বৈষম্য বিরোধী বিপ্লব: একটি জাতি রাষ্ট্রের নবযাত্রা – ড.দিপু সিদ্দিকী

বৈষম্যবিরোধী বিপ্লব: একটি জাতি রাষ্ট্রের নবযাত্রা

 

ভূমিকা:

পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লব সবসময়ই নতুন দিগন্তের সূচনা করে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের বুকে ঘটে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী বিপ্লব তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ ৫৪ বছরের বৈষম্য, শোষণ, এবং দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস এই বিপ্লবের মাধ্যমে এক নতুন পথচলার সূচনা করে। এই বিপ্লবের অন্যতম প্রেরণা ছিল মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, স্বৈরশাসনের অবসান, এবং একটি সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন।

 

অভূতপূর্ব এই গণজাগরণে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও, একজন ব্যতিক্রমী নায়ক ছিলেন আব্দুল হক। তার আদর্শ, দূরদর্শিতা, এবং নীরব নেতৃত্ব এই বিপ্লবকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেয়। এই প্রবন্ধে আমরা বিপ্লবের পটভূমি, আব্দুল হকের অবদান, এবং তার চিন্তাধারার দর্শন নিয়ে আলোচনা করবো।

বিপ্লবের পটভূমি:

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। দীর্ঘ ৫৪ বছরে রাজনীতি শোষণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। স্বৈরশাসক, ধনিক শ্রেণি এবং লুটেরাদের দৌরাত্ম্যে দেশটি বৈষম্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। লর্ড ম্যাকলের ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে টিকে ছিল, যা দেশের মেধা ও নৈতিকতার বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

 

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং জনগণের মৌলিক অধিকার হরণের ফলে মানুষের ক্ষোভের পুঞ্জিভূত বিস্ফোরণ ঘটে ২০২৪ সালে। এই সময় একঝাঁক সাহসী তরুণ শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে একটি গণবিপ্লব শুরু হয়, যা ক্রমেই সাধারণ মানুষের মুক্তির আন্দোলনে রূপ নেয়।

আব্দুল হকের নেতৃত্ব ও প্রেরণা:

বিপ্লবের মূল পটভূমিতে যে কয়জন অভিভাবকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদেরই একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, আব্দুল হক। পেশায় একজন ব্যবসায়ী হলেও তার দর্শন ও চিন্তাধারা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একটি জাতি রাষ্ট্র গড়ার জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি, শুদ্ধাচারী নেতৃত্ব, এবং বৈষম্যহীন সমাজ।

 

গ্রাফিতি শিল্পের ব্যবহার:

আব্দুল হকের অন্যতম উদ্ভাবনী প্রয়াস ছিল গ্রাফিতি শিল্পের মাধ্যমে বিপ্লবের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সাধারণ মানুষের কাছে বিপ্লবের বার্তা সহজে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এটি একটি কার্যকরী মাধ্যম। তার নেতৃত্বে গ্রাফিতি শিল্পীরা শহরের দেয়ালে ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলে। একটি সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন, বৈষম্যবিরোধী বার্তা, এবং স্বাধীনতার চেতনা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।

 

বিপ্লবের ইতিহাস সংরক্ষণে উদ্যোগ:

বিপ্লবের ইতিহাস বিকৃতির আশঙ্কা থেকে আব্দুল হক দ্রুত ফটোগ্রাফি এবং অ্যালবাম প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তার চিন্তাধারায়, বিপ্লব একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এর চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যক। তার এই দূরদর্শিতা বাংলাদেশকে শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও পরিচিত করে তোলে।

জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্ন:

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্রচিন্তক আব্দুল হক

আব্দুল হক যে স্বপ্ন দেখতেন তা ছিল একটি জাতি রাষ্ট্র গড়ে তোলা, যেখানে বৈষম্য থাকবে না, সবাই সমান সুযোগ পাবে, এবং শাসকের পরিবর্তে সেবকের ভূমিকা নিশ্চিত হবে। তিনি বলতেন, “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, তবে সেটি হবে নৈতিকতা এবং দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে গঠিত।” তার মতে, শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম, ন্যায়পরায়ণতা, এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা সম্ভব।

জাতি রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে দার্শনিক রুশোর উক্তি প্রাসঙ্গিক:

“Man is born free, and everywhere he is in chains.”

আব্দুল হক মনে করতেন, মানুষ প্রকৃত স্বাধীন তখনই হয় যখন তার নৈতিক এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা সঠিকভাবে বিকশিত হয়।

বিপ্লবের চেতনা এবং ভবিষ্যৎ:

বিপ্লবের চূড়ান্ত সফলতা আসে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। এটি প্রমাণ করে, ঐক্যবদ্ধ জনগণ কখনোই শোষণের শৃঙ্খল মেনে নেয় না। তবে আব্দুল হক জানতেন, বিপ্লবের পরে প্রতি-বিপ্লব এবং ইতিহাস বিকৃতির আশঙ্কা সবসময় থাকে। এজন্যই তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিপ্লবের চেতনা জীবন্ত রাখার চেষ্টা করেন।

 

তরুণদের অনুপ্রেরণা:

তার দর্শন অনুসারে, তরুণরাই একটি জাতির ভবিষ্যৎ। শুদ্ধাচারী, দেশপ্রেমিক তরুণ প্রজন্মই পারে জাতিকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি দিতে। প্লেটোর উক্তি,

“The direction in which education starts a man will determine his future in life,”

তাঁর স্বপ্নের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।

উপসংহার:

বৈষম্যবিরোধী এই বিপ্লব শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, এটি ছিল নৈতিকতার পুনর্জাগরণ। আব্দুল হকের মতো স্বপ্নদ্রষ্টা এবং হাতেগোনা কয়েকজন দেশ প্রেমিক ত্যাগী নেতৃত্বের জন্যই এটি সম্ভব হয়েছিল। তাঁর চিন্তাধারা এবং কর্মকাণ্ড কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের সকল নিপীড়িত জনগণের জন্য একটি দৃষ্টান্ত।

 

আজকের সমাজে, তাঁর মতো দূরদর্শী এবং শুদ্ধাচারী নেতৃত্বের বিকাশ প্রয়োজন। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি তরুণরা এগিয়ে আসে, তবে সত্যিকার অর্থেই একটি জাতি রাষ্ট্রের বীজ বপন করা সম্ভব। ইতিহাস তাঁর মতো নায়কদের কথা মনে রাখবে, যারা নিভৃতে থেকেই সমাজকে আলোকিত করেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

 

Share: