রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধন করবেন। ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সড়ক ও রেল সেতু কেবল একটি মেগা প্রকল্প নয়, পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনও ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রতিপক্ষ। তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে, নৈতিক সমর্থন দিয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে অর্থ ও কারিগরি সহায়তা চেয়েছিলেন এবং সেটা মিলেছিল। আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ জোগাতে অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংক চেয়েছে সেতু নির্মাণের কাজ তদারক এবং অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি তাদের হাতে দিতে হবে। বাংলাদেশ তাতে রাজি হচ্ছিল না। এ নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত।
এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ তোলে-পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে দুর্নীতি হয়েছে। বাংলাদেশ বলে দেয়, এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কোনো অর্থ ছাড় হয়নি। অন্য কেউ অর্থ দেয়নি। দুর্নীতি হবে কীভাবে? এ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক বলে, দুর্নীতি করার গভীর ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এ বক্তব্যের সূত্র ধরে বাংলাদেশের একটি মহল প্রচার করতে থাকে, অন্যরা তো আছেই। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের কোনো কোনো সদস্যও ‘পদ্মা সেতু থেকে অর্থ লুটপাটের সঙ্গে জড়িত’ এমনও বলা হতে থাকে। এ নিয়ে জলঘোলা হতে থাকে। সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা নদীতে একটি ফেরিতে চুক্তি সই হয় আনন্দঘন পরিবেশে। হঠাৎ করেই বিশ্বব্যাংকের কী মতি হলো! তারা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ না করেই ২০১২ সালের ২৯ জুন চুক্তি বাতিল করে দেয়। বাংলাদেশের সব পত্রিকায় শীর্ষ সংবাদ হয়, দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণচুক্তি বাতিল করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সমানে অপপ্রচার চলতে থাকে সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমান এবং যোগাযোগ সচিবসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে। সে সময়ে কয়েকটি সংবাদপত্রে এমন একটি ‘রব’ তোলা হয়, যাতে জনমনে ধারণা সৃষ্টি হয়, নিশ্চিতভাবেই দুর্নীতি হয়েছে।
শেখ হাসিনা যতই বলুন, কোনো দুর্নীতি হয়নি, সেটা বিশ্বাস করার মতো যেন কেউ ছিল না। বিশ্বব্যাংকের কথাই যেন শেষ কথা। বিশ্বব্যাংক বলে দেয়, ক. উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি হয়েছে। এ জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। খ. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্যানেল গঠন করবে। তাদের হাতে বাংলাদেশে অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত সব তথ্য প্রদান করতে হবে। এ প্যানেলের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই বিশ্বব্যাংক এবং অন্য অর্থ জোগানদাতারা পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজের প্রথম বিডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
বিশ্বব্যাংকের এ ঔদ্ধত্যের কাছে নতিস্বীকার করলে ৩০ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর রক্তে অর্জিত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু থাকে কি? অথচ বাংলাদেশেরই একটি মহল বিশ্বব্যাংকের সব অভিযোগকে সত্য ধরে নিয়েছিল এবং তাদের কথা অনুযায়ী চলতে শেখ হাসিনার কাছ দাবি জানিয়েছিল।
অথচ আমরা কে না জানি যে বিশ্বব্যাংক শুধু নিজের ঋণ বাতিল করেনি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (৬১.৫০ কোটি ডলার), জাপানের জাইকা (৪৩ কোটি ডলার) এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংককেও (১৪ কোটি ডলার) প্রতিশ্রুত ঋণ প্রদান না করতে প্ররোচনা দিয়ে সফল হয়। সে সময়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ মিশন প্রধান এলেন গোল্ড স্টেইন ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় বলেছিলেন, ভবিষ্যতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ পেতে বাংলাদেশকে অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার তো করতেই হবে, এমনকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্ধারিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে ও কোন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়েও প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
কথায় বলে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। বাংলাদেশে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি নির্মূলের জন্য কাজ করছে। জনমত গঠনে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। তাদের অর্থের জোগান আসে প্রধানত বাংলাদেশের বাইরে থেকে। এখন থেকে ১৮ বছর আগে ২০০৪ সালে এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক পদে ‘নির্বাচিত’ হন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির যে অভিযোগ বিশ্বব্যাংক এনেছে, তা সঠিক বলে মনে করেন। বিশ্বব্যাংকের অন্যায় সিদ্ধান্তের তিন দিন পর ২ জুলাই তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পর Ôthe challenge that the government faces today is deeply regrettable, embarrassing and disappointing. তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়ে অন্য সূত্র থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থ সংগ্রহের যে ঘোষণা দিয়েছেন তার উদ্দেশ্য সেতু নির্মাণ নয়, বরং জনগণের দৃষ্টি দুর্নীতি থেকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। ওই সময়ে তিনি এক টেলিভিশন টক শোতে প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি করা হলে দুদকের অসুবিধা কোথায়?
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বিশ্বব্যাংক ঠিক কাজ করেছে। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দুর্নীতি ও অর্থ তছরূপের তদন্ত করে শাস্তি দিতে হবে।’
এ নিবন্ধে বিএনপি চেয়ারপারসন বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর থেকে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের দাবি জানান।
খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে পদ্মা সেতু হবে না। তারা পদ্মা সেতু বানাতে পারবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না।’
দলীয় প্রধানের অবস্থান সমর্থন করে ১১ জানুয়ারি (২০১৮) মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনে তৈরি হচ্ছে। এটা টিকবে না। আমাদের চেয়ারপারসন ভুল কিছু বলেননি।’
পদ্মা সেতু নির্মিত হয়ে যখন উদ্বোধনের ক্ষণগণনা পর্যায়ে রয়েছে, যখন ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন সড়ক দেখার জন্য প্রতিদিন অগণিত নারী-পুরুষ ভিড় জমাচ্ছে, তখন বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। জনগণের পকেটের টাকায়, ট্যাক্সের টাকায় এ সেতু নির্মিত হয়েছে। এ সেতু নির্মাণ সরকারের কোনো কৃতিত্ব নয়। কেউ এটা বাপের ঘরের টাকা দিয়ে করেনি। [প্রথম আলো, ২৪ মে, ২০২২]
বিএনপি মহাসচিবের কাছে এমন তথ্য কী রয়েছে যে পদ্মা সেতুর ডিজাইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে? যদি একই ডিজাইনে সেতুটি নির্মিত হয়ে থাকে, তাহলে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে খালেদা জিয়া ‘জোড়াতালি দিয়ে সেতু বানানোর’ যে অভিযোগ করেছিলেন এবং তার সমর্থনে মির্জা ফকরুল ইসলাম যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তা সঠিক ছিল না। এটা স্বীকার করে নেওয়ার সৎ সাহস কি বিএনপি নেতাদের রয়েছে?
বিএনপির মহাসচিব যথার্থ বলেছেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক যখন ভিত্তিহীন দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল, তখন বাংলাদেশের কিছু লোক তাতে সায় দিয়েছিল। কিন্তু মহাকালের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সড়ক ও রেলপথে সরাসরি যোগাযোগ সৃষ্টি করতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছিলেন দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।
তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের জনগণই অর্থের জোগান দেবে। আমাদের বাজেটের আকার এখন অনেক বড়। অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজস্ব আদায় বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে। সেতু নির্মাণের প্রয়োজনে যে সব পণ্য আমদানি এবং বিদেশের দক্ষ কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে যে বিদেশি মুদ্রা ব্যয় হবে তার জোগান দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো সমস্যা হবে না।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে ভুল করেছিল এবং সেটা তারা স্বীকার করে নিয়েছে। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড. কৌশিক বসু ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের যে ইতিহাস, তাতে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে যথেষ্ট তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থে কাজ করেছে। ১০ বছর আগেও কেউ ভাবতে পারেনি বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থে এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে। বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরতা ছাড়াই তারা এটা করতে পারছে।’
বিশ্বব্যাংক ভুল স্বীকার করতে পারলে বাংলাদেশে যারা তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল, তাদের সেটা করতে সমস্যা কোথায়? বিশ্বব্যাংকের ভুল স্বীকারের বছর দুয়েক পর কানাডার একটি আদালত জানায়, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হতে পারে বলে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার প্রমাণ মেলেনি। ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ‘কানাডার সংশ্লিষ্ট আদলতের রায়ে বিচারক লিখেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে তথ্য উপস্থাপনা করা হয়েছিল তা জল্পনা, গুজব আর জনশ্রুতি ছাড়া কিছু নয়। গালগল্প দিয়ে দুর্নীতির মামলা হয় না।’
পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে শিল্পায়ন ঘটবে, কৃষি উন্নত হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে। ঢাকা থেকে বরিশাল-খুলনা-যাশোর অঞ্চলের জেলাগুলোর দূরত্ব সড়ক পথে কমবেশি ১০০ কিলোমিটার করবে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে উঠবে, ‘বাংলাদেশ পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেরেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পারলেন।’ প্রমত্তা পদ্মার বুকে বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক হয়ে থাকবে পদ্মা সেতু। বাংলাদেশ যে উন্নত বিশ্বের সারিতে যোগ্য আসন করে নিতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ, এ সেতু তারও প্রতীক। প্রকৃতই পদ্মা সেতু একটি চেতনার নাম।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক