কয়েক মাস ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পামওয়েল উৎপাদন ও রফতানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়ার ভোজ্যতেলের বাজারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের চাহিদা ও দাম বাড়ার প্রভাব পড়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারেও। দাম বেড়ে যায় পামওয়েলের। দাম কমাতে ও মুনাফাখোরদের শিক্ষা দিতেই পামওয়েল রফতানি বন্ধ করেছে ইন্দোনেশিয়া সরকার।
কোভিড পরবর্তী উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই ভোজ্যতেলের এ মূল্যবৃদ্ধিতে তৈরি হয় জনঅসন্তোষ। ফলে চাপ বাড়ে দেশটির গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি। এ পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের দামের স্থিতিশীলতা বজায় এবং তেলের দামকে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে শেষ পর্যন্ত সব ধরনের পরিশোধিত ও অপরিশোধিত পামওয়েল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাকার্তা।
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় পামওয়েল সরবরাহকারী হওয়ায় পুরোপুরি রফতানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টির প্রভাব ও তাৎপর্য অনেক বেশি। স্বভাবতই খুশি নন ইন্দোনেশিয়া থেকে পামওয়েল আমদানির ওপর নির্ভর করা দেশগুলো। পাশাপাশি অখুশি ইন্দোনেশিয়ার পামওয়েল শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও।
বিশ্বজুড়ে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ইন্দোনেশিয়ার মতো কাঁচামাল রফতানিকারক দেশগুলোর জন্য বিপুল রফতানি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে যখন দেশটির কয়লা ও পামওয়েলের মতো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাঁচামালের বিপুল রফতানি সক্ষমতা রয়েছে। এ বিষয়টি ইন্দোনেশিয়ার পামওয়েল রফতানিকারকদের জন্যও সুবর্ণ সম্ভাবনার সৃষ্টি করে।
কিন্তু এই পরিস্থিতি রফতানিকারকদের জন্য লাভজনক হলেও এর প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যায়। আর ইন্দোনেশিয়া (গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত) সরকার চায় না আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তার নিজের দেশের লোক দুর্দশার শিকার হোক।
জাকার্তার বর্তমান জোকো উইদোদোর সরকারের সামনে এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, চাল ও ভোজ্যতেলের মতো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা। বিশ্ববাজারে পামওয়েলের মতো পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাজারে এক ধরনের বিপরীতমুখী অবস্থা তৈরি করেছে।
আরও পড়ুন: দরপতন থামছে না বিটকয়েনের
দেশটির পামওয়েল উৎপাদক ও রফতানিকারকরা চাচ্ছেন বিশ্বে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে যতটা বেশি সম্ভব পামওয়েল রফতানি করে লাভবান হতে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় দাম বেড়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজারে। কারণ অভ্যন্তরীণ বাজারে তেল বিক্রি থেকে রফতানির দিকেই বেশি আগ্রহ ব্যবসায়ীদের। অভ্যন্তরীণ বাজারের বদলে রফতানিতেই মুনাফা বেশি তাদের।
এর ফলে বছরজুড়ে ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাজারে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে যায় ভোজ্যতেলের দাম। এ পরিস্থিতিতে মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানতে প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে জোকো উইদোদোর সরকার। পামওয়েল রফতানির ওপর কোটা আরোপের পাশাপাশি বেঁধে দেওয়া হয় তেলের সর্বোচ্চ দাম। এছাড়া আইন অমান্যকারী অসাধু পাম ওয়েল ব্যবসায়ী এবং রফতানিকারকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
তবে তাড়াহুড়ো করে নেওয়া এসব পদক্ষেপে খুব একটা লাভ হয়নি। এ পরিস্থিতিতে রমজান মাসের পর ঈদুল ফিতরের ছুটি ঘনিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে তেলের দাম কমানোর জন্য চাপের মুখে পড়ে সরকার।
শেষ পর্যন্ত বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে আরও কঠোর হতে বাধ্য হয় ইন্দোনেশিয়ার সরকার। যার ফলাফল পামওয়েল রফতানির ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা। তবে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের মূল্য কমানোর পাশাপাশি অসাধু পামওয়েল উৎপাদনকারী ও রফতানিকারকদের প্রতি কঠোর বার্তা দেওয়াও ছিল এ নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য। নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সরকার জানাতে চেয়েছে, জাতীয় স্বার্থে যখনই প্রয়োজন তখনই বাজারে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা রাখে সরকার।
এর আগেও ইন্দোনেশিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ সঙ্কট নিরসণে কয়লা রফতানির ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা দেয় ইন্দোনেশিয়ার সরকার। এর ফলে ইন্দোনেশিয়ার বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো বাজার দর থেকে কম মূল্যে কয়লা কিনে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচল রাখতে সমর্থ হয়। স্বস্তি ফিরে আসে সাধারণ জনগণের মধ্যে।
যদিও ইন্দোনেশিয়ার সরকারের এসব পদক্ষেপকে খুব ভালোভাবে নিচ্ছে না দেশটির প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তারপরও সাধারণ জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে এসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে মাথানত করতে রাজি নয় ইন্দোনেশিয়া সরকার।
এ রফতানি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে ইন্দোনেশিয়া সরকারের বার্তা পরিষ্কার। তাহলে তাদের কাছে জনগণের স্বার্থ আগে। ব্যবসায়ীদের আগে দেশের বাজারে প্রয়োজনীয় যোগান নিশ্চিত করতে হবে। তাতে তাদের মুনাফার যতই ক্ষতি হোক না কেন। পামওয়েল রফতানি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে মূলত এই বার্তাটিই স্পষ্ট ভাষায় দিতে চেয়েছে ইন্দোনেশিয়া সরকার।
সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি