“তেজীয়ান লতিফুর রহমান” ——– জাঁ-নেসার ওসমান

“তেজীয়ান লতিফুর রহমান”
——– জাঁ-নেসার ওসমান
ষাটের দশক।
আমরা তখন স্কুলে পড়ি। কোন ক্লাশ? ক্লাশ ফোর ফাইভ্ হবে।
র্পূব-পাকিস্তানের কল কারকানার কথা লিখতে হলে তখন ডবিøউ রহমান জুট মিলের কথা, ছাতকের সিমেন্ট কারখানার কথা, চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের কথা লিখতে হতো। এ সব পাঠ্য পুস্তকের বিষয় ছিলো।
পুনা-ফিল্ম ইন্ষ্টিটিউট থেকে লেখা-পড়ার পাট চুকিয়ে যখন র্কমক্ষেত্রে পা রাখলাম, তখন দেখি ডবিøউ রহমান জুট মিলের নাতি, জনাব লতিফুর রহমানের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, মিসেস গীতিআরা চম্পার বিঞ্জাপন সংস্থ্যা এ্যাডকমের মাধ্যমে “রিলায়েন্স ইন্স্যুয়েরেন্সের” বিঞ্জাপন চলচ্চিত্র নির্মানের আমি, দায়িত্ব পেলাম।
আশির দশকে সেই ডবিøউ রহমান জুট মিলের নাতি জনাব লতিফুর রহমানের সাথে মতিঝিল অফিসে দেখা। একদা পাঠ্য পুস্তকে যাঁর নাম পরীক্ষার মার্কসের জন্য মুখস্ত করতাম সেই ডবিøউ রহমান জুট মিলের নাতি জনাব লতিফুর রহমান, শ্রদ্ধায় অবনত মাথা।
আমরা যখন দেখা করতে গেলাম উনি নিজে উনার চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের উনার রুমে নিয়ে গেলেন। এই হলো বড় বংশের আদব কায়দা।
বর্তমানে আনেক পুরোনো ঢাকার, ট্রাকের চাঁদা বাজ, ঘড়ী চোরাচালানকারী প্রকান্ড ধনী হয়েছেন, কিন্তু
জনাব লতিফুর রহমানের মতো মানুষ হতে পারেননি।
ছেলে-বেলা ও স্কুল, জলপাইগুড়ি।
কলেজ কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স, যে কলেজের ছাত্র ছিলেন, প্রক্ষাত কথাশিল্পী শওকত ওসমান, এই হচ্ছে উনাদের বেড়ে ওঠা, সেই তুলনায় বাংলার বর্তমান লোকাল ধনীদের টাকায় জন্মেছে, কিন্তু মনুষত্ব জন্মায়নি।
“রিলায়েন্স ইন্স্যুয়েরেন্সের” বিঞ্জাপন চলচিত্র, আমি ভাবলাম বাংলাদেশের দর্শক, পান্ডুলিপি হবে হয়তো,
“ উ রে, আল্লারে, বাবাই মরছে রে, অহন কুই যামু কি খামু,” সাথে সাথে যাত্রার বিবেকের মতো ধারা বর্নণায় বলে উঠবে, তখনই কইছিলাম “রিলায়েন্স ইন্স্যুয়েরেন্সের” পলিসি কিনুন!!
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে, শ্রদ্ধেয় জনাব লতিফুর রহমান, আইডিয়া দিলেন যে, পর্দায় দেখানো হবে’
আলো আঁধারীর মাঝে, ধীরে ধীরে টুক টুক করে “রিলায়েন্স ইন্স্যুয়েরেন্সের” লোগোটা তৈরী হবে।
ধারা বর্নণায় বলা হবে;
“এ নেম হ্যাজবিন র্কাভড ইন দি ইন্স্যুয়েরেন্স ইন্ডাষ্ট্রী। ফর অল ইওর জেনারেল ইন্স্যুয়েরেন্সের নিড, রিলায় অন রিলায়েন্স ”। কি আধুনিক চিন্তাধারা, মনটা খুশীতে বাগ বাগ।
ব্যাংকক থেকে “রিলায়েন্স ইন্স্যুয়েরেন্সের” বিঞ্জাপন চলচ্চিত্র তৈরী করে এনে ডির্পাটমেন্ট অব্ ফিল্ম এ্যান্ড পাবলিকেশনের প্রী-ভিউ থিয়েটারে দেখালাম।
আমিতো ভয়ে ভয়ে মরছি যদি বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্রটি ভালো না লাগে?
তিরিশ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্রটি শেষ হবার পর জনাব লতিফুর রহমান, শুধু বলেছিলেন;
“ব্রাভো, আই লাইক ইট।”
আমার জীবনে এই প্রথম যে, কোনো ক্লায়েন্ট বিঞ্জাপন চলচ্চিত্র দেখে, সামনা সামনি চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রশংসা করলেন।
বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট বিঞ্জাপন চলচ্চিত্রের তারিফ করে না, কারণ ভুল ধরলে বিল কমানো সহজ হয়।
এই হচ্ছে সাধারণের মানষিকতা অথচ, জনাব লতিফুর রহমান অন্য গ্রহের মানুষ।
আমার জানা মতে উনি এমন একজন ব্যবসায়ী যিনি কোনো দিন ভ্যাট ফাঁকি দেননি এমনকি ভ্যাটের জন্য কখনো কোনো অফিসারকে উৎকোচও প্রদান করেন নি। এমনি তেজী পুরুষ ছিলেন তিনি।
কিন্তু বাংলাদেশের অতিরিক্ত সচিব জনাব রাশেদুল ইসলাম, তাঁর লেখা বই সাকুরা মৌসুমে, “পেনশন” নামক গল্পে লিখেছেন যে, সামিনা খাতুন নামে এক মহিলা সরকারি অফিসারকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দেননি বলে,তাঁর পেনশন বন্ধ। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ধর্ণা দিয়েও মিসেস আমিনা খাতুন পেনশন পাননি।
শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব, আপ্রাণ লড়াই করে প্রায় দশ বছর পর এই পেনশন পাইয়ে দেন।
এই হচ্ছে বাংলাদেশ।
সে দেশে জনাব লতিফুর রহমান ঘুষ না দিয়ে প্রচুর ঝামেলায় জড়ালেও উনি কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। এই হলেন জনাব লতিফুর রহমান। প্রকৃত শিক্ষিত লোকেদের একজন।
একবার এক এয়ার পোর্টে উনার সাথে দেখা, সাথে ভাবী ছিলেন। আমি যখন ইতঃস্তত করছি এতো বড় মানুষ, আমাকে কি চিনবেন, ঠিক তখনই উনি নিজেই আমার জড়তা কাটিয়ে এসে করমর্দণ করলেন। সব সংকোচ দূর।


এর পর উনার নেসলে গুঁড়ো দুধের বিজ্ঞাপনে, উনার ছোট্ট ছোট্ট দুই মেয়ে সিমিন সাজনীন মডেল হলো। সেই একই বিজ্ঞাপন ছবিতে আফসানা মিমি ও মডেল হয়েছিলো। সম্ভবতঃ এই নেসলে গুঁড়ো দুধের বিজ্ঞাপনই আফসানা মিমির জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র।
তারপর উনার জন্য নির্মাণ করলাম “স্যেরেল্যাক”। শ্লোগানটা মুখে মুখে ফিরতো,
“উঁহু, এ্টাতো বড়দের খাবার, তোমার জন্য “স্যেরেল্যাক”।
আজবড় বেদনার মতো বেজেছে, জনাব লতিফুর রহমান এই মহাপ্রয়ান।
আজি বাংলার বুকে দারুন হাহাকার ।
একে একে চির-নিদ্রায় পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশের অবিভাবকরা, জানিনা এ কোন আলামত।
ধীরে ধীরে বাংলাদেশ যেন মানুষ শূণ্য হয়ে পড়ছে।
জানিনা বাংলাদেশের এই ক্ষতি কখনো পুরণ হবে কি না।
যদিও আমরা সামনে কোনো আশার আলো দেখি না অথচ শ্রদ্ধেয় জনাব লতিফুর রহমানের ভাষায় বলতে হয়,
“আমি আমার এই দেশটাকে নিয়ে, দেশের তরুণদের নিয়ে প্রচন্ড আশাবাদী। দেশ এগিয়ে যাবেই।”
শ্রদ্ধেয় জনাব লতিফুর রহমান স্যার আপনার এই আশা যেন বাংলার তরুণরা পুরণ করতে পারে এই কামনা করি।

জাঁ-নেসার ওসমান
Share: