ডলার ছিনতাইয়ে ভয়ঙ্কর খুনি চক্র

ঢাকা ,১৬ আগস্ট,২০২০/ডেইলি প্রেসওয়াচঃদি ফ্যাশন বায়িং হাউজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. সুলতান হোসেন (৪৬)। তার কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার আছে ভেবে মতিঝিল থেকে তাকে অনুসরণ করে র‌্যাব পরিচয়ে সংঘবদ্ধ একটি ডাকাত চক্র। গত ১৪ জুলাই তারা প্রথমে বাসে অনুসরণ করে সুলতানকে। মিরপুরের পল্লবীতে নামার পরই তাকে ওই চক্রের কয়েকজন র‌্যাব পরিচয় দিয়ে ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্সে ওঠায়। চেঁচামেচি করায় গামছা দিয়ে সুলতানের গলা পেচিয়ে ধরা হয় এবং পেছন থেকে তার হাত চেপে ধরা হয়। এ অবস্থায় চলন্ত গাড়িতেই শ্বাসরোধে মারা যান সুলতান।

তার মৃত্যুর পর ছিনতাইকারী পুরো টিমসহ গাড়িটি গাবতলী-হেমায়েতপুর-সাভার হয়ে নবীনগর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে ড্রাইভার ছাড়া পুরো টিম নেমে পালিয়ে যায়। ড্রাইভার সুমনও সিংগাইর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অদূরে রাস্তার পাশে জঙ্গলে সুলতানের লাশটি ফেলে পালিয়ে যায়। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় মোট ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ।গুলশান গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, ওই হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার ব্যক্তিরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি বাহিনীর ভুয়া পরিচয়ের আড়ালে সংঘবদ্ধ ছিনতাই চক্রের সদস্য। তারা দীর্ঘদিন যাবত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হুন্ডির ব্যবসায়ী, বেশি ডলার ভাঙায় কিংবা যারা মতিঝিলের ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকার লেনদেন করে, এমন লোকদের টার্গেট করে। পরে তাদের অনুসরণ করে সুবিধাজনক স্থানে গিয়ে র‌্যাব পরিচয়ে গাড়িতে উঠিয়ে হাত-পা বেঁধে মারধর করে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে নগদ অর্থসহ যাবতীয় মালামাল ছিনিয়ে নেয়।

এ ব্যাপারে গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, গত ১৪ জুলাই বায়িং হাউজ কর্মকর্তা সুলতান অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে আর ফিরে না আসায় তার ভাই আবুল হোসেন গত ১৫ জুলাই তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

একদিন পর ১৬ জুলাই মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অদূরে মহাসড়কের ঢালে ঝোপঝাড়ের ভেতর একটি অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ পাওয়া যায়। পরে সুলতানের আত্মীয়-স্বজন সেখানে গিয়ে তার মরদেহ শনাক্ত করেন।

গামছা পেঁচিয়ে তাদের মেরে ফেলা হয়। তেজগাঁওয়ের বায়িং হাউজ কর্মকর্তা সুলতান তেমনভাবেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

ওই ঘটনায় আবুল হোসেন বাদী হয়ে ১৮ জুলাই তেজগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি দায়ের হওয়ার পর থানা গোয়েন্দা পুলিশও ছায়া তদন্ত শুরু করে।

মশিউর রহমান বলেন, প্রথমে চক্রটির সদস্য এবং সুলতানের অন্যতম হত্যাকারী ফরহাদ হোসেনকে শরীয়তপুর জেলার সখিপুর থানার সরকার গ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যে ১৫ আগস্ট প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে ছিনতাইকাজে ব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্সসহ ড্রাইভার জালাল উদ্দিন ওরফে সুমনকে (৩৫) গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় চক্রের মূল হোতা কাজী মো. আকবর আলী (৪৫), সাহারুল ইসলাম ওরফে সাগর (২১), আমিনুল ইসলাম ওরফে সবুজকে (৫০) রাজধানীর পুরানা পল্টন লাইন থেকে গ্রেফতার করা হয়।

এসময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতি ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত র‌্যাবের দুটি জ্যাকেট, একটি হাতকড়া, একটি ওয়্যারলেস সেট, একটি পিস্তল, ম্যাগজিন সংযুক্ত ৫ রাউন্ড গুলি, একটি ডামি পিস্তল ও একটি পিস্তলের কভার উদ্ধার করা হয়।

ঘটনার বিবরণে ডিসি মশিউর জানান, গত ১৪ জুলাই সাগর ও সবুজ মতিঝিল মানি এক্সচেঞ্জ অফিস থেকে সুলতানকে অনুসরণ করেন। পল্টন মোড় থেকে সুলতানের সাথেই বিআরটিসি বাসে ওঠেন সাগর ও সবুজ। তারা চক্রের অপর সদস্য আকবরকে ফোন করে লোকেশন জানান। পূর্বপরিকল্পিতভাবে ছিনতাইয়ের কাজের জন্য ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্স অনুসরণ করে বাসটিকে।

ফার্মগেটে নেমে সুলতান মিরপুরগামী শিখর পরিবহনের বাসে উঠলে তাৎক্ষণিকভাবে সাগর ও সবুজ তাকে অনুসরণ করে সেটিতে ওঠেন। তারা আকবরকে জানান, সুলতানের কাছে অনেক বিদেশি ডলার আছে, কাজটি করতে হবে। তখন আকবর অ্যাম্বুলেন্সযোগে পুনরায় বাসটিকে অনুসরণ করতে থাকেন।

পল্লবীর পূরবী সিনেমা হলের সামনে সুলতান নামার পরই আকবর, মনির, ফরহাদ নিজেদের র‌্যাবের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে সুলতানকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠান। আকবরের হাতে ওয়ারলেস সেট, মনিরের গায়ে র‌্যাবের পোশাক, ফরহাদের গায়ে র‌্যাবের পোশাক এবং হাতে একটি হাতকড়া ছিল। কিন্তু তারা র‌্যাবের প্রকৃত সদস্য নয় বুঝতে পেরে চেঁচামেচি শুরু করেন সুলতান। মূল হোতা আকবর তখন সুলতানের হাতে থাকা ব্যাগটি তল্লাশি করতে থাকেন। কোনো ডলার না পেয়ে তা কোথায় জিজ্ঞাসা করতে থাকেন। ভয়ে সুলতান পুনরায় চিৎকার-চেঁচামেচি করলে অ্যাম্বুলেন্সের সামনের সিটে বসা মনির চালক সুমনের গামছা নিয়ে সুলতানের গলা পেচিয়ে ধরেন। পেছনের সিটে বসা আকবর তখন তার হাত চেপে ধরেন এবং ফরহাদ চেপে ধরেন পা। একপর্যায়ে চলন্তপথেই মারা যান সুলতান।

তিনি মারা যাওয়ায় ছিনতাইকারী পুরো টিমসহ গাড়িটি গাবতলী-হেমায়েতপুর-সাভার হয়ে নবীনগর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে সবাই নেমে পালিয়ে যান। ড্রাইভার সুমন একা লাশটিকে নিয়ে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সিংগাইর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অদূরে রাস্তার পাশে জঙ্গলে লাশটি ফেলে পালিয়ে যান।

ডিসি মশিউর রহমান বলেন, গ্রেফতার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে পল্টন থানায় একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।

 

Share: