রক্তাক্ত সম্পর্ক ও বিপন্ন আত্মা: এক অনাহুত বাংলার দিনলিপি – ড. দিপু সিদ্দিকী

একটি সময় ছিল—

যখন রিশতা মানেই ছিল আত্মিক সম্পর্ক। খালার বান্ধবী

ড. দিপু সিদ্দিকী

ছিলেন মায়ের মতো, বড় বোনের বান্ধবী ছিলেন বোনেরই ছায়া। বাবার বন্ধুর সামনে দাঁড়াতে গিয়ে নিজের আচরণ সংযত করতো সন্তান, কারণ সম্পর্ক মানেই ছিল এক ধরণের আত্মসম্মান, সংযম, এবং সীমানার বোধ। সমাজে তখনো অনুপ্রবেশ করেনি লোভের বাণিজ্য, স্বার্থের বিনিময়ে আত্মার অবমূল্যায়ন হয়নি।

সে সময় মানুষ শিক্ষিত না হয়েও ছিল সুসংস্কৃত, অক্ষরজ্ঞানহীন হয়েও নৈতিকতায় পূর্ণ। মা মানে ছিল সম্মান, খালা মানে ছিল নির্ভরতা, প্রতিবেশী মানেই ছিল আত্মীয়তার প্রসারিত সীমানা। আজ সেই পৃথিবী কোথায়?

 

আজকের বাস্তবতা—

যেখানে সম্পর্ক হয় চাহিদার পণ্য, মূল্যবোধ হয় ব্যবহারের বস্তু। এখন আত্মীয়তাও বিকোয় মোবাইলের স্ক্রিনে, পরিচয় গড়ে ওঠে ইনবক্সে, ভালোবাসা মাপা হয় ইমোজিতে। রিশতা এখানে পণ্য, মানুষের হৃদয় যেন কেবল দেহের এক্সটেনশন। মেয়েটি খালার মেয়ে হোক কিংবা বন্ধুর বোন—প্রবৃত্তির কাছে সবাই সমান ভোগ্য।

 

তরুণ সমাজ আজ মূল্যবোধের পরিবর্তে খুঁজে ফিরছে দ্রুত আর্থিক সাফল্য, তা যে পথেই আসুক না কেন। সম্মান নয়, লাইক চায় তারা; আত্মিক বন্ধন নয়, এক্সপ্লোরেশন চায় তারা। আর এই সমাজই গড়ে তুলছে এক স্বার্থনির্ভর নেতৃত্ব, যাদের মুখে মূল্যবোধ, ভিতরে পুঁজিবাদের পচা শিকড়।

 

রাজনীতি ও প্রতারণার চক্রবিন্যাস—

পঞ্চাশ পেরোনো এই বাংলাদেশের ইতিহাস যেন পুনরাবৃত্তির জালে বন্দি। প্রতিটি শাসকগোষ্ঠী, একের পর এক, আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্যবহার করেছে আমাদের আবেগ, রক্ত, ভালোবাসাকে। শত শত দল গড়ার মহরত চলছে। এখন আর ব্যক্তি কেন্দ্রিক না হয়ে কিছু কিছু গোষ্ঠী দেশ সেবার নামে মানুষ এবার নামে ভিড় করছে নির্বাচন কমিশনে। দেশ সেবা ও মানব সেবার জন্য নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়া কি একমাত্র পথ? আমরা তো নিবন্ধিত অনেক দল দেখেছি? তারা কি পেরেছে? তবু কেন এত কষ্ট;এত কসরত? কি আছে রাজনীতির নামে শোষণকলায়? আমাদের দেশে এ পর্যন্ত আমজনতা যা পর্যবেক্ষণ করেছে তা হল- “রাজনীতিবিদের” (!) কাছে যেন ক্ষমতা মসনদই একমাত্র লক্ষ্য।যেখানে বসে তারা শাসনের নামে শোষণ করবে! আন্দোলন হয়, রক্ত ঝরে, স্বৈরাচার পতন হয়, এবং তারপর… আবার সেই একই কায়দা, সেই একই মুখোশ?

 

এ এক নির্মম বাস্তবতা—যেখানে গণতন্ত্র একটি শব্দমাত্র, জনগণ একটি পণ্য, আর দেশমাতাকে ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যম হিসেবে। যারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তারাই একদিন হয়ে ওঠে শোষক শ্রেণির অংশ। এই যে বিশ্বাসভঙ্গ, এই যে মায়ের সঙ্গে প্রতারণা—তা কেবল রাজনীতি নয়, তা এক জাতীয় আত্মঘাত।

 

বাংলাদেশ: মা নাকি গণিকা?

কথাগুলো কঠোর, কিন্তু বাস্তব। আমরা যখন মাকে রক্ষা করার নামে রাজপথে রক্ত দিই, তখন পেছনে কেউ সেই রক্ত দিয়ে আঁকে নিজের সিংহাসনের পথ। যে মা তার সন্তান হারায় যুদ্ধের জন্য, সেই মাকেই বানানো হয় রাজনৈতিক কবিতার চরিত্র, কাব্যিক কিন্তু অন্তঃসারশূন্য। মাকে পণ্য বানিয়ে, সম্ভ্রমহানির ছলে যারা পদলোলুপতা পূরণ করে—তাদেরকে ইতিহাসের আস্তা করে নিক্ষিপ্ত করার দৃষ্টান্ত না হলে, আমাদের ভবিষ্যৎ কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

 

স্বপ্নের পুনর্জাগরণ দরকার—

বাংলাদেশ কেবল একটি রাষ্ট্র নয়, এটি একটি অনুভব, একটি আত্মপরিচয়। এই দেশ শুধু ১৯৭১ এর রক্ত নয়, এটি আমাদের আত্মমর্যাদার ভিত্তি। এখন সময়—আবার সম্পর্ককে মর্যাদা দেওয়ার, আবার আত্মিক জগতকে জাগিয়ে তোলার। আমাদের দরকার একটি আত্ম-শুদ্ধি, ব্যক্তি চরিত্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নীতিনৈতিকতা পর্যন্ত।

 

আমরা চাই একটি বাংলাদেশ—

যেখানে মা মানে হবে নিরাপত্তা, ভাই মানে হবে আত্মত্যাগ, প্রতিবেশী মানে হবে নির্ভরতা। যেখানে সরকার মানে হবে সেবা, রাজনীতি মানে হবে গণমানুষের ভবিষ্যৎ রচনা। যেখানে রক্ত বৃথা যাবে না, বিশ্বাস বিক্রি হবে না, সম্পর্ক হবে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় আশ্রয়।

 

শেষকথা:

প্রতিটি জাতির পতনের পূর্বে মূল্যবোধের ভাঙন শুরু হয়। আমরা যেন সেই সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছি। এখনই সময় সম্পর্ক, সমাজ ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠন করার। নয়তো ইতিহাস আবার রক্ত চাইবে, আত্মত্যাগ চাইবে, আর সেই রক্তে লেখা হবে এক করুণ অপসংহার—যেখানে বাংলাদেশ থাকবে, কিন্তু মা থাকবে না। তা কি করে হয়?

 

 

Share: