প্রে্সওয়াচ রিপোর্টঃ১৪ মে মহান কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ২৪ তম প্রয়াণ দিবস। ১৪ মে বিকেল পাঁচটায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিতব্য স্মরণসভার প্রধান অতিথি মাননীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি কবি ইয়াফেস ওসমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিষদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দিপু সিদ্দিকী।
জীবনবাদী কথাশিল্পী শওকত ওসমান
“তুমি যা বলতে, তুমি কি এতো যন্ত্রণা বুকে আজও তাই মনে রেখেছ? তুমি বলতে, “ মেহেরজান, গোলামের মহব্বৎ আর এক আলাদা চিজ। তা আমির ওমরার মহব্বত নয়। তারা দৌলতের কদর বোঝে। আরা দোউলতের বড় গুণ হলো বিনিময় আর হাতফেরী হওয়া। হস্তান্তর ছাড়া তার গুণ প্রকাশ পায় না। আমির ওমরার মহব্বত এই হাতফেরীর মহব্বত। গোলামের প্রেম ধ্রুবতারার মত স্থির-আকাশের একটি প্রান্তে একাকী মৌন-অবিচল(রোরুদ্যমান)………”
এই কান্নাজড়িত সংলাপটি ক্রীতদাসের হাঁসি উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র মেহেরজানের ভাষ্যে তার প্রেমিক তাতারীর কথা… আর এই বিখ্যাত উপন্যাসটি রচনা করেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। তিনি শওকত ওসমান কলমি নামে অধিক পরিচিত। তার মা বাবার দেওয়া নাম শেখ আজিজুর রহমান।
শওকত ওসমান বাংলার একজন সব্যসাচী লেখক ছিলেন। তিনি বাঙালি সংস্কৃতির সমর্থক আর স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ। রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও তিনি রাজনৈতিক মতামত প্রকাশে ছিলেন স্পষ্টভাষী। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষেও তিনি ছিলেন এক উচ্চকিত কণ্ঠস্বর। সমাজ সচেতনতা ও আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসা তাঁর শিল্পীমানসের ধর্ম। শ্রেণী-দ্বন্দ্বের যন্ত্রণা বৈষম্য ও সম্ভাব্য সমাধানের অস্পষ্ট প্রবণতা তাঁকে যেমন করেছে উৎকেন্দ্রিক, তেমনি নিরীক্ষাধর্মী।
তিনি ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলার সাবল সিংহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ মোহাম্মদ এহিয়া, মাতা গুলজান বেগম। পড়াশোনা করেছেন মক্তব, মাদ্রাসা, কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা শুরু করলেও পরবর্তীকালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও অর্থনীতি বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। আইএ পাস করার পর তিনি কিছুদিন কলকাতা করপোরেশন এবং বাংলা সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন। এমএ পাস করার পর ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ অফ কমার্সে যোগ দেন এবং ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছা অবসরে যান। চাকরি জীবনের প্রথমদিকে কিছুকাল তিনি ‘কৃষক’পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর তিনি চলে আসেন পূর্ববঙ্গে।
প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ শওকত ওসমানকে বলতেন `অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ`। আমাদের কথাসাহিত্যের ইতিহাসের সঙ্গে অন্বিষ্ট একটি পরিচিত নাম শওকত ওসমান। দেশভাগের পরেই নয় পূর্বে থেকেই বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের কাল শুরু এবং শওকত ওসমান ছিলেন শুরু থেকেই। সেই বিবেচনায় বলা যায়, ইতিহাস পরম্পরায় এই সুদীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক সকলক্ষেত্রের ঘটনাবর্তের এক নির্মম স্বাক্ষী ও অংশীদার তিনি। ক্রমঅগ্রসরমান ক্রমবিবর্ধিত বাঙালি মুসলিম জীবন-সংস্কৃতির অনুধ্যানের সবটা তাঁর চোখের সামনেই ছিলো সব সময়। আর এ কারণেই সচেতন মানুষ হিশেবে তিনি এসব কিছুকেই করে তুলেছেন তার সাহিত্যের মূল উপজীব্য।
তিনি তার সাহিত্যিক জীবনে একটা সরল সোজা পথে চলেছিলেন। তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্যসূচক রেখা খুব একটা দুর্গম নয় মোটামুটি একটা সরল রেখা। সাদা অর্থে তাঁর রচনার বিষয়, মধ্যবিত্ত সমাজ- বিশেষত গ্রামীণ সমাজ। কখনো অতীতচারী মুসলমান সমাজের টানাপড়েন, তাঁদের ধর্মীয় জীবন, কখনো সাধারণ মানুষ, আবার কখনো জাতীয় জীবনের নানা সংঘটনে ক্ষুব্ধ মেরুদণ্ডহীন মধ্যবিত্ত, এক কথায় ব্রিটিশ আমল থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের ক্রমঅপসৃয়মান জীবনচরিত্র তিনি একে গেছেন দীর্ঘদিন ধরে, কখনো গল্পে কখনো উপন্যাসে। সমাজ জীবন তাঁর সাহিত্যের বড় উপাদান।
বিশের দশক আর ত্রিশের দশকের পটভূমিতে তাঁর বিখ্যাত দুটি উপন্যাস রচিত হয়েছে- বনী আদম ও জননী।
‘জননী’ উপন্যাসে সমাজ ঔপন্যাসিকের নিজস্ব জীবন অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। এখানের ভাষা শব্দ গঠন ও রচনাশৈলী চমৎকার। অবশ্য ঐ সময়ের অন্যান্য ঔপন্যাসিকের রচনাভঙ্গির প্রভাব এখানে স্পষ্ট। তবু তাঁর ভাষা প্রয়োগে নিজস্ব ধরণ ও গতিময়তা পাঠককে মুগ্ধ করে–
“একটি বাঁক ফিরিতেই পরিচিত পথ দেখিয়া সে পুলকিত হইয়া উঠিল। এই শীর্ণ রাস্তাটি সাদা ফিতের দাগের মত আঁকাবাঁকা সমন্বয়ে পাড়ার ওদিকে মিশিয়া দিয়াছে। দুইপাশে নানা রকমের গাছ। সন্ধা আসন্ন। ভয়াতুর মসৃণ অন্ধকার জমিয়া উঠিতেছে খানা খোন্দলে, পত্রপঞ্জের অনাবৃত বুকে”।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবে নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩) উপন্যাসটি তার অনেক বেশি সফল একটি উপন্যাস। এ উপন্যাসে বাংলাদেশের নারীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে নির্যাতিতা ধর্ষিতা হয়েছে তার এক করুণ চিত্র চিত্রিত। এখানে সবরকম শ্রেণীর নারীর (জায়েদা, জনিমা, সখিনা, রাশিদা বিবি, আমোদিনী) আত্মত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাদের যে অবদান তা সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এদের মানসম্ভ্রম যেভাবে ধুলোয় মিশে গেছে তাদের চোখের সামনে তাতে করে তিলে তিলে তারা উপলব্ধি করেছে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কতটা ত্যাগ বাঙালির স্বীকার করতে হয়েছে। নিজেদের ভেতরের আগুন ও গ্লানি, পাশাপাশি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিকতা তাদের মননে ও মানসিকতায় নতুন অনুধ্যানের জন্ম দিয়েছে। তারা মুক্তি সৈনিকে পরিণত হয়েছে। বন্দী নারীরা হানাদারের ছোবলে পরিণত হয়েছে। বন্দী নারীরা হানাদারের ছোবলে উলঙ্গ অবস্থায় একসঙ্গে থেকেছে- ধর্ষিতা হয়েছে, অন্যকে ধর্ষিতা হতে দেখেছে, শওকত ওসমান সে সব দৃশ্যের সে সব অনুভবের মর্মন্তুদ বর্ণনা দিয়েছেন।
শওকত ওসমান গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কবতিা, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, শিশুতোষ ইত্যাদি সকল বিষয়ে প্রচুর রচনা করেচেন। তবে কথাশিল্পের ক্ষেত্রেই তাঁর অবস্থান সবচেয়ে বেশি সুদৃঢ়। তাঁর গ্রন্থরে সংখ্যা শতাধিক।
তাঁর উপন্যাসসমূহরে মধ্যে রয়েছে জননী (১৯৫৮) (১ম উপন্যাস), ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২), সমাগম (১৯৬৭), চৌরসন্ধি (১৯৬৮), রাজা উপাখ্যান (১৯৭১), জাহান্নাম হইতে বিদায়(১৯৭১), দুই সৈনিক (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩), র্আতনাদ (১৯৮৫), রাজপুরুষ (১৯৯২)।
গল্পগ্রন্থ- জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২), মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬), ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০)।
প্রবন্ধগ্রন্থ- ভাব ভাষা ভাবনা (১৯৭৪), সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই (১৯৮৫), মুসলিম মানুষের রূপান্তর (১৯৮৬)।
নাটক- আমলার মামলা (১৯৪৯), পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৯০)।
শিশুতোষ গ্রন্থ- ওটনে সাহবের বাংলো (১৯৪৪), মস্কুইটোফোন (১৯৫৭), ক্ষুদে সোশ্যালিস্ট (১৯৭৩), পঞ্চসঙ্গী (১৯৮৭)।
রম্য রচনা: নিজস্ব সংবাদদাতার প্রতি (১৯৮২)।
স্মৃতকিথামূলক গ্রন্থ- স্বজন সংগ্রাম (১৯৮৬), কালরাত্রি খ-চিত্র (১৯৮৬), অনেক কথন (১৯৯১), গুড বাই জাস্টিস মাসুদ (১৯৯৩), মুজবিনগর (১৯৯৩), অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ (১৯৯৪), সোদরের খাঁজে স্বদশের সন্ধানে (১৯৯৫), মৌলবাদরে আগুন নয়তো খেলা (১৯৯৬), আর এক ধারাভাষ্য (১৯৯৬)।
অনূদতি গ্রন্থ- নিশো (১৯৪৮-৪৯), বাগদাদের কবি (১৯৫৩), টাইম মেশিন(১৯৫৯), পাঁচটি কাহিনী (লিও টলস্টয়, ১৯৫৯), স্পেনের ছোটগল্প (১৯৬৫), পাঁচটি নাটক (১৯৭২), ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা (১৯৭৩),পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ (১৯৮৫), সন্তানের স্বীকারোক্তি (১৯৮৫)।
অন্যান্য গ্রন্থসমূহ- মুক্তযুদ্ধের উপন্যাসসমগ্র (১- ৩), গল্পসমগ্র, কিশোরসমগ্র-১, কিশোরসমগ্র-২।
শওকত ওসমান বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬), প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক (১৯৮৩), মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭), আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হন।
বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে এক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই সাহিত্যিক মে ১৪, ১৯৯৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার মৃত্যুদিবস। বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের ধারায় শওকত ওসমানের মতো সাহিত্যিককে হারানো অত্যন্ত গুরুতর এক ক্ষতি!