পুঠিয়া রাজবাড়ি এবং মন্দির – লীলা মজুমদার

আমি যখনই কোথাও ঘুরতে যাই – সেই জায়গার যা দেখে মুগ্ধ হই, আপন মনে লিখে রাখি । রাজশাহী থেকে ঢাকা ফেরার পথে আমি, ড প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার এবং  ড মাজেদা খাতুন (আমাদের ভাবি) পুঠিয়া রাজবাড়ি যাই ।পুরো রাজবাড়ী ঘুরে ঘুরে দেখি, আর তখনই মনে হয় – দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া। সোনার এই বাংলাদেশের আনাচে কানাচে কত যে দর্শণীয় স্থান আর প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শণ দেখতে পাওয়া যায় সে শুধু এই দেশ ঘুড়ে ঘুড়ে দেখলেই বোঝা যায়। তেমনি পুঠিয়া রাজ বাড়ী সেই নিদর্শনের একটা অংশ। বাংলার বার ভূঁইয়াদের এক ভূঁইয়া রাজা রামচন্দ্র ঠাকুরের এই স্থান হচ্ছে পুঠিয়া। বৎসাচার্য্য নামে জনৈক সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ পুঠিয়ায় একটি আশ্রম গড়ে তোলে। সেখানে তিনি ভগবত উপাসনা করতেন। কিছুদিনের মধ্যেই সেই আশ্রমে অনেক ভক্তের সমাগম হয়।

ঐ সময়ে বাংলার রাজস্ব যারা সংগ্রহ করে সম্রাটের কোষাগারে প্রেরন করতেন, তারা কোন এক সময় রাজস্ব প্রেরন বন্ধ করে দেয়ায় সম্রাট তাদেরকে দমন করার জন্য সেনাপতি সহ সৈন্য প্রেরন করেন। তৎকালীন যুগে এই সকল সেনা বাহিনীকে লস্কর  নামে অভিহিত করা হত। এই লস্কর বাহিনী বিদ্রোহ কারীদের দমন করে সেখানে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করায় তাদের নামানুসারে ঐ স্থানের নাম করন করা হয় লস্করপুর পরগনা।

পরবর্তীতে বৎসাচার্য্য লস্করপুর পরগনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। বৎসাচার্য্যের উত্তরাধিকারী গন বংশ পরম্পরায় জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন এবং লস্করপুর পরগনার নাম করন করা হয় পুঠিয়া। বৎসাচার্য্যের অনেক পরে উনবিংশ শতকে পুঠিয়ার জমিদারী উত্তরাধিকারীদের মধ্যে পাঁচ আনী, চার আনী, সারে তিন আনী, আড়াই আনী এবং এক আনী ভাগে অধিকার অনুযায়ী বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক অংশের অংশীদার গন রাজা এবং রানী উপাধিতে জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে পাঁচ আনীর রাজা ছিলেন তিন জন। রাজা অমিয় নারায়ন সান্যাল, রাজা নিখিল নারায়ন সান্যাল এবং রাজা শচীন্দ্র মোহন সান্যাল। এক আনীর রাজা নিরেন্দ্র নারায়ন সান্যাল এবং রাজা বিমল নারায়ন সান্যাল এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। চার আনী রাজ্যের রাজা নরেশ নারায়ন রায় এর নাম এবং ছবি পাওযা গেলেও সারে তিন আনী আর আড়াই আনীর রাজাদের নাম পাওয়া যায়নি।

পুঠিয়া রাজাদের কীর্তি চিহ্ন ও স্থাপত্যের মধ্যে এক অনন্য নিদর্শন বিভিন্ন মন্দির। মন্দির সহ রাজবাড়ীর চার পাশে অনেক বড় পরীখা তৈরী করা আছে। এই পরীখা রাজবাড়ীর সৌন্দর্য এবং নিরাপত্তার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করতো। পরীখার প্রধান সৌন্দর্য ছিল লাল পদ্ম। মহারানী ভূবন ময়ী দেবী এই লাল পদ্ম কুচ বিহার থেকে আনিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্ত্তীতে লাল পদ্ম অধিক হারে বংশ বৃদ্ধি না করায় মহারানী মনে কষ্ট পান এবং অনেক খোজা খুজির পর শ্রীহট্ট (সিলেত) থেকে অধিক বংশ বিস্তার সম্পন্ন লাল পদ্ম সংগ্রহ করিয়ে নেন। যদিও এখন কচুরি পানা হয়ে সৌন্দর্যের অনেক অবনতি হয়েছে। প্রধান ফটকের দুই পাশে পরীখার শেওলা জলে কিছু লাল পদ্ম এখনও বিদ্যমান। পুরো রাজবাড়ী ঘুরে ঘুরে দেখলে বোঝা যায় কতো অনাদর আর অবহেলা ঘিরে আছে পুরো এলাকাতে।

পুঠিয়া মৌজায় অবস্থিত ১৬টি মন্দিরের মধ্যে ১৫টি মন্দির নির্মান করা হয়েছিল ১৮১০ খৃষ্টাব্দ হতে ১৮৪০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে। বাকী একটি মন্দিরের নির্মানকাল এখন পর্যন্তও জানা যায়নি। তবে এই মন্দির গুলোর মধ্যে ৯টি মন্দির বর্তমানে চলমান আছে। ৪টি মন্দির ধংশ স্তুপে পরিনত হয়েছে। আর ১টি মন্দির সম্পুর্ন ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চলমান মন্দিরের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ যোগ্য এই শিব মন্দির। এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮২৫ সনে। তৎকালীন পুঠিয়ার পাঁচ আনীর মহারানী ভূবন ময়ী দেবী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় একটি মাএ কক্ষ এবং চারপাশে দুই স্তরে বাড়ান্দা আছে। বারান্দার দেয়ালে হিন্দু পৌরানিক কাহিনীর ১৪টি চিএ বিদ্যমান। মন্দিরের কক্ষটিতে অধিষ্ঠিত আছে কষ্টি পাথরের নক্সা করা বিশাল শিব লিঙ্গ। মন্দিরের ধবধবে সাদা কক্ষে ছয় ফুট উচ্চতা এবং দুই ফুট ব্যাসার্ধেŸর মিচমিচে কালো রং এর এই শিব লিঙ্গ চোঁখ আর মন দুইকেই অবাক করে তোলে।

১৯৭১ সনের ২২ এপ্রিল পাক বাহিনী মন্দিরের দড়জা ভেঙ্গে মুল কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গ বিগ্রহ উৎপাটিত করে ক্ষত বিক্ষত করে এবং মন্দিরের অসংখ্য ছোট ছোট রত্ন ও শীর্ষ রত্ন খোচিত পাঁচটি ত্রিশূল সহ অস্থাবর সম্পদ লুঠ করে। এমন কি মন্দিরের বাড়ান্দার মেঝেতে পাতা পাথরের টুকরো গুলোও নিয়ে যায়। ১৯৭৪ সনে পুঠিয়ার বিভিন্ন মন্দির গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অধিগ্রহন করেন এবং কোন কোন মন্দিরের কিছু কিছু অংশ সংস্কার করেন । কিন্তু শিবলিঙ্গ বিগ্রহ উৎপাটিত অবস্থায় পরে থাকে। ১৯৮৯ সনে আড়ানীর পাগলা বাবা শিবলিঙ্গ মন্দিরে পূনরায় স্থাপন করে। সেই থেকে প্রতি বছর শ্রাবন মাসের শেষ সোমবার নগ্ন পায়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিগ্রহে গঙ্গাজল অর্পন করা হয়। রাজাদের কীর্তি চিহ্ন ও স্থাপত্যের নিদর্শন টিকিয়ে রাখার জন্য পুরো এলাকাবাসী সম্মিলিত ভাবে সহযোগিতা করে আসছেন।

এই শিব মন্দির সংলগ্ন ঠিক পূর্ব পাশে এক রত্ন বিশিষ্ট দ্বিতল মন্দিরের নিচতলায় পূঁজার জন্য ব্যবহার করা হত। রথ যাত্রার দিন শ্রী রাধা, শ্রী গোপাল এবং শ্রী গোবিন্দ রথে চড়ে শোভাযাত্রা সহকারে এ মন্দিরে আসতেন। আর উল্টো রথের পূর্ব দিন পর্যন্ত অবস্থান করে আবার রথে চড়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করতেন। মাঝের আট দিন এই এক রত্ন মন্দিরেই পূঁজা অর্চনা হত।

দিনাজপুর কান্তজীর মান্দরের পরে প্রায় পৌনে দুশো বছরের প্রাচীন পুঠিয়া পাঁচ আনীর গোবিন্দ মন্দির বাংলাদেশের বৃহত্তম টেরা কোটা অলংকৃত মন্দির। প্রতিটি টেরা কোটায় হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর চিত্রকর্ম অত্যন্ত সৌন্দয্যপূর্ন এবং আকর্ষনীয় ভাবে বিদ্যমান। পাঁচ আনী রাজবাড়ীর পূর্বমধ্য ভাগে এই মন্দির অবস্থিত। এই মন্দির পঞ্চ রত্ন বিশিষ্ট মন্দির। মন্দিরের রত্ন বিশিষ্ট চূড়ার প্রত্যেকটাতে একটি করে চক্র আছে। মন্দিরের অভ্যন্তরে একটি মাত্র কক্ষ আছে। সেখানে কাঠের চৌদোলার মধ্যে শ্রী রাধা, শ্রী গোপাল শ্রী গোবিন্দ এবং শ্রী গৌর শ্রী নিতাই এর অবয়ব স্থাপিত। মহারানী ভূবন ময়ী দেবীর সময়ে প্রতিদিন তিন প্রহরেই পূঁজা অর্চ্চনা এবং ভোগ বিতরন করা হত। সেই প্রথা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। আমরাও সেই ভোগের প্রসাদের অস্বাদন লাভ করেছিলাম। মন্দিরের সামনে বিশাল আঙ্গিনার তিন পাশে তিনটি মন্দির আছে। যদিও মন্দির গুলো ভগ্নস্তুপ পর্যায়ের অন্তর্ভূক্ত। প্রাচীন এই ঐতিহ্যবাহী নিদর্শণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংস্কার করা অতি প্রয়োজন।   Puthia Rajbari Shib Mondir

Share: