![](https://dailypresswatch.com/wp-content/uploads/2022/08/received_553959483189584.jpeg)
প্রতিটি কাজেরই সমালোচনা থাকা উচিত তবে পজিটিভ সমালোচনাগুলো জীবন ও সমাজ গঠনে যতটা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে, নেগেটিভ সমালোচনাগুলো ততটাই বিপরীত ভূমিকা পালন করে ৷ আমি যেহেতু সবসময়ই সমাজের নানা অনিয়ম-অনাচার নিয়ে লেখালেখি করি, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সুষম গঠন নিয়ে কথা বলি, তাই আমার আজকের লেখাটি হচ্ছে – সমাজের ‘ক্রিটিক’দের উদ্দেশ্যে :
মূলতঃ প্রতিটি লেখকেরই (কিংবা অন্য যেকোনো পেশা-শ্রেনীর মানুষ, যাদেরকে ঘিরে সমালোচনা হয় ) তাঁর সমালোচকদের ফেইস করার মতো ক্ষমতা রয়েছে , কেউ প্রকাশ করেন আর কেউ প্রকাশ করেন না ৷ তবে প্রকাশ করাটাই বোধ করি শ্রেয় ৷ আমি এত বেশী রিজার্ভ , বিজি ও নীরব যে, লেখালেখির আড্ডা ও ইন্টারভিউগুলোতে আমার জয়েন করা হয়ে ওঠেনা (যদিও এরই মধ্যে আমার বইগুলো , যথাক্রমে – ‘সুপ্রিয় দিনলিপি-১ম ও ২য় খণ্ড’ ও ‘যেখানে শয়তান আছে,সেখানে ঈশ্বরও আছেন’ নিয়ে বেশ কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে) ৷ আমি মনে করি, “একজন লেখককে তাঁর লেখালেখির ক্ষেত্রে কে কষ্ট পেল বা কে খুশী হলো বা এখানে, কে রেফারী বা কে গোলদাতা বা গোলকীপার এইসব মাথায় রাখা চলবে না “৷ লেখক তাঁর লেখালেখির জগতে সম্পূর্ন স্বাধীনতা ভোগ করবেন , শুধুমাত্র খেয়াল রাখতে হবে যে, তিনি যেনো এই স্বাধীনতার অপব্যবহার না করেন অর্থাৎ তাঁর লেখাগুলো যেনো সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে না দেয় ৷তবে এটা সত্য যে, আমাদের সমাজে এখন মৌলিক লেখক,শিক্ষক,গবেষক ,সাংবাদিক দের চাইতে এসব প্রফেশনে ক্রিটিকদের সংখ্যা অর্থাৎ সমালোচকদের সংখ্যা বেশী হয়ে গেছে ৷ এর কারনও আছে ৷কারনটি হছ্ছে, “একটি মৌলিক গবেষনা বা মৌলিক চিন্তার বই লিখতে বা মৌলিকভাবে সত্য ঘটনাকে হাইলাইট করে লেখালেখি কিংবা সাংবাদিকতা করতে প্রচুর সময় ও মেধার প্রয়োজন হয় অপরদিকে যেকোনো কিছুর ‘সমালোচনা’-তে কিন্তু অত………অত সময়ের প্রয়োজন হয় না বরং রাতারাতি এর ফল ভোগ করা যায়”, যেমন : ১. অন্যকে সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়ে নিজের নামটিকে হাইলাইট করা যায় অর্থাৎ সমাজের মানুষ তখন সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে যাকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে,তাকে কুদৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে আর যিনি সমালোচনা করছেন, তাকে সুদৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে৷আমাদের সমাজ আজ এতটাই অশিক্ষিত৷ ২. অন্যকে সমালোচনার মুখে ফেলে দিতে পারলে নিজের সময় অনেকটা বাঁচানো যায় , ৩. পরিশ্রম বাঁচানো যায়, ৪.অন্যকে সমালোচনা বা অপমানের মুখে ফেলে দিয়ে অতি দ্রুত নিজেকে একটি সম্মানিত জায়গায় নিয়ে যাওয়া সহজ হয় এবং ৫. সর্বোপরি, মেকি অর্থাৎ আর্টিফিসায়ালি নিজেকে একরকম বিচারকের আসনে আসীন করা যায় ৷ কিছু কিছু মানুষ সমালোচকদেরকে আবার অনেক জ্ঞানীও ভেবে থাকেন ৷ আমাদের সমাজ গঠনের জন্য ‘সমালোচক’ দের (ক্রিটিকদের) ও প্রয়োজন রয়েছে বাট সেটা হতে হবে পজিটিভ- অর্থে , নেগেটিভ-অর্থে নয় ৷ ‘The God of Small Things ‘ বইটির জন্য বুকার পুরস্কার-প্রাপ্ত ভারতের প্রখ্যাত লেখিকা-‘অরুন্ধতী রায়’ বলেছেন, “আসলে প্রতিটি লেখক নিঃসঙ্গ অর্থাৎ টেবিলে যখন সাদা কাগজ নিয়ে বসেন তিনি নিঃসঙ্গ,এটা সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ কাজ ৷ কিন্তু কাজটি শেষ হলে পরিস্হিতি পাল্টে যায় ৷আমি তখন কোনোভাবেই নিঃসঙ্গ নই, নিঃসঙ্গতার উল্টোটা……….! আমি ভাবতে ভালোবাসি , ভাবি, যদি কখনো আমি পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে পড়ি, বাকি জীবনটা আমি কাটাবো মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে এই বলে যে, ‘ আমি The God of Small Things’ এর লেখক,আমাকে কী দুপুরে খাওয়াবেন?’ এটা একটা চমৎকার বোধ ৷”- ( সংগৃহীত : আমার ২য় উপন্যাস ‘সুপ্রিয় দিনলিপি-২য় খণ্ড’ থেকে) ৷ আবার আমার এই বইয়েরই অন্য জায়গায় বলা হয়েছে (সেটাও অরুন্ধতী রায়েরই কথা), ” ‘সেলিব্রিটিহুড’ শব্দটাকে আমি ঘৃনা করি ৷ আমি কীভাবে তা সামলাই? রক হাডসনের ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় যখন কোনো সহযোগী ভালো করছে বলে শুনতেন, তিনি বলতেন, ‘নিপাত যাক’ ৷ আমিও চাই, ‘ও’ অর্থাৎ ‘সেলিব্রিটিহুড’ মরুক,নিপাত যাক ৷ আমিও আমার ‘সেলিব্রিটিহুড’ কে কিছুটা এভাবেই দেখি ৷ পত্রিকায় যখন আমি আমার ছবি দেখি, জনগণের মধ্যে তৈরী হওয়া আমার ভাবমূর্তির প্রতি আমি শত্রুতা অনুভব করি এবং বলি, সে নিপাত যাক, আমি চাই ‘ও’ অর্থাৎ ‘সেলিব্রিটিহুড’ মরুক৷ তবে প্রকৃতপক্ষে বিষয়টার সঙ্গে একজনের মানিয়ে নেওয়াটা খুবই , খুবই কঠিন কাজ ৷ কোনো মুহূর্তে হয়তো মনে হয়, এটা আমাকে পুরো অস্হির করবে ৷ তবে মনে হয়, এখন বিষয়টি আয়ত্ত্বে রাখতে পারছি ৷ আমার প্রাথমিক রীতি থেকে আমি এর সমাধান বের করেছি ৷ প্রথমত, আমি একজন লেখক তারপর সেলিব্রিটি ৷ আমি একজন লেখক যে কিনা ঘটনাচক্রে এ মুহূর্তের জন্য সেলিব্রিটি৷ নীতিগতভাবে আমি সেলিব্রিটি হিসেবে কখনো কিছু করিনি …………………….”৷
-( সংগৃহীত : আমার ২য় উপন্যাস ‘সুপ্রিয় দিনলিপি-২য় খণ্ড’ থেকে) ৷
লেখক হিসেবে ‘অরুন্ধতী রায়’ এর এই নৈতিকবোধগুলো আমাকে আকৃষ্ট করেছে বলেই আমি তা আমার বইতে লিখে রেখেছি ৷ এক জীবনে কখনোই আমরা আমাদের সিনিয়র বিখ্যাত লেখকদের লেখা একসঙ্গে পড়তে পারবো না বা পড়ার সুযোগ ঘটেনা ৷ সেটা আমরা পড়ি জীবনের বিভিন্ন বয়সে কিন্তু তবুও সব কি আমরা পড়তে পারি কিংবা সব কি আমরা জানতে পারি ৷ কিন্তু আমার ‘সুপ্রিয় দিনলিপি-১ম ও ২য় খন্ড’ বইটিতে , সেকালের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে এ যুগের কথা-সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ পর্যন্ত -এদের সকলের সাহিত্যের মূল্যবান কথাগুলোই স্হান পেয়েছে এবং সাথে আছে লেখক হিসেবে এই সমাজ, রাষ্ট্র, নতুন প্রজণ্মের শুদ্ধতা নিয়ে বেড়ে ওঠার কথাও ,অনেকটা কমিটমেন্টমূলক ৷ আসলে, প্রতিটি লেখকের কাছেই তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিটি প্রিয় অর্থাৎ একটি লেকচার বা সাবজেক্ট যেমন একজন শিক্ষকের নিকট সন্তান বা প্রেয়সীর চাইতেও অধিক প্রিয় ,ঠিক তেমনি নিজের লেখাও একজন লেখকের কাছে সেইরকম প্রিয়৷ আমি বরাবরই আমার মাঝে ‘শিক্ষক ও লেখক’ -এই দুটি স্বত্ত্বা মনে-প্রাণে ধারণ করি যাতে করে একটির প্রতি অতি ব্যস্ততা যেনো অন্যটির মৃত্যু না ঘটায় ৷তাই করোনাকালীন সময়ে কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ন একাডেমিক দায়িত্ব পালনরত অবস্হায় যখন আমার ক্লাশ থাকেনা কিংবা ক্লাশে যেতে পারিনা,তখন আমি খুব অস্হিরতায় ভুগি৷তাই তখন আমার সাহিত্যগুলো শুধু স্রেফ বিনোদন নি্র্ভর না হয়ে, লেখাগুলো মূলতঃ আমার চারপাশের এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতি কমিটমেন্টমূলক হয়ে যায় অর্থাৎ একজন শিক্ষকের দৃষ্টিতে সমাজটাকে নিয়ে, দেশটাকে নিয়ে যত ভাবনা যেনো আমারই কোনটা ঠিক হলো কিংবা হলো না অথবা কোথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সুন্দর নিয়ম-নীতি মানা হলো কি হলো না, তা যেনো সচেতনভাবে আমাকেই খেয়াল রাখতে হবে !মে বি স্বভাবটি জন্মগত ! আর এসমস্ত কারনে মাঝে মাঝেই সমালোচকদের নানারকম মুখরোচক কথা আমাকে শুনতে হয়, হজম করতে হয় ৷আমার মনে হয়, প্রতিটি লেখককেই এ অবস্হা ফেইস করতে হয় ৷ আমি কিছুটা নিঃস্বার্থ উদারপন্থী, মানবিক, দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক ( তবে ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিক অর্থাৎ অন্য কোনো ধর্মের প্রতি অবমাননা বা কটুক্তি না করে নিজের ধর্মটি শান্তিপূর্ন উপায়ে পালন করি) এবং অত্যন্ত সততার ও সচেতনতার সঙ্গে সকলের মেধার মূল্যায়নের প্রতি যত্নশীল৷
আমি লেখালেখি করছি প্রায় বাইশ/তেইশ বছর যাবত আর বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে শিক্ষকতা করছি ষোল বছর যাবত ৷ তবে এই ‘লেখালেখি’ আমার জীবনে যে সমস্যাটি তৈরী করেছে, সেটা হচ্ছে, আমার ছাত্র-ছাত্রীরা একে সাদরে গ্রহন করতে পারেনি ৷তাদের পেইন ও বক্তব্য হচ্ছে, ‘এখন নাকি তারা আমাকে আগের মতো পাবেনা কিংবা তাদের প্রতি আমার মনোযোগ কমে যাচ্ছে’ ৷ আমার এই কলামটির মাধ্যমে তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখছি, সেরকমকিছু ভাববার কোনো অবকাশই নেই কারন , পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি আপনারা যখন কোনো উপন্যাস বা অন্য যে কোনো বই পড়বেন, তখন অত্যন্ত সচেতনভাবে মনে রাখতে হবে, ‘আপনার পঠিত বইটিও আপনার জীবন গঠনে,মননশীলতা গঠনে আপনার অগোচরে ভূমিকা রাখছে, সুতরাং সবসময় ভালো বই অর্থাৎ সমাজের বিখ্যাত মনীষীদের জীবনী, বাংলাদেশের ইতিহাস,কমিকস কিংবা অন্য যেকোনো ভালো বই পড়তে হবে’ ৷আমি মনে করি, আমার বইগুলো এর ব্যতিক্রম নয় ৷আমি এও বিশ্বাস করি, “শিক্ষকতা হলো চিরজীবনের জন্য মানুষের জীবনকে শিক্ষার স্ফুলিঙ্গ দ্বারা আলোকিত করা আর অন্যদিকে লেখালেখি হচ্ছে – সাহিত্যের মাধ্যমে জীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ , ন্যায় – নীতি মূলক অনুভূতিগুলো তুলে ধরার মাধ্যমে চিরজীবনের জন্য মানুষের জীবনকে আরও বেশী আলোড়িত করে তোলা” ৷তবে এখানে কথা আছে, একটি ভালো লেখা মানুষকে যেমন সত্য ও সুন্দর জীবনের দিকে ধাবিত করে অপরদিকে একটি খারাপ লেখা মানুষকে মন্দ দিকেই শুধু নয়, তাকে চরিত্রহীনও করে তুলতে পারে ৷ তাই শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের কাছে এবং লেখক হিসেবে পাঠকদের কাছে আমাদের সর্বদা জীবনের আদর্শিক দিকগুলো এবং স্বচ্ছ,সুন্দর ও শুদ্ধ চিন্তা-চেতনাবোধগুলো তুলে ধরা উচিত এবং একই সঙ্গে সারা বিশ্বের সমালোচকদের প্রতি আমার আবেদন , “একজন শিক্ষক, একজন লেখক , একজন শিল্পী কিংবা অন্য যেকোনো পেশা-শ্রেনীর মানুষের কর্মের সমালোচনা করবার পূর্বে তাকে এবং তার কর্মকে জানতে চেষ্টা করুন এবং অতঃপর সমালোচনা করুন আর সমালোচনাগুলো ইতিবাচক অর্থে করুন, নেতিবাচক অর্থে নয় কখনই ৷ মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর সমালোচনা করবেন না ও তা সমাজে ছড়িয়ে দিবেন না কখনই ৷ কারন, এ পৃথিবীতে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর সমালোচনার কারনে বহু ভালো মানুষ ও বহু ভালো কর্মগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে৷ অতএব, সাধু সাবধান! এমনভাবে কারো সমালোচনা করুন যা কিনা সমাজ অবক্ষয়ে নয় বরং একটি জ্ঞান-ভিত্তিক -সুশীল সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে” ৷ আমাদের কারোরই উচিত হবেনা এমন কোনো কর্মে লিপ্ত হওয়া যাতে করে নিজের কৃতকর্ম বা মিথ্যা কটুক্তি বা সমালোচনার কারনে অন্য একজন নিরাপরাধ মানুষ , তাঁর কর্ম ও তাঁর পরিবারটি যেনো ধবংস হয়ে না যায় ! ‘সকলকে ভালোবাসতে পারা এবং কারো প্রতি বৈরিতা বা শত্রুতা অনুভব না করা’ – মানুষের একটি মহৎ গুন ৷ সকলকে ভালোবেসে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন,
জগৎ জুড়ে উদার সুরে ………………. আনন্দ গান বাজে ।।
সে গান কবে গভীর রবে………………… বাজিবে হিয়া-মাঝে।।
বাতাস জল আকাশ আলো ……………….সবারে কবে বাসিব ভালো ??
হৃদয়সভা জুড়িয়া তারা ………………. বসিবে নানা সাজে।।
নয়ন দুটি মেলিলে ……………. কবে পরান হবে খুশি ??
যে পথ দিয়া চলিয়া যাব …………….. সবারে যাব তুষি ।।
রয়েছো তুমি একথা কবে ………………জীবনমাঝে সহজ হবে ??
আপনি কবে তোমারি নাম ……………. ধ্বনিবে সব কাজে ??
জগৎ জুড়ে উদার সুরে ………………. আনন্দ গান বাজে ।।
লেখক : ফারহানা আকতার, পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র গবেষণা ইনষ্টিটিউট , বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক , গবেষক এবং লেখক ৷