প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। গত বুধবার (২১ জুলাই) এই দুই নেতার মধ্যে ফোনালাপ হয়। এমন সময় ইমরান খান ফোন করলেন যখন চীন ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন চলছে। অপরদিকে ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে চাই। এই সম্পর্ক অনেকদিন থেকেই শীতল অবস্থায় রয়েছে। এই ফোনালাপ নিয়ে বিশ্ব মিডিয়া সরগরম। এ বিষয়ে বিবিসি’র প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো:-
শেখ হাসিনাকে বুধবার ইমরানের খানের টেলিফোন, তাদের মধ্যে কুড়ি মিনিটের আলাপের ঘটনা এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির অন্যতম আলোচ্য বিষয়।
বিশেষ করে বছর পাঁচেক ধরে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল, এবং বিপরীতে পাকিস্তানের চিরশত্রু ভারতের সাথে সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়েছে যে ইমরান খান এবং শেখ হাসিনার মধ্যে ফোনালাপ অনেকের মনেই বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক দি নেশন তাদের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে ইমরান খান এবং শেখ হাসিনার টেলিফোন আলাপকে ‘ডন অব এ নিউ এরা’ অর্থাৎ পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘নতুন দিগন্তের সূচনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
প্রভাবশালী এই পত্রিকাটি বলছে, বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য পাকিস্তানের এখন সম্ভাব্য সবকিছু করা উচিৎ।
পাকিস্তানের মূলধারার গণমাধ্যমে গত বুধবারের এই ফোনালাপকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়েছে।
তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- যে পাকিস্তান বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে ২০১৬ সালে তাদের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব পর্যন্ত পাশ করেছে, তারা কেন বাংলাদেশের নৈকট্যের জন্য এখন উদগ্রীব?
দিল্লিতে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেয়ালে স্লোগান। এই আইন নিয়ে ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্কে শীতলতা শুরু হয়েছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন।
আর যে আওয়ামী লীগ সরকার গত প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকায় পাকিস্তানের একজন হাইকমিশনারের নিয়োগ ঝুলিয়ে রেখেছিল, তারা ভারত মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারে জেনেও বুধবারের ঐ ফোনালাপে কেন সায় দিল?
ইসলামাবাদে পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং পাঞ্জাব রাজ্যের সাবেক অস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী হাসান আসকারি রিজভি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ইমরান খান ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী।
‘বিভিন্ন সময়ে সেই বার্তা তিনি শেখ হাসিনাকে দিয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাতে সাড়া দেননি। এখন মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা হয়ত মত বদলেছেন।’
তিনি বলেন ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছে যে পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য উদগ্রীব।
পাকিস্তানের ‘নীরব কূটনীতি’ :
পাকিস্তানের এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকার কামরান ইউসুফ লিখছেন- ইমরান খান এবং শেখ হাসিনার মধ্যে ফোনালাপ অনেকের কাছে হঠাৎ মনে হলেও ‘নীরব কূটনীতির’ মধ্য দিয়ে এর প্রস্তুতি চলছে কয়েকমাস ধরে।
প্রায় ২০ মাস ঢাকায় পাকিস্তানের একজন নতুন হাই কমিশনারের নিয়োগের অনুমোদন ঝুলিয়ে রাখার গত নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকীর নিয়োগ অনুমোদন করে।
এরপর জানুয়ারিতে ঢাকায় দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রদূত সিদ্দিকী ঢাকা এবং ইসলামাবাদের সম্পর্কে তিক্ততা দূর করার চেষ্টা শুরু করেন।
পহেলা জুলাই ঢাকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সাথে এক বৈঠক করেন। পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এক্সপ্রেস ট্রিবিউন বলছেন, ঐ বৈঠকে থেকে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সরাসরি কথা বলার সিদ্ধান্ত হয়।
পহেলা জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক নিয়ে তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু পাকিস্তানের হাই কমিশনার মি. সিদ্দিকীকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘আমরা ভাতৃসুলভ বাংলাদেশের সাথে সব ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী। আমাদের দুই দেশ একই ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ধর্মের ধারক-বাহক।’
দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে শীতলতা :
পাকিস্তানের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মোদী সরকারের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্কে একটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে, এবং পাকিস্তান মনে করছে বাংলাদেশকে কাছে আনার চেষ্টার জন্য এটা একটি সুযোগ।
হাসান আসকারি রিজভি বলছেন, ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন এবং আসামে এনআরসির কারণে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক চাপে পড়েছে।
‘আসামে যে কয়েক লাখ মানুষ নাগরিকত্ব হারিয়েছে, ভারত বলছে তারা বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ এটা ভালোভাবে নেয়নি।’
তিনি বলেন, ভারতে পরিস্থিতির কারণেই খুব সম্ভবত ইমরান খান সরকারের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ হয়তো এখন কথা বলতে রাজী হতে পারে।
তবে দি নেশন তাদের এক উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছে, আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির চরিত্র যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে তাতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে উভয় দেশই কাছাকাছি আসার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে।
দি নেশনের মতে, ‘চীন ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এশিয়ায় জোটবদ্ধ রাজনীতি-অর্থনীতির প্রধান ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুন এই বাস্তবতা থেকে লাভবান হতে পারে।’
কিন্তু ১৯৭১ এ গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া বা সম্পদের বাটোয়ারার মত যেসব ইস্যু বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের মূলে- তা নিয়ে পাকিস্তান কতটা নমনীয় হতে পারে?
হাসান আসকারি রিজভি বলছেন, পাকিস্তান এই মুহূর্তে নতুন করে ১৯৭১ এর খাতা খুলতে আগ্রহী হবে না।
‘পাকিস্তান যেটা বলতে চায় তা হলো অতীত নিয়ে ঘাঁটঘাঁটি না করে চলুন সামনের দিকে এগোই।’
তিনি বলেন, ‘যদিও শেখা হাসিনার ব্যাপারে পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্টের অনেকের ভেতরে এখনও কিছুটা সন্দেহ কাজ করে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের মানুষ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব কাজ করছে।’
মি. রিজভি বলেন, ‘ইতিহাসের বাস্তবতায় বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সম্পর্কে জটিলতা দূর করা সহজ নয়।’
তার মতে, ইমরান খান এবং শেখা হাসিনার মধ্যে টেলিফোন আলাপ সম্পর্কের ‘নতুন দিগন্তের সূচনা’ নয়। তবে ‘অবশ্যই একটা ইতিবাচক অগ্রগতি।’