১৯৯৩)।

 

বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৬২ সালে। ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের জন্য ১৯৬২ সালে পেয়েছেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান গভর্ণমেন্ট পুরস্কার পাপন। ১৯৮৩ সালে পেয়েছেন একুশে পদক পুরস্কার। একই বছরে পেয়েছেন মাবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার ও নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক। মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার পান ১৯৯১ সালে। স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৭ সালে। একই বছরে পান আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। ঈশ^রের প্রতিদ্বন্ধী গ্রন্থের জন্য ফিলিপস পুরস্কার পান ১৯৯৬ সালে। ১৯৯০ সালে পান টেলিভিশন নাট্যশিল্পী সংসদেও টেনাশিনাস পদক। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯২ সালে এবং ১৯৯৫ সালে পেয়েছেন সত্যেন সেন পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে তাঁর ৭৩তম জন্মদিন উপলক্ষে সবংর্ধনা দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে ‘শুভ জন্মদিন’ শিরোনামে স্যুভেনির প্রকাশিত হয়। ১৯৯১ সালে ২ জানুয়ারি তাঁর ৭৫তম জন্মবার্ষিকী সাড়ম্বরপূর্ণভাবে পালিত হয়। এ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তাঁকে মানুষের ‘অপরাজেয় আত্মার প্রতীক’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁকে সম্মানস্বরূপ এক লাখ এক হাজার টাকা প্রদান করা হয় এ অনুষ্ঠানে।

 

“বাংলাদেশের অসৎ আমলা ও রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন কায়দায় দেশের অর্থ, সম্পদ অন্য দেশে পাচার করেন। অন্যদিকে বিদেশিরাও বাংলাদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। এর চাইতে কয়েক গুণ বেশি অর্থ পাচার করেন বাংলাদেশিরা নিজেরাই। এতে করে এদেশে অবক্ষয়ের চরমরূপ ধারণ করেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবক্ষয়েরও চরিত্র বদলাচ্ছে। একসময় মনে করা হতো ঘুষ-তোষামদকে চূড়ান্ত অবক্ষয় ভাবা হতো। শওকত ওসমান সহ অনেক লেখকের গল্পে এ সত্য ধারণ কওে আছে। পরবর্তীতে অবক্ষয়ের যাত্রা ও মাত্রা বহুবিস্তৃতি ঘটেছে। শওকত ওসমানে গল্পে সমাজের উঁচুস্তর থেকে নিম্নস্তরের বিভিন্ন পেশাজীবীর নানারকম অপরাধ-দুর্নীতির চিত্র ধরেছেন। তাঁর ‘ইলেম’, ‘মনিব ও তাহার কুকুর’, ‘জনারণ্য’, ‘সাবালক’, ‘গরু চোরের প্রায়শ্চিত্ত’, ‘খলিফা’, ‘গোয়েন্দা কাহিনীর খসড়া’, ‘জবর খাতির’, ‘এক কাফন চোরের কাহিনী’, ‘দস্যু-দারোগা সংবাদ’, ‘কুটিলা ভবেৎ’, শিবগঞ্জের মেলা’, ‘স্বৈরিণী’, ‘তিন পাপী’, ‘দানসত্র’ প্রভৃতি গল্পে ঘুষ, মাদক, লাম্পট্য, সাংবাদিকের প্রতারণা, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি প্রভৃতি বিষয় মূল উপজীব্য।-রাকিবুল হাসান”

 

কথাসাহিত্যের বহুমাত্রিকতা তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

তাঁর কথাসাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে আর্থ-সামাজিক চেতনা, ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত, জাতীয় বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রূপক ও প্রতীকধর্মিতা, আন্তর্জাতিক জীবনবোধ, মানবপ্রবৃত্তির নান অনুষঙ্গ, দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা, রীতিবিরদ্ধ সম্পর্ক ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সর্বোপরি বিচিত্র উপজীব্য স্থান পেয়েছে। তাঁর উপন্যাসে যেমন এসব বিষয় উঠে এসেছে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে, তেমনি গল্পেও তিনি আন্তরিকতার স্পর্শে সেসব বিষয় বহুকৌণিকতায় তুলে এনে মানবদরদী শিল্পীমনের পরিচয় দিয়েছেন।

‘বাংলা সাহিত্যেও ছোটগল্পে শওকত ওসমান নিজেই একটি অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। তাঁর গল্পে ক্ষুধা-অভাব-দারিদ্র-দুর্ভিক্ষ, শোষণ-বঞ্চনা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নারীনিগ্রহ, নারী নির্যাতন, অবরুদ্ধ শিক্ষার পরিবেশ, পারিবারিক জীবনের নানান সমস্যা সঙ্কুল, শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিসংগ্রাম, ধর্মের নামে ভণ্ডামি, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, ধর্মের কল্যাণকর দিক, চল্লিশের দশকের পাকিস্তান আন্দোলন, সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, আটান্নর সামরিক আইন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। উপন্যাসের মতো তাঁর গল্পেও রূপক, প্রতীক ও সাঙ্কেতিকতা গুরুত্ব পেয়েছে। শওকত ওসমান ব্রিটিশশাসন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-এই তিন অধ্যায়কেই তিনি দেখেছেন। তাঁর সাহিত্যিক মানস গঠনে এসব যুগ-পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ব্রিটিশশাসিত ভারতে বিশেষ করে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা, সম্প্রীতিহীনতা, হত্যা, লুঠ, ধর্ষণ, ১৯৪৩ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, বাংলার গ্রামীণ দারিদ্র ও কৃষকের করুণ দুর্গতি সৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের থেকেও যে অনেক বেশি দায়ী ছিল মুনাফালোফী বণিকসমাজ ও হৃদয়হীন শাসকগোষ্ঠী, এভাবে বাংলার বুকে বহুবার কৃত্রিম সংকট তৈরি কওে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তৈরি করা হয়েছে, এতে বহু মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে, বহু নারী ক্ষুধার তাড়নায় সম্ভ্রম বিক্রি করেছে- সমাজজীবনে এসব তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ১৯৪৭-এর দেশভাগের বেদনা নিয়ে তিনি পাকিস্তান ভূখণ্ডের তৎকালীন পূব-পাকিস্তানে চলে আসেন। মানসিকভাবে বাংলার দ্বিখণ্ডিতা না মানলেও কর্ম ও বন্ধুদের কারণে হুগলী জেলার মানুষ হয়েও তিনি পূর্ববাংলায় চলে আসেন। পাকিস্তানের তেইশ বছরের দুঃশাসন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁকে রীতিমতো স্পর্শ করেছিল। তাঁর ছোটগল্পে এসবের তীব্র প্রভাব রয়েছে।’চিন্তাসূত্র-রাকিবুল হাসান)

‘সবচেয়ে ইতিহাসের মর্মান্তিক ট্রাজেডি ঘটে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে। এ শহরের সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর দৃশ্যের হোতা এই দুর্ভিক্ষে ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়।’ (রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৯৮২: ৫৬৭) এ সব দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষদর্শী শওকত ওসমান। কোন বড় লেখকই তাঁর সময়কালকে অস্বীকার বা এড়িয়ে গিয়ে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন না। যে কারণে বিখ্যাত সব লেখকই তাঁদের সমকালে ঘটে-যাওয়া বৃহৎ ঘটনাকে সাহিত্যের উপজীব্য করে অনিবার্যভাবে গ্রহণ করেন। তা হতে পারে রাজনৈতিক-মানবিক বিপর্যয়, আর্থ-সামাজিক-দুর্ভিক্ষ-অনেক কিছুই হতে পারে। কীর্তিমান লেখকেরা সে সব বিষয়ে সচেতন থাকেন।

দুর্ভিক্ষের কারণে নারীরা ক্ষুধার তাড়নায় কিভাবে নিজেদের শরীর স্বেচ্ছায় বেচায় বাধ্য হয়ে উঠেছিল, কিভাবে ক্ষুধায় যন্ত্রণায় শহর আর্তনাদে পরিণত হয়েছিল, কিভাবে দলে দলে মানুষ মৃত্যুবরণ করে শহরের রাস্তায় পড়েছিল, এসবের এক মর্মন্তুদ ছবি ফুটে উঠেঠে ‘ব্লাক আউট’ গল্পে।

‘শওকত ওসমানের আর্থ-সামাজিক চেতনাস্নাত গল্পগুলেঅতে বাঙালির অভাব-দারিদ্র্যেও পরিপ্রেক্ষিতে খুব বলিষ্ঠ ও আন্তর্প্রেরণায় নির্মিত। ঊভশৃঙ্গ গ্রন্থেও ‘আখেরী সংক্রান্ত’ গল্পটিতে ঢুলীদের অবস্থার বিবর্তন এবং ক্রমবধা দারিদ্রদশায় নিপাতন দেখান হয়েছে। নেত্রপথের ‘রাস্তার হদিস’ এ অঙ্কিত হয়েছে এক খোঁড়া ভিক্ষুক ও ভাতিজাদেও চিত্র। মোটকথা বাঙালির দারিদ্রের নানা বৈচিত্রমণ্ডিত চিত্র অঙ্কনে শওকত ওসমানের পরাঙ্গমতা অনস্বীকার্য।’ (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ১১৪)

শওকত ওসমান তাঁর ছোটগল্পে দারিদ্রের কারণ হিসেবে ধন-সম্পদের অসমবন্টন ও শোষণ-বঞ্চনার কথা উল্লেখ করেছেন।

‘বাংলা ছোটো গল্পে চল্লিশের দশকে যাঁরা লিখতে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য্য, সমরেশ বসু প্রমুখ বহু খ্যাতনামা কথা-সাহিত্যিকের নাম করা যায়। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘পরিচয়’, অরণি, ‘ক্রান্তি’ ইত্যাদি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে গল্পধারার সূচনা হয়েছিল, সেগুলির একটি মূলগত স্বভাবধর্ম যদি চিহ্নিত করতে হয়, তা হল, সেই গল্পগুলির অধিকাংশই ছিল সমসাময়িক দেশ-কাল সমাজনির্ভর। বলাবাহুল্য বাংলা ছোটোগল্প তার জন্মলগ্ন থেকেই সমাজ-মনস্ক থেকেছে। কিন্তু এই সময়পর্বে পরপর ঘটে যাওয়া কিছু রাষ্ট্রনৈতিক বিক্ষোভ, যেমন মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, বস্ত্র সংকট ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সমসাময়িক সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে লেখকদের দৃষ্টির সজীব আন্তরকতা ও তীক্ষ্ম সমাজমনস্ক মন সেই সময়কার ‘প্রগতি সাহিত্য’ বা ‘নতুন সাহিত্য’-র অন্তরতম সুরটিকে চিনিয়ে দিতে পেরেছিল।’ (বাপ্পা ঘোষ, ‘বস্ত্র সংকটের গল্প, আবরণ, দুঃশাসন, শিল্পী’, ‘পরবাস’ সংখ্যা-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)

 

শ্রেণিবিভক্ত সমাজের চিত্র নানাভাবে উঠে এসেছে শওকত ওসমানের গল্পে।

 

‘শওকত ওসমান অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই জাতিকে অসুস্থ ও পশ্চাৎগামী বিকৃত ইতিহাস থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। স্বজাতির মানুষগুলেঅর মধ্যে সুস্থ ইতিহাসবোধ সঞ্চার করাই তাঁর লেখনী চালানোর অন্যতম উদ্দেশ্য। সে-উদ্দেশ্যেও পরোক্ষা বাস্তবায়ন হয়েছে তাঁর গল্প-উপন্যাসে, আর একেবাওে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ রূপ ধরেছে প্রবন্ধে।’ (সরকার, ‘ইতিহাসসচেতন শওকত ওসমান’, সরকার আশরাফ (সম্পাদিত), ‘নিসর্গ’, বগুড়া, ৬ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৩৯৭, পৃ. ৮)

 

ধর্মীয় জীবনের বিভিন্ন দিক শওকত ওসমানের গল্পে উঠে এসেছে। শওকত ওসমান বিশ্বাস করতেন, ‘ধর্ম জীবনকে প্রভাবান্বিত করে। অবশ্যি। কিন্তু তা কখনও জীবনকে নিয়ন্ত্রিত কওে না। অর্থাৎ ধর্ম নিয়ন্ত্রকের জায়গা পায় না কোন দিন। (শওকত ওসমান, পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা, ১৯৯০ :৭৮)

 

শওকত ওসমান এক্ষেত্রে ধর্মের গোঁড়ামি ও পোশাকসর্বস্ব ধার্মিকতার বিরোধী ছিলেন।

 

‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্ধি’ গল্পে মূলত দ্বিতীয় স্বৈশাসকের ইচ্ছেকে প্রতীকীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় স্বৈরশাসক কিভাবে নিজেকে সাধারণ মানুষের সারিতে নিজেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল, এবং এই স্বৈরশাসক কিভাবে সাধারণ মানুষকে নিষ্পেষিত করেছিল, সেই ছবিটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুরারি চরিত্রের ইচ্ছের ভেতর দিয়ে। জোর করে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজেকে যে একাত্ম করা যায় না, মুরারিও চেষ্টা করেছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে অনধিকার প্রবেশের, পারেনি।

 

শওকত ওসমান মানবপ্রবৃত্তির বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে গল্প লিখেছেন।এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি-গবেষক অনীক মাহমুদ বলেছেন-,‘সুকুমার বৃত্তিগুলোর মধ্যে প্রেম, স্বাজাত্যবোধ, দানশীলতা, আতিথেয়তা, মমত্ব, সহানুভূতি, কল্যাণবোধ ইত্যাদি প্রসঙ্গ শওকত ওসমানের গলে।পর উপজীব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রবৃত্তিগুলোর মধ্যে প্রেমের বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি গল্প লিখেছেন।’ (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ২১৫)

শওকত ওসমান তাঁর গল্পে যে ভাষারীতির প্রয়োগ করেছেন, তা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর স্বকীয় ধারায় পরিণত হয়েছে।

অনেকের মধ্যেই শওকত ওসমানের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ষিল্পকৃতিতে প্রত্যক্ষ প্রভাব অন্বেষণ কওে বের করা হয়তো কষ্টসাধ্য হবে, তবে মননধর্মীতায় অবশ্যই প্রভাব পাওয়া যাবে। অন্তত তাঁরা স্বীকার করবেন যে, মুসলিম রচিত বাংলা কথাসাহিত্যে সমাজবাদী মানসিকতার একটি পরিসর ও পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। সেই গড়ে ওঠা প্রস্তুতি-সম্পন্ন পরিবেশে তাঁরা সাহিত্যিক যাত্রা শুরু করেছিলেন। আর এই পরিবেশসৃজনে শওকত ওসমান অগ্রণী ছিলেন। (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ২৫৪)

 

 

সাহিত্যিক রাকিবুল হাসান তারেক প্রবন্ধ লিখেছেন ”শওকত ওসমান বাংলা ছোটগল্পে অপরিহার্য ও অনিবার্য নাম। বাংলা ছোটগল্পকে নানা উপাচার সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার শক্তিতে বাংলা ছোটগল্পে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের স্থায়ী আসন। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে যাঁদের সৃষ্টিশীলতায় বাংলা ছোটগল্প বিচ্ছূরণ দিগন্তপ্রসারী হয়ে ক্রমশ বিকাশের উজ্জ্বল ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে প্রভাবসঞ্চারী ঋদ্ধ ব্যক্তিত্ব হিসেবে শওকত ওসমান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।”

বাংলা সাহিত্যে এই অমর কথাশিল্পী ১০৮ তম জন্মদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: কথাশিল্পী সাধারণ সম্পাদক – শওকত ওসমান স্মৃতি পরিষদ।অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক, যিনি ডক্টর দিপু সিদ্দিকী নামে অধিক পরিচিত।

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা:

১. হাসান, রকিবুল. “শওকত ওসমানের ছোটগল্প: শিল্পরূপ অন্বেষা.” চিন্তা সূত্র পত্রিকা, ৩০ মে ২০২৩।

২. আজাদ, হুমায়ুন. “কথাসাহিত্যের পথিকৃত শওকত ওসমান.” রোববার, ২১ এপ্রিল ১৯৮৫।

৩. বসু, সত্তেশ্বর. “অক্টোবর বিপ্লব ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য.” ১৯৮৯.

অনীক মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, সূচয়নী পাবলিশার্স, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৪।

৪.আবদুর রহিম গাজী, ‘রবীন্দ্র ছোটগল্পে পারিবারিক সম্পর্কের চালচিত্র’,অরণিকা, ১৫ নভেম্বর, ২০১৪)।

৫.আহমদ রফিক, ‘নাগরিক মননশীলতার ধীমান’, সরকার আশরাফ (সম্পাদিত), নিসর্গ, ৬ষ্ঠ বর্র্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৩৯৭)

৬.বাপ্পা ঘোষ, ‘বস্ত্র সংকটের গল্প, আবরণ, দুঃশাসন, শিল্পী’, ‘পরবাস’ সংখ্যা-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)

৭.মলয় বসু, ‘অক্টোবর বিপ্লব ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য’, কে-পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮৯।

৮.যতীন সরকার, ‘ইতিহাসসচেতন শওকত ওসমান’, সরকার আশরাফ (সম্পাদিত), ‘নিসর্গ’, বগুড়া, ৬ বর্ষ,১ম সংখ্যা, ১৩৯৭ )

৯.রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, তৃ-খ, জেনারেল প্রিন্টার্স এ্যান্ড পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ১৯৮১।

১০.রকিবুল হাসান, আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য, রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি, অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৩।

১১.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঊপনিবেশিকতা বনাম সংস্কৃতি-সংগ্রাম, যুগান্তর ঈদসংখ্যা ২০২৩।

Share: