রাসায়নিকের গন্ধে আবার ভারী হয়ে উঠেছে পুরান ঢাকা।আরেকটি ট্র্যাজেডির অপেক্ষা?
চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুনের পরও বদলায়নি পুরান ঢাকা। রাসায়নিকের গন্ধে আবার ভারী হয়ে উঠেছে অলিগলি। অসাবধানে জ্বলে ওঠা একটি স্ফূলিঙ্গও কারণ হতে পারে আরেকটি ট্রাজেডির।
স্থানীয়রা বলছেন, নিমতলি বা চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ ঘটনার পরও রাসায়নিক পদার্থের ঝুঁকি থেকে বের হতে পারিনি আমরা। চুড়িহাট্টার আগুনের ক্ষত না শুকাতেই লোভী ব্যবসায়ীরা নতুন করে আবার অনিরাপদ করে ফেলেছে এলাকাটাকে। এখনও আতঙ্কে দিন কাটছে আমাদের।
চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে সব কেমিক্যাল গুদাম ও দোকান সরানোর ঘোষণা দিয়েছিল একাধিক মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিসও। ঘোষণা বাস্তবায়নে একটানা ১৫ দিনের অভিযানও চালিয়েছিল সিটি করপোরেশন। কয়েকটি গুদাম সিলগালাও করা হয়েছিল। তবে বিশেষ কোনও পরিবর্তন আসেনি তাতে। প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে রাসায়নিকের কেনাবেচা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, চুড়িহাট্টার সেই চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশনের ক্ষতগুলো নতুন ইট বালিতে সংস্কার করা হয়েছে। এখন দেখে বোঝার উপায় নেই ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে এই ভবনটি জ্বলেছিল দাউ দাউ করে। বিভিন্ন ফ্লোর থেকে ছিটকে পড়ছিল লাইটারের গ্যাস, সুগন্ধিসহ বিভিন্ন কেমিক্যালের টিউব। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশের ভবনে।
পুরো চকবাজার জুড়ে আবার বসেছে ছোট ছোট কেমিক্যালের গুদাম। সরু গলিতে ঢুকছে সিএনজিচালিত পিকআপ ভ্যান। গলির মুখেই খাবার দোকানগুলোতে জ্বলছে চুলা। এমনকি ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনেই বসেছে অনিরাপদ নানা দাহ্য পদার্থের দোকান। তবে এবার আর সাইনবোর্ড লাগায়নি তারা।
ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে মসজিদের পাশে সাইনবোর্ড ছাড়া সেই দোকান মালিক ইউসুফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার ব্যবসাটাই এমন। এসব ছাড়া কী করে খাবো।’
ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে আবার বসেছে সেই খাবার হোটেলটাও। গত বছর আগুনের দিন ওই হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই বোঝা গিয়েছিল আগুনের ভয়াবহতা। আবারও সেখানে রাস্তার পাশে চুলায় আগুন জ্বলছে। দেখে মনে হবে সরু রাস্তা দিয়ে যাওয়া রিকশার যাত্রীরাও ওই আগুন থেকে নিরাপদ নয়। হোটেল ম্যানেজার মোহাম্মাদ সাকিল বললেন, ‘এক ঘটনা মনে রেখে ব্যবসা গুটিয়ে নিলে জীবন চলবে কিভাবে। শত অনিরাপত্তার মধ্যেই ব্যবসা চালিয়ে যেতে হবে।’
শুধু এই গলিই নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৮, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রতিটি অলিগলি অনিরাপদ। রাস্তার দুই ধারেই রাসায়নিকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।
২৯ নম্বর ওয়ার্ডের মিষ্টি ব্যবসায়ী মোতালেব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুরান ঢাকায় শুধু আমাদের নয়, আমাদের দাদারও শৈশব কেটেছে। চাইলেও তো এখান থেকে যেতে পারি না। আমাদের নতুন প্রজন্মও এখানে আছে। তবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এ সব অনিরাপদ ব্যবসা সরিয়ে ফেলা উচিৎ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গোডাউন ও দোকান রয়েছে প্রায় ২২ হাজার। অধিকাংশেরই অনুমোদন নেই। লাইসেন্স আছে মাত্র ৮০০টি গুদামের। বিভিন্ন বাসা-বাড়িতেও আছে কেমিক্যাল ও পারফিউমের গোডাাউন। আরমানিটোলায় শাবিস্তান সিনেমা হল ভেঙে যে ভবন করা হয়েছে সেখানেও রাসায়নিকের গুদাম আছে। হাটখোলা থেকে চকবাজার পযন্ত সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন ভবনে রয়েছে, যেখানে দেখা যাবে কেমিক্যালের অন্তত কয়েকশ দোকান ও গোডাউন। সেসবে নেই কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। বেচারামদেউরী, মৌলভী বাজার, চকমোগলটুলী, ইমামগঞ্জ, চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতেও আছে কেমিক্যাল গুদাম ও দোকান।
পুরান ঢাকায় সবচেয়ে বেশি অভিযান চালানো র্যাবের সাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরাসরি রাসায়নিকের গুদামের পাশাপাশি পুরো পুরান ঢাকা দাহ্য পদার্থে ঠাসা। এটা সহজ কোনও ব্যবসা না। অনেক সিন্ডিকেট ম্যানেজ করে তারা ব্যবসা করে। কোটি কোটি টাকা দেয় শুধু ব্যবসা চালু রাখতে। অনেক অভিযান চালিয়েছিলাম। কয়টাই বা বন্ধ করবো। পুরান ঢাকার এ সব ব্যবসায়ী যেকোনও অন্যায়ের বেলায় একজোট। তারা সহজে মুখ খুলতেও চায় না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ জানান, পুরান ঢাকায় আমরা নিয়মিত পরিদর্শন করি। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে গিয়ে কথা বলে আসি। পুরো পুরান ঢাকা অগ্নিব্যবস্থা নিয়ে আমরা একটা তালিকা তৈরি করেছি। সেটা ধরে কাজ করছি।
কিছু অসাধু ভবন মালিক মোটা অঙ্কের লোভে, অতিরিক্ত অগ্রিম ও ভাড়া পেয়ে কোনও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আবাসিক এলাকার মধ্যেই রাসায়নিকের গুদাম ভাড়া দেয়। সেই তালিকাও আমাদের হাতে আছে।
এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারায় ১২৪ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় প্রাণহানীর সংখ্যা ৭১। এই দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনারই উৎস ছিল রাসায়নিকের গুদাম। তবুও সেই রাসায়নিকের সঙ্গেই বাস করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয়রা। তারা বলছেন, পুরান ঢাকাকে নতুন করে আবার মৃত্যুপুরী না বানাতে চাইলে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
Related News
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে সাড়ে ১১ ঘণ্টা পর ফেরি চলাচল শুরু
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ঘন কুয়াশার কারণে টানা সাড়ে ১১ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর ফেরিRead More
উদ্বোধনের অপেক্ষায় পার্বত্য অঞ্চলের প্রথম স্থলবন্দর
প্রেসওয়াচ রিপোর্টঃ খাগড়াছড়ির রামগড় এলাকায় পার্বত্য অঞ্চলের প্রথম স্থলবন্দরটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। এই স্থলবন্দরটি চালুRead More