সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে ভারতের মাটিতে পা রেখেছিল টাইগারবাহিনী। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের সঙ্গে জিতে ভালো কিছুর ইঙ্গিতও দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী চার ম্যাচে যেন নিজেদের ছায়া হয়েই থাকতে হলো বাংলাদেশকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের সঙ্গে আর পেরে উঠলো না বাংলাদেশ। কেবল মাহমুদউল্লাহ একাই লড়ে গেলেন। এবারের বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটার হিসেবে সেঞ্চুরি করে দলকে একটি সম্মানজনক হারে সহায়তা করেন এ ব্যাটার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৪৯ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজয় বরণ করে নেয় বাংলাদেশ।
প্রোটিয়া ব্যাটারদের ৩৮৩ রানের পাহাড়সম এই লক্ষ্য সামনে রেখে যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটাররা। একের পর এক ব্যাটার সাজঘরের পথ ধরছেন।
আগের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ফিফটি করেছিলেন তানজিদ হাসান তামিম। কিন্তু পরের ম্যাচেই সেই ব্যর্থতা। মার্কো জানসেনের শর্ট ডেলিভারিতে ব্যাট ছুঁইয়ে ফিরলেন ১৭ বলে ১২ করে। পরের বলে আরও এক উইকেট।
এবার নাজমুল হোসেন শান্ত লেগ সাইডে বেরিয়ে যাওয়া বলে ব্যাট ধরে দিলেন, এবার উইকেটরক্ষকের ক্যাচ। গোল্ডেন ডাকে (১ বলে ০) সাজঘরে শান্ত।
এরপর সাকিব আল হাসান প্রথম স্লিপে ক্যাচ দেন লিজার্ড উইলিয়ামসের বলে। ৪ বল খেলে ১ রান করেন টাইগার অধিনায়ক। মুশফিকুর রহিমের ওপর ভরসা ছিল।
কিন্তু মিস্টার ডিপেন্ডেবলখ্যাত এই ব্যাটারও বাজে শট খেলে উইকেট বিলিয়ে দিলেন। গেরাল্ট কোয়েতজের শর্ট আর ওয়াইড বলটিতে শট খেলে থার্ড ম্যানে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন মুশফিক। ১৭ বলে তার ব্যাট থেকে আসে ৮ রান।
সেট হলে ইনিংস বড় করতে হয়। বাংলাদেশি ব্যাটারদের জন্য যেন কোনো নিয়মই খাটে না। তারা অনেকে ক্রিজে গিয়েই উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসেন। কেউবা সেট হয়ে মনে করেন দায়িত্ব শেষ।
লিটন দাস যেমন সেট হয়ে ফিরলেন সাজঘরে। দলের বিপদে হাল ধরে ৫০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করলেন। কিন্তু ধীরগতির ইনিংস খেলেও বড় কিছু করতে পারলেন না লিটন। ৪৪ বলে ২২ রান করে হলেন কাগিসো রাবাদার বলে এলবিডব্লিউ। ৫৮ রানে পঞ্চম উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
এরপর মেহেদী হাসান মিরাজ ১৯ বলে ১১ রান করে কেশভ মহারাজকে উইকেট দিয়ে আসেন। এত সবার মাঝে কেবল একাই লড়াই করে গেলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ৭ম উইকেট জুটিতে নাসুমকে সঙ্গে নিয়ে ৪১ রানের জুটি গড়েন রিয়াদ। নাসুম কোয়েতজের বলে পুল শট খেলতে গিয়ে আউট হলে ক্রিজে আসেন হাসান মাহমুদ।
হাসানকে সঙ্গে নিয়ে আবার ৩৭ রানের জুটি গড়ে দলের সংগ্রহ একটি সম্মানজনক স্থানে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করতে থাকেন মাহমুদউল্লাহ। ৬৭ বলে চলতি বিশ্বকাপে নিজের প্রথম অর্ধশতকের দেখা পান রিয়াদ।
রিয়াদের অর্ধশতকের পর আবার উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসে অপর প্রান্তের ব্যাটাররা। ৩৭তম ওভারে রাবাদার বলে আউট হন হাসান। কিন্তু মুস্তাফিজকে নিয়ে আবার লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন রিয়াদ।
৯ম উইকেট জুটিতে মুস্তাফিজকে সঙ্গে নিয়ে ৬৮ রানের জুটি গড়েন মাহমুদউল্লাহ। বিশ্বকাপের আগে রিয়াদের দলে থাকা নিয়ে নানা রকম আলোচনা হলেও সেই রিয়াদই এবারের বিশ্বকাপে ধ্বংস্তূপে দাঁড়িয়ে সেঞ্চুরি তুলে নিলেন যা এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি।
আইসিসির ওয়ানডে টুর্নামেন্টে এটি রিয়াদের ৪র্থ সেঞ্চুরি। টপকে গেলেন সাকিব আল হাসানের তিন সেঞ্চুরির রেকর্ডকেও। সেঞ্চুরি করে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি রিয়াদ। ১১১ বলে ১১১ রান করে কোয়েতজের বলে লং অফে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ৪৬.৪ ওভারে ২৩৩ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ।
প্রোটিয়া বোলারদের হয়ে কোয়েতজে ৩টি, জানসেন ও রাবাদা ২টি করে উইকেট পান।
এর আগে ডেথ ওভারে প্রোটিয়া ব্যাটারদের ভয়ংকর রূপ দেখে সাকিব-মোস্তাফিজ-শরিফুলরা। ৩৮ ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার রান ছিল ৩ উইকেটে ২১৭। এরপর বাংলাদেশের বোলাররা কেবল দুটি ওভার দশের নিচে রান দিয়েছেন। একের পর এক বল সীমানার বাইরে আছড়ে ফেলেছেন ডি কক-ক্লাসেনরা।
শেষ ১০ ওভারে ১৪৪ রান তুলেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। কুইন্টন ডি কক তো বিধ্বংসী সেঞ্চুরি করেছেনই, শেষদিকে হেনরিখ ক্লাসেন সেঞ্চুরিবঞ্চিত হলেও যা ক্ষতি করার করে দিয়েছেন টাইগারদের। সবমিলিয়ে ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ৩৮২ রানে থেমেছে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক এইডেন মার্করাম। দ্বিতীয় ওভারের পঞ্চম বলেই ক্যাচ দিয়েছিলেন রিজা হেনড্রিকস। দক্ষিণ আফ্রিকান ওপেনারকে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ।
কিন্তু প্রথম স্লিপে দাঁড়ানো তানজিদ হাসান তামিম বলটিকে হাতের তালুতে জমিয়ে রাখতে পারেননি। যার ফলে শুরুতেই ব্রেক থ্রু পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ।
অবশ্য ব্রেক থ্রু আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি না। সপ্তম ওভারের প্রথম বলেই সেই একই ব্যাটার রিজা হেনড্রিকসকে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে বোল্ড করেন পেসার শরিফুল ইসলাম। শরিফুলের ফুল লেন্থের বল ড্রাইভ করতে চেয়েছিলেন রিজা। কিন্তু বলের গতি মিস করেন তিনি। সোজা গিয়ে স্ট্যাম্পে আঘাত হানে সেটি।
দলীয় ৩৩ রানে প্রথম উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। রিজা হেনড্রিকসের উইকেট নিয়ে শরিফুল যে ড্যান্স দিলেন, তা নিশ্চিত চোখে লেগে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের।
দ্বিতীয় উইকেট পেতেও খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি টাইগারদের। অষ্টম ওভারের পঞ্চম বলে এবার এলবিডব্লিউর শিকার হন আরেক মারকুটে প্রোটিয়া ব্যাটার রসি ফন ডার ডুসেন। মিরাজের স্ট্রেইট বল মিস করেন ডার ডুসেন। বল সোজা আঘাত হানে প্যাডে। জোরালো আবেদনে সাড়া দেন আম্পায়ার। ৩৬ রানে পড়ে দ্বিতীয় উইকেট।
তবে সেখান থেকে কুইন্টন ডি কক আর এইডেন মার্করাম গড়ে দেন শতরানের জুটি। এই জুটি ক্রমেই বড় হচ্ছিল। অবশেষে ১৩৭ বলে গড়া ১৩১ রানের বড় জুটিটি ভাঙেন টাইগার অধিনায়ক সাকিব আল হাসান।
মার্করাম লংঅনে তুলে মারতে গিয়েছিলেন সাকিবকে। লিটন দাস নেন সহজ ক্যাচ। ৬৯ বলে ৭ বাউন্ডারিতে ৬০ রান করে সাজঘরে ফেরেন প্রোটিয়া অধিনায়ক।
তবে ডি কককে আটকানো যায়নি। এবারের বিশ্বকাপে প্রোটিয়াদের পঞ্চম ম্যাচে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি তুলে নেন মারকুটে এই ওপেনার, ১০১ বলে। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের যেটি ডি ককের ২০তম সেঞ্চুরি।
এই ডি কক একাই বলতে গেলে যা করার করে দিয়েছেন। খেলেছেন ১৪০ বলে ১৭৪ রানের ইনিংস। ১৫ বাউন্ডারি আর ৭ ছক্কায় সাজানো তার বিধ্বংসী ইনিংসটি শেষ পর্যন্ত থামিয়েছেন হাসান মাহমুদ। ডিপ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট বাউন্ডারিতে ক্যাচ ধরেছেন নাসুম আহমেদ।
এরপর তাণ্ডব শুরু হয় ক্লাসেনের। চারের চেয়ে ছক্কা মারার দিকেই বেশি মনোযোগ রাখেন প্রোটিয়া এই ব্যাটার। এমন বিধ্বংসী ব্যাটিংই করেছেন, তার সেঞ্চুরির সুযোগও তৈরি হয়েছিল। ইনিংসের ৪ বল বাকি থাকতে হাসান মাহমুদের বলে মাহমুদ্উল্লাহকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ক্লাসেন।
তবে যা করার করে ফেলেছেন ততক্ষণে। ৪৯ বলে ৯০ রানের ইনিংসে ২টি চারের সঙ্গে ৮টি ছক্কা হাঁকান ক্লাসেন। শেষদিকে ১৫ বলে ১ চার আর ৪ ছক্কায় অপরাজিত ৩৪ আসে ডেভিড মিলারের ব্যাট থেকে।