চাঁদপুরের ইলিশ মানেই নদীর নয়!মাছবাজার এখন সাগরের ইলিশে সয়লাব

চাঁদপুরের আড়তে নামানো হয়েছে ইলিশ।

স্বাদ যদি হয় প্রধান বিবেচনা তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। চেনা স্বাদ মুখে লেগে থাকা কোনও বাংলাদেশির এ কথায় আপত্তি না হওয়ারই কথা। সুদূর সাগর থেকে নোনা ঝরাতে ঝরাতে উজানে সাঁতরে আসে যে ইলিশের ঝাঁক―পায়রা, তেঁতুলিয়াসহ সাগরবর্তী নদীগুলোতে জেলেদের ফাঁদ এড়িয়ে গভীর মেঘনা দিয়ে চাঁদপুরে এসে যদি নাইতে পারে পদ্মা―তো আকারে সে লম্বাটে থেকে গোলাকার হবেই আর শরীরে বহন করবে অমৃত স্বাদ। এমন ইলিশ চেনেন না আর পেলে নির্দ্বিধায় কেনেন না এমন ক্রেতা কমই আছে দেশে। জগৎজুড়ে খ্যাতি যে পদ্মার ইলিশের, সেই পদ্মার শুরুই যে এখান থেকে! তবে এ বছরে যেন সবকিছুতেই ফাঁকি! চাঁদপুরের আড়তগুলোতে ক’দিন ধরে নিয়মিত আসছে দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ ইলিশ। তবে চাঁদপুরেই ‘লোকাল’ ইলিশ যেন নেই। তাই হাপিত্যেশ সবার! মন ভরছে না জেলে, আড়তদার, ক্রেতা-বিক্রেতা কারও।

সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, চাঁদপুরের সব মাছবাজার এখন সাগরের ইলিশে সয়লাব। বিশেষ করে দেশের ইলিশের সবচেয়ে বড় বাজার চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছবাজার এসব ইলিশে ভরপুর। প্রতিদিন বড় বড় ফিশিং বোট এবং ট্রাকযোগে এখানে আসছে হাজার হাজার মণ ইলিশ।

চাঁদপুরের আড়তগুলো এখন ইলিশে ভর্তি। তবে এর পাঁচ ভাগের চার ভাগই সাগরে ধরা পড়া। (ছবি: প্রতিনিধি)

তবে এর ভিড়ে নদীর ইলিশ যেন সোনার হরিণ। গড়ে প্রতিদিন মোট আমদানির এক পঞ্চমাংশ বা তারও কম মিলছে ‘লোকাল’ ইলিশ। আড়তে ডাকা ‘লোকাল’ মানে হচ্ছে চাঁদপুরের পদ্মা বা মেঘনার বা অন্য নদীর ইলিশ। আড়তের কাউকে চিনিয়ে দিতে হয় না ‘লোকাল’―মাছের আকার নিজেই বলে দেয় সে ধরা পড়ার সময় কোথায় ছিল। এসব মাছের দামও বেশি, চাহিদাও বেশি।

ফলে এই মাছবাজার থেকে দেশের যেকোনও এলাকায় মাছ কিনে নিয়ে গিয়ে বিক্রেতা যখন বলছেন, চাঁদপুর থেকে আনা ইলিশ তিনি সত্যিই বলছেন। তবে চাঁদপুর থেকে আনা ইলিশ মানেই নদীর অর্থাৎ পদ্মা বা মেঘনার―এটা তিনি তার কাছে থাকা সব মাছের ক্ষেত্রে বললেও এ বছর বিশ্বাস করার উপায় নেই। গোলাকার মানে নদীর আর লম্বাটে মানে সাগর বা সাগরবর্তী নদীর―প্রচলিত এই পদ্ধতিতেই আস্থা রেখে নিজ সিদ্ধান্তে বাজার থেকে ইলিশ কেনার ওপরে আড়তদাররাও পরামর্শ দিচ্ছেন। আর তারা জানাচ্ছেন, এ মৌসুমে এখন অবধি নদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে কম। বাজারে দেখতে পাওয়া পাঁচ ভাগ ইলিশের চার ভাগই সাগরের বা সাগর সংলগ্ন নদীর মাছ। আর ‘লোকাল’ বা নদীর ইলিশ বেশি দামেই আড়তে কেনা হয়, পাইকারিতেও বেশি দামে বিক্রি হয়। ফলে ক্রেতা হিসেবে বেশি দাম দিয়েই কিনতে হবে আপনাকেও।

চাঁদপুর মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পেশাগতভাবেও মৎস্যজীবী মানিক দেওয়ান বলেন, মতলবের ষাটনল থেকে হাইমচরের চরভৈরবীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার নদীতে ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে কম। বাজারে যেসব মাছ দেখা যাচ্ছে তার প্রায় সবই সাগরের মাছ।

চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছবাজারের কয়েকটি আড়ত ঘুরে জানা গেলো, সরবরাহ বাড়ায় গত মাসের তুলনায় ইলিশের দাম কিছুটা কম। তবে গত দু’ দিন ধরে সরবরাহ কিছুটা কম হওয়ায় দাম আবারও বাড়তির দিকে। গত তিন দিনের তুলনায় মঙ্গলবার (৮ সেপ্টেম্বর) এ বাজারে গড়ে প্রতি কেজি ইলিশের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

বড়স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, নদীপাড়ে সাগর থেকে ইলিশ নিয়ে আসা কয়েকটি ফিশিং বোট থেকে আনলোড করা হচ্ছে মাছ। ইলিশ আসছে ট্রাকযোগেও। মাছের আমদানি বাড়ায় ব্যস্ততা বেড়েছে ব্যবসায়ী এবং শ্রমিকদের। ঢাকা, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর প্রতিদিন ইলিশের এ বাজার।

চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছবাজারের ব্যবসায়ী সাগর হোসেন বলেন, ‘‘গত দু’দিন আগে মাছের আমদানি (সরবরাহ) বেশি ছিল। তবে এখনও আমদানি ভালো আছে। আজও এখানে হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলাসহ সাগর অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩টি ফিশিং বোট এবং গাড়িযোগে প্রায় ২ হাজার মণ ইলিশ আমদানি হয়েছে। তবে সবই সাগরের আর সাগরপাড়ের নদীতে ধরা মাছ। পদ্মা-মেঘনায় ধরা ‘লোকাল’ মাছের আমদানি কম।’’

দামদর জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেড় কেজি সাইজের ইলিশ প্রতি মণ ৫০ হাজার, এক কেজি সাইজের প্রতি মণ ৩৪ হাজার, ৮০০-৯০০ গ্রামের মণ ৩০ হাজার টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের প্রতি মণ ১৯ হাজার টাকা। তিনি জানান, গত দু’দিনের ব্যবধানে গড়ে প্রতি কেজি ইলিশের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। এছাড়া লোকাল মাছ তাজা ও স্বাদ বেশি হওয়ায় সাগরের ইলিশের চেয়ে লোকাল মাছের দাম কেজি প্রতি প্রায় ১শ’ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়।

এদিকে ইলিশের বাড়িখ্যাত চাঁদপুরে মাছ কিনতে আসা ঢাকার আব্দুল আউয়াল বলেন, আমরা অনেকেই মনে করি চাঁদপুরে মাছের দাম কম হবে। এ ধারণা থেকেই এখানে ইলিশ কিনতে আসি। কিন্তু তুলনা করে দেখলাম ঢাকার বাজারের চেয়ে এখানে ইলিশের দাম কম না। বরং কিছুটা বেশি মনে হচ্ছে।

স্থানীয় ক্রেতা খোকন কর্মকার বলেন, চাঁদপুরের ইলিশ খুবই প্রসিদ্ধ। এখানের ইলিশ খুবই সুস্বাদু। অন্য সময়ের তুলনায় এখন চাঁদপুরে ইলিশের দাম কিছুটা কমেছে। আমি এক কেজি সাইজের ইলিশ কিনেছি ৮শ’ টাকা দরে।

চাঁদপুর বড়স্টেশন মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির পরিচালক আব্দুর রহমান খান সুমন বলেন, মাছের আমদানি সব সময় হয় না। চারদিন আগে মাছের আমদানি বেশি ছিল। কিন্তু এখন একটু কম। এ কারণে মাছের দামও একটু বেড়েছে। তিনি বলেন, গত পরশু এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি করেছি ৬৫০-৭০০ টাকা। এখন এ মাছটিই বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা। আবার কয়েকদিন পর মাছের আমদানি বাড়লে তখন হয়তো দাম কমবে।

তিনি জানান, ‘‘আজও এ বাজারে দেড় হাজার মণ ইলিশ আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে চাঁদপুরে ‘লোকাল’ আমদানি হয়েছে প্রায় ৩০০ মণ। এসব মাছের একটি অংশ ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাপ্লাই করা হয়।’’

চাঁদপুর সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সুদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘মাছের আমদানি বেড়েছে, এটি জেলে, মৎস্যজীবী, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের জন্য ভালো খবর। আমরা আশা করি, মা ইলিশ সংরক্ষণে মাছ ধরার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আসছে তার আগেই ইলিশের আমদানি আরও বাড়বে।’

Share: