যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ জাতীয় উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে কমিশন গঠন করুন’ কামরুল ইসলাম 

মতামত:

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ২০১৭ সালের ১১মার্চ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিবছর জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। লক্ষ্য করা যায়, আন্তর্জাতিক পরিসরে পালনের জন্য বাংলাদেশ সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন এবং জেনোসাইড ওয়াচ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাকিস্তান সামরিক জান্তার অভিযানের নৃশংস অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে পাকদের পরিকল্পিত বৃহৎ হত্যাযজ্ঞ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা দুটি জাতিসংঘে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকসামরিক সরকারের বৈষম্য ও অত্যাচারের নির্মমতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারই প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে বাংলার জনগণ ২ মার্চ সর্বাত্মক হরতাল পালন করে। জয়বাংলা’র ধ্বনি’তে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বিক্ষোভ মিছিল, সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে রাজপথে, অলিতে গলিতে প্রান্তিকে, নগরে । জনগণের আন্দোলন বৃহৎরূপ সংঘটিত হতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করলে ৩ জন নিহত হন এবং বহু মানুষ আহত হয়। নিরীহ জনতার উপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ডের নিন্দা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কঠোর হুশিয়ারি দিয়ে বিবৃতি দেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি হাসিল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ একইসাথে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসমাবেশের কর্মসূচি সফল করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। ।

 

বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল মহাসমাবেশে ঐতিহাসিক বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ভাষণের ফলে বাঙালিরা স্বাধীন হবার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে থাকে। পশ্চিম পাক-সেনা সরকার আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বাংলার জনগণ পশ্চিম পাক সেনাদের বিরূদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সফল করার সর্বাত্নক প্রস্তুতি, পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। পাক-সেনা জান্তারা জনগণকে নিবৃত্ত করার জন্য নৃশংস হয়ে ওঠে এবং মার্চের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক নিরীহ জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে হত্যার নারকীয় যজ্ঞে মেতে ওঠে । ১৯শে মার্চ জয়দেবপুরে পাক-সেনার গুলিতে ২০ জন নিরস্ত্র মানুষ নিহত এবং বহু জনতা আহত হন। বাংলার জনগণ প্রতিরোধ প্রতিবাদের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু প্রতিরোধ দিবসের ডাক দেন। ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের প্রতিরোধ বাহিনীর সমাবেশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ সংগীতের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বিভিন্ন দূতাবাস সহ প্রায় সকল স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। ছাত্র প্রতিরোধ বাহিনী পল্টন থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ির সামনে আসে এবং সেখানে বঙ্গবন্ধু প্রতিরোধ বাহিনীর সালাম গ্রহণ করেন। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন, সেখানে পুনরায় বলেন,’ এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

২৪ মার্চ পাকিস্তানের ভুট্টোসহ তার দলের নেতৃর্বৃন্দ ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দিনব্যাপি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের গুলিবর্ষণে ১১০ জন নিহত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দেন। একের পর এক পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে থাকলে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু বিবৃতি দেন, সেখানে উল্লেখ করেন, ‘আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্যে আমি আমাদের বীর জনগণকে আহবান জানাই।’

২৫ মার্চ বিকাল ৫টার দিকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। সন্ধ্যার পর ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী পাকিস্তানের জান্তারা সামরিক অভিযান শুরু করে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের নিরাপদ স্থানে চলে যাবার পরামর্শ দেন। রাত ১০ টার দিকে পাক-সেনারা ঢাকার শহরে ঢুকতে থাকে এবং ১১ টার দিকে নৃশংস অভিযান চালাতে থাকে। বঙ্গবন্ধু মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রচারের জন্য চট্রগ্রামে একটি বার্তা পাঠান ।

তাহলো– ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবেলা করার জন্যে আমি আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’

বঙ্গবন্ধুর এই বার্তাই স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ।

 

২৫ মার্চ রাত দেড়টার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। সারারাত বর্বর পাকসেনারা ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা চালায়। তাদের নৃশংসতার লক্ষ্য ছিল, ১. বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ২. রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ৩. পিলখানা ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) । ঢাকার বিভিন্ন স্থান ছাড়াও রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা, সিলেট, সৈয়দপুর, চট্রগ্রামে নৃশংস গণহত্যা চালায়।

অস্ট্রেলিয়ার ‘হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকার মতে ২৫মার্চ রাতে ১ লাখের অধিক লোক নিহত হন। বিশ্বের উনিশ শতকের পাঁচটি বর্বর হত্যাকাণ্ডের ভেতর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা অন্যতম। বাংলাদেশের সশস্ত্র অভিযানের পরিকল্পনা, নীলনকশাসহ নির্দেশপত্র পাকিস্তান সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তৈরি করে।

২০১২ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার ‘ এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ গ্রন্থে অপারেশন সার্চ লাইটের কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এই গণহত্যার নির্দেশের কোনো লিখিত নথি এখনও পাওয়া যায়নি। সামরিক কমান্ডাররা মৌখিক নির্দেশে নৃশংসতার জঘন্যতম ইতিহাস সৃষ্টি করে। পাকিস্তান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চলাকালিন সময়ে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫মার্চ পর্যন্ত ১লাখের অধিক মানুষ নিহত হয়। মার্কিন সাংবাদিক এই ভয়াবহতার কথা লিখতে গিয়ে বলেন, ‘সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশানভূমি।’ ইতিহাসের নির্মম গণহত্যাকে বিশ্বদিবস হিসেবে স্বীকৃতির যে উদ্যোগ তৎপরতা সরকার গ্রহণ করেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ।

 

বিশেষভাবে কতিপয় বিষয়কে গণহত্যা দিবসে বাস্তবায়নের জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

 

১. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মান্যবর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গোত্তম শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার, সম্মানিত জাতীয় সংসদ সদস্যরা ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছেন এবং বিশ্ব গণহত্যা দিবস ঘোষণার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বঙ্গোত্তম শেখ হাসিনার যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাস্তবায়নে দেশ বিদেশে কবি লেখক শিল্পী সংস্কৃতিজন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচার, প্রয়োজনীয় কর্মসূচি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আহবান জানানো যাচ্ছে।

 

২. বিশ্বে গণহত্যা মানবতার প্রতি চরম বর্বরোচিত আঘাত, তা চিরতরে বন্ধ করার জন্য বিশ্ব গণহত্যা দিবস ঐতিহাসিক মানবিক দিবস হিসেবে পালিত হোক। এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সফল কার্যকর দিবস হিসেবে ‘বিশ্ব মানুষ’-র ঐক্য স্থাপিত হবে।

 

৩. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে বর্বর গণহত্যা, Genocide হয়েছে, সেই গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট পাক-সেনাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের দাবী জানাই। চিহ্নিত ১৯৫ জন পাক-সেনাকর্মকর্তার বিচার, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওনা ৩৭ হাজার কোটি টাকা সুদ-আসলে আদায়, যুদ্ধশিশুদের দায়ভার ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার আহবান জানাই।

 

৪. বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী বিচার অব্যাহতভাবে চলছে, তা পর্যায়ক্রমে দ্রুততার সাথে বিচার সম্পন্ন করে বিচারের রায় বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানানো যাচ্ছে।

 

৫. অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জঙ্গীবাদ বিরোধী ভূমিকা রাখার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানানো যাচ্ছে। সকল ধর্ম, নৃ-গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ‘ সমঅধিকার ও সমআচার’ প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে নিশ্চয়তা প্রদান ও বাস্তবায়নে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

 

৬. যুদ্ধাপরাধীদের অর্থ সম্পদ, স্থাপনা, ভূমি বাজেয়াপ্ত করে, তাদের সম্পদ, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করার আহবান জানাই। উক্ত কমিশনে লেখক শিল্পীর প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে।

 

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিতে চাই। কি নির্মম নৃশংস ছিলো সেই রাত! যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা জাতীয় উন্নয়নে বিনিয়োগ করার কৌশলপত্র সরকারকে নেয়ার আহবান জানাই। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা সক্রিয় এবং প্রভাবশালী। তাদের সকল চক্রান্ত রুখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সরকার দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। সেই সরকারের মধ্যে যদি কেউ ঘাপটি মেরে দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িক উস্কানি, অর্থ পাচার, অবৈধ দখল, সন্ত্রাস, লুটপাটসহ বিবিধ অপকর্মে জড়িত থাকে, তাদের বিরূদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই গণহত্যা দিবস পালন যথার্থ হবে।

 

জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশ চিরজীবী হোক

 

লেখক কামরুল ইসলাম বিশিষ্ট সংস্কৃতি সেবী ও কলম লেখক

সাধারণ সম্পাদক

বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ

 

২৫.০৩.২০২৪

Share: