রিশতার অপমৃত্যু ও মূল্যবোধহীন সমাজে বাংলার রক্তাক্ত যাত্রা  – ড. দিপু সিদ্দিকী

একদিন ছিল, যখন সম্পর্কের মাঝে ছিল শ্রদ্ধা, রক্তের না হলেও আত্মার এক অদৃশ্য বন্ধন। বাবার বন্ধু, খালার বান্ধবী, বড় বোনের সখী—প্রত্যেকেই ছিলেন একেকটি মর্যাদার প্রতীক। তাঁদের প্রতি সম্মান ছিল আত্মিক, গভীর ও পবিত্র। সমাজে তখন সম্পর্কের সংজ্ঞা ছিল স্বচ্ছ, নির্মল এবং বিশ্বাসভিত্তিক। দেহের নয়, চেতনাজুড়ে ছিল এক অন্যরকম মানবতা। অথচ আজ? সব যেন উল্টে গেছে।

 

আজ আমরা এক ভোগবাদী সমাজে বাস করছি, যেখানে স্বার্থপরতা, প্রবৃত্তির মোহ, আর অবসাদগ্রস্ত আত্মার তাড়নায় মূল্যবোধকে খুন করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্পর্ক আর পরিচয়ের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কেউ অপেক্ষা করে না, বরং লালসার খিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। স্নেহভাজন সম্পর্ককে ভাঙনের কলে চালিয়ে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের রক্তাক্ত অতীতের সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

 

প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে জ্ঞান, দিয়েছে আধুনিকতার হাতছানি। কিন্তু আমাদের আত্মা? সে তো যেন কেবল দেহসর্বস্বতায় বন্দি। এই জ্ঞান, এই সুযোগ, এই বিশ্বায়নের তরঙ্গে ভেসে নৈতিকতাকে কোথায় ফেলে এসেছি আমরা? প্রতিটি অগ্রগতি যেন তার পাশে জুড়ে নিয়েছে এক পশ্চাৎপদতা—একটি আত্মিক দেউলিয়াপনাকে।

 

আর এই নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত ছায়া পড়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে, তার নেতৃত্বে, তার তথাকথিত “মেধাবী” সমাজে। যিনি ধর্মের কথা বলেন, তিনি পেছনে বসে থাকে সম্পদের ভাগ বাটোয়ারায়; যিনি বিপ্লবের কথা বলেন, তিনিই চক্রান্তে ব্যস্ত; কেউ সাম্যের ডাক দেন, কেউ স্বাধীনতার নামে শোষণ বুনে দেন জাতির শরীরে। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু শাসনের ধরণ থেকে যায় একই; স্বৈরতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় একধরনের নির্লজ্জ পুনরাবৃত্তি।

 

সেই দৃশ্যচিত্রে বারবার রক্ত দেয় সাধারণ মানুষ। মা হারায় সন্তানকে, ভাই হারায় বোনকে। নূর হোসেন, ডা. মিলন, মুগ্ধ, আবু সাঈদ—তাদের মতো দামাল ছেলেরা বুক পেতে দেয় পরিবর্তনের আশায়। তারা স্বপ্ন দেখে একটি দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্রের। কিন্তু প্রতিবার তাদের স্বপ্ন ভেঙে পড়ে পা-তলার ধুলায়। শাসক আসে, শোষণ থেকে যায়। গণতন্ত্র নামে আসে স্বৈরাচার; পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি হয় প্রতারণার নতুন মুখোশ।

 

তাহলে প্রশ্ন উঠে—এত রক্ত, এত বিসর্জন, এত কান্না কি বৃথা? আমরা কি কেবল মায়ের নামে বক্তৃতা দিই, আর ভিতরে ভিতরে সেই মাকেই অপমান করি? আমাদের বাংলাদেশ তো আমাদের মা। সেই মাকে যারা ভালোবাসার ভান করে অপমান করে, তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন—তোমরা কি জানো, একটি মায়ের সম্ভ্রম কি?

আমরা চাই, এই ভ্রষ্টতার, এই শোষণের, এই চরিত্রহীনতার অবসান হোক। আমরা চাই, আমাদের সন্তানদের জন্য একটি এমন বাংলাদেশ, যেখানে সম্পর্কের মর্যাদা থাকবে, যেখানে রাষ্ট্রের মা-বাবা জাতির সন্তানের মতো আচরণ করবে, লালন করবে, শোষণ নয়।

আমরা তো কোন দলভুক্ত নই। আমরা কোন দলদাস নই। আমরা মুক্তবিহঙ্গের মতো বাঁচতে চাই। শান্তির পায়রা  হয়ে আকাশে উড়তে চাই। আমাদের আকাশ নির্মল করে দাও। না পারো দুঃখ নেই কিন্তু কলুষিত করো না। আমাদের আকাশ নীল করার ক্ষমতাও আমাদের আছে। আমরা বিচ্ছিন্ন। আমরা অসংগঠিত। তাই তোমাদের পানে চেয়ে স্বপ্ন দেখি। ব্যর্থ হলে বিচ্ছিন্নতার দেয়াল ভেদ করে সংঘটিত হব একাত্তরের মতোই।

 

তাই আজ, বারবার বলি—বাংলাদেশকে গণিকার হাতে তুলে দিও না। মায়ের শরীরে অন্ধ লোভের হাত রাখো না। রক্তে কেনা এই দেশকে ভালোবাসো সত্যিকারের ভালোবাসায়। তোমার ব্যক্তিগত চরিত্র যদি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েও থাকে, দেশমাতাকে অন্তত রক্ষা করো। তার সম্ভ্রম যেন আর কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে। তাহলেই, হয়তো এই শোক, এই হতাশা, এই দীর্ঘশ্বাস একদিন সুখের সোনালি প্রত্যুষে রূপ নেবে।

 

Share: