আল মাহমুদের কবিতা: রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর নিম্ননাভিমূল

‘মানুষের স্বপ্নের পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীও বদলে যায়। আমাদের দৃষ্টিকোণ, স্বপ্ন, মনুষ্যজাতির উপর আস্থা, বিজ্ঞান এবং কি পরিবর্তন না-হয়,’ বলেছেন আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ আল মাহমুদ।

প্রকৃতিতে আলাদা, অনুভূতির অনন্যতা, সোঁদামাটির ঘ্রাণ, গ্রামীণ জীবন এবং ঐতিহ্য, লোক উপাদানের আবরণ মনোরমভাবে কবিতায় ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি চয়িত শব্দের প্রয়োগে স্বতন্ত্র কবিসত্তা হিসেবে আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে শক্তিশালী একটা স্থান দখল করেছেন পঞ্চাশের দশকেই। অত্যাশ্চর্য উপমা এবং চিত্রা হরিণীর মতো অনন্যসাধারণ সব চিত্রের আয়োজন মাহমুদের কবিতার পরতে পরতে দেখা যায়; ফলে ভিন্ন ধরনের দ্যোতনা তৈরি করে ক্ষেত্রবিশেষে যা প্রতীয়মান হয়– যেন জীবনানন্দ ও জসীম উদ্‌দীনের কবিতায় গ্রামজনপদের শব্দের প্রয়োগ আল মাহমুদের কবিতায় সাফল্যের চূড়ান্ত পৌঁছেছে। স্বরূপ এবং কবিতায় লোকজ উপাদানের সংমিশ্রণে আল মাহমুদের কবিতা হৃদয়ে এমন এক শীতল ঝর্ণামুখের উন্মোচন করে, যে ঝর্ণাজলে অবগাহনরত অবস্থায় অলস শুয়ে থেকে কবিতার অনন্য স্বাদ শুধু অনুভূত হয়। ‘লোক লোকান্তর’ কবিতার বইটির কবিতায় কবির হৃদয়টি প্রকাশিত হয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে যেমন ঘোরলাগা অবস্থার জন্ম দেয়, তেমনি সেখানে এক অলকানন্দার স্রোতের সাথে আকস্মিক পরিচয়ও ঘটে। কাব্য-চেতনায় বিলীন কবি বলেন: ‘আমার চেতনা যেন একটি শাদা ‍সত্যিকার পাখি/ বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে/ মাথার উপরে নিচে বনচারী বাতাসের তালে/ দোলে বন্য পানলতা, সুগন্ধ পরাগে মাখামাখি…’

আধুনিকতা মানে ক্ষয়ে যাওয়া চেতনা নয়, বিষয়টি ভালোরকম অনুধাবন করা যায় মাহমুদের কবিতার গভীরে অবগাহন করলে। ক্ষয়িষ্ণু চেতনা, হতাশা বা অসুখী জীবনের ক্রন্দনবাক্য নয়, মাহমুদের কবিতায় বারবার প্রাধান্য বিস্তার করে জীবনে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা। আল মাহমুদ বহুবার বলেছেন, যাপিত জীবনে তিনি জীবন ও কবিতাকে এক হিসেবে দেখেছেন। যার ফলে তাঁর একাধিক কবিতায় সংহত হয়েছে এই বিষয়। ‘বৃষ্টির অভাবে’, `শূন্য হাওয়া`, ‘প্রকৃতি’, ‘বাতাসের ফেনা’ ‘কবিতা এমন’, ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, ‘সিম্ফনি’, ‘আমি আর আসবো না বলে’, ‘নূহের প্রার্থনা’, ‘জেলগেটে দেখা’, ‘খড়ের গম্বুজ’, ‘‘তিতাস’, ‘প্রবোধ’, ‘শোকের লোবান’ কবিতাগুলোতে তার প্রতিফলন পরিলক্ষিতও হয়। এবং এই কবিতাগুলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাহমুদের কবিতা-ভাবনাবিন্দুতে সাথী হয়ে শেষ ট্রেন মিস করে রাতে বাড়ি ফিরে মা’র কাছে ফিরে আসা; কিংবা বাঁশঝাড়ে ঢাকা দাদার কবরে নির্নিমেষ দৃষ্টিপাত; মধ্যরাতে আব্বার সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনির আওয়াজে তন্দ্রালু মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট; অথবা চিরকালের বুবুর স্নেহের মতো ডুবে যাওয়া ফুল তোলা পুরনো বালিশের মায়াজাল– আমাদের দৃষ্টিপথে, নিউরনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আর যে আলোড়ন থেকে কবিতায় মাতাল হয়ে বুনো অরণ্যে-অরণ্যে ঝাপটা দেয় স্নিগ্ধ সমীরের প্রবাহ। মাহমুদ তার ব্যক্তিক জীবনে নারীর দাবি পূরণের কথাও স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন কবিতায়। লিখেছেন–

‘তামসিক কামকলা শিখে এলে
যেন এক অক্ষয় যুবতী
তখন কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল
যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর নিম্ননাভিমূল। `
[শোকের লোবান]

সন্দেহের অবকাশ নেই, মাহমুদের সব থেকে বিখ্যাত এবং জননন্দিত কবিতার বইটিই ‘সোনালী কাবিন’। যা মাহমুদ নিজেও বলতেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাটলে এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে সংযোজন হয়েছে ‘সোনালি কাবিন’। সোনালি কাবিনে চিরকালীন গ্রামবাংলার সমাজ, ঐতিহ্য ও মিথ অনুষঙ্গ হিসেবে প্রকাশ পেলেও, স্পষ্টভাবে নারীর প্রতি কবির প্রেমও প্রকাশ পেয়েছে, তাছাড়া বিচিত্র বিষয় এবং বৈচিত্র্যময়তার জন্য সনেটগুলি আলাদা আবেদনের সৃষ্টি করে। ‘সোনালি কাবিন’ লেখার প্রেক্ষাপটটিও বিচিত্র। সোনালি কাবিন’ নামে সনেটগুলো মাহমুদ যখন লিখেন তখন তিনি এক প্রবল ঘোরের মধ্যে ছিলেন। চট্টগ্রামের গোর্খা ডাক্তার লেনের একটি বাড়ির চারতলায় একা থাকতেন মাহমুদ। বিখ্যাত গায়ক শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ছিলেন কবির প্রতিবেশী, আর কবির ডেরার পাশেই থাকতো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েরা। নিজেদের পরিমণ্ডলের বাইরে মেয়েগুলো কারও সঙ্গে না মিশলেও কবির সঙ্গে বেশ ভাব ছিল তাদের। মাঝেমধ্যে তাদের অনুষ্ঠাণে কবিকে দাওয়াত করত, এটা-সেটা খাওয়াতে চেষ্টা করত। তারা ‘মাহমুদ’ উচ্চারণ করতে পারত না। ডাকত ‘মেহমুদ’ নামে। তারা বলত, ‘মেহমুদ ইজ অ্যা পয়েট—গ্রেট পয়েট।’ একদিন হঠাৎ কবি লিখে ফেললেন ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি’—এক নম্বর সনেটটি। লেখার পর কবির মধ্যে প্রবল উত্তেজনা—ঘরের ভেতরে পায়চারি শুরু করে নিজের কবিতা নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়তেন। একেকটি সনেট লিখতেন আর ঘরের ভেতর পায়চারি করতেন। প্রথমে এক টানে সাতটি সনেট লিখে ফেলেন মাহমুদ, এরপর লিখেন আরও সাত—মোট ১৪টি। কিন্তু পরে অনেক চেষ্টা করেও ‘সোনালি কাবিন’ সিরিজে এই ১৪টির বেশি সনেট আর লিখতে পারেন নি। কবির তখন মনে হয়েছিল, এটা হয়তো কোনো দৈব ব্যাপার। ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুলোর শব্দের যুক্তিগ্রাহ্য ও নান্দনিক চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে পুরাণ ও মিথকে কবি আশ্রয় করেছেন, আর এই প্রবণতাই তাঁকে বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক অন্য কবিদের ভাষা-শব্দ-বাক্য থেকে। সৈয়দ আলী আহসানের মতে—‘পুরাতন এবং অতীতকে নববিগ্রহ দান করবার চেষ্টায় এবং উপস্থিত সত্তায় তাকে অবিরত সচল রাখবার প্রয়াসে আল মাহমুদের একটি নতুন কবি-স্বভাব জন্মলাভ করেছে, যার অভিধারণ এক মুহূর্তে অতীতে পরক্ষণেই বর্তমানে।’

মিথ এবং উপকথার প্রতি কবির অমোঘ আকর্ষণ যদিও লক্ষণীয়, কিন্তু পুরাণের বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ড তাঁর মনে একটি গভীরে রেখাপাত করেছে। যার কারণে তার কবিতায় পুরুষ তার নারীকে আকর্ষণ করার জন্য বিভিন্ন চরিত্রের উদাহরণ টেনে আনেন। তার কাছে প্রথাগত ধর্মের চেয়ে মানবধর্ম বড় হয়ে দেখা দেয়। মানুষের ধর্ম মানেই তাঁর কাছে ফসলের সুষম বণ্টন হবে—এই প্রত্যয় নিয়ে কবি এমনকি তাঁর প্রণয়িনীকে আহ্বান করেন আলিঙ্গনের। ‘সোনালি কাবিন’-এর সনেটগুচ্ছতে যা আমাদের চোখে স্পষ্টত প্রত্যক্ষও হয়–

‘বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত করো কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।’
[সোনালি কাবিন-২]

‘এ তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,
ছিন্ন তালপত্র‍ ধরে এসো সেই গ্র‍ন্থ পাঠ করি
কত অশ্র‍ু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।’
[সোনালি কাবিন-৪]

‘ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে যে তোমাকে চিনবো না
নিষাদ কি কোনোদিন পক্ষিণীর গোত্র‍ ভুল করে?’
[সোনালি কাবিন-৫]

‘অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল
লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,
আর কোনদিন বলো, দেখবো কি নতুন সকাল?
উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই।’
[সোনালি কাবিন-৮]

‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।’
[সোনালি কাবিন-১০]

মাহমুদ কবিতায় গ্রামীণ পটভূমিকে শুধু তুলে আনেন নি, তাঁর কবিতায় নগরের চিত্রও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে নগর এসেছে তাঁর কবিতায় যান্ত্রিক, কঠিন এবং রুক্ষমূর্তির রূপ নিয়ে। যেভাবে তিনি লোকজ বিষয়কে ‘আন্তরিক রতির দরদ’ দিয়ে দেখেছেন, নগরকে সেভাবে দেখেননি। আল মাহমুদ যে সমন্বয়বাদী নন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এই ব্যাপারটি বুঝতে পারা যায় নাগরিক জীবনের গ্লানি এবং শেকড়ের প্রতি আকর্ষণ—এ দুয়ের টানাপোড়েনে। যদিও তিনি ধর্মীয় চেতনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলটিতে জীবনের পড়ন্ত সময়ে এসে শামিল হয়েছিলেন বলা হয়, তবে কবি আল মাহমুদের কবিসত্তা মানবতাকে অস্বীকার করে না। স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক বোধের যুগ্ম-স্বাক্ষর এবং পাশাপাশি রাজনৈতিক চেতনা তাঁকে করে তোলে মানুষের কবি। যার কারণে রাজনৈতিক চৈতন্যের আগে অবশ্যই তার ইতিহাসচেতনা ও জাতিগত অভিজ্ঞান গভীর রেখাপাত করে। মাহমুদের পরবর্তী কবিতাগুলোতে আমরা অনুধাবনও করতে পারি কবির স্পিরিচুয়ালিটির গহনতা। কেবল গ্রামীণ-জীবন যাত্রা-ই নয়, নাগরিক বোধ, প্রকৃতি, নারী, মানবপ্রেম, যৌনচেতনা, অধ্যাত্ম্য-সংকট ও মৃত্যুচেতনা কবিতার বিপুল অংশে প্রচ্ছন্ন। রফিক উল্লাহ খানের মতে—‘আল মাহমুদের কবিতায় নগর জীবনের নেতিবাচক প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। কবি উৎকণ্ঠা ও সংশয়ে ব্যক্ত করেছেন শহুরে আবহাওয়ার বিষ-নিঃশ্বাসের কথা, যন্ত্রপিষ্ট মননের করুণ সংলাপ।’

হিমেনেসের বলা, কবিতা ছাড়া তিনি কিছুই লিখতে জানেন না, এমনকি চিঠিও; কল্পনাপ্রতিভার মহত্তম অভিব্যক্তি হলো কবিতা, বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশের বলা; স্যান্ডবার্গ-এর বলা—কবিতা হচ্ছে প্রতিধ্বনি, একটা ছায়াকে নাচতে বলা; কিংবা ইংরেজ কবি অডেনের বলা কবিতার প্রধান গুণ হলো ‘মেমোরেবল স্পিচ’– এ উক্তিগুলোর তাৎপর্য পর্যালোচনা করলে উপলব্ধি করা যায়, আল মাহমুদের কবিতায় এত বেশি স্মরণীয় পঙক্তি এবং তিনি এমন এক কবি-জীবন যাপন করেছেন, যে যা মাহমুদকে কবিতার সর্বোচ্চ চূড়ায় স্থান করে দিয়েছে৷ দুর্বোধ্য চিন্তাকে দারুণভাবে সুবোধ্য এবং ভীষণ গভীরভাবে প্রকাশ করেছেন মাহমুদ, ফলে মাহমুদের কবিতার পঙক্তি খুব সহজেই মনে গেঁথে রয়। ‘হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর’, ‘আমার কবিতা শুধু অই চোখের কসম’, ‘দেহ দিলে দেহ পাবে দেহের অধিক মূলধন’, ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার’, ‘আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট’, ‘তুমি এসো, কোমরে পেঁচিয়ে নীল শাড়ি/ দুঃখের ঘরকে করো শোকোত্তীর্ণ প্রাণের বাগান’, ‘চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ’,’অক্ষরে বিম্বিত হতে চাও যদি, খুলে ধরো সমস্ত গোপন’, ‘পরাজিত নয় নারী, পরাজিত হয় না কবিরা’– এই সকল পঙক্তি শুধু মেমোরেবল স্পিচ বা প্রতিধ্বনি নয়, সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

Share: