মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থল কি মধ্যপ্রাচ্য

একসময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে ছিল মধ্যপ্রাচ্য। নানা কারণে দুই পক্ষের সম্পর্ক আগের অবস্থানে না থাকলেও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার ১৮ মাস পর জুলাইয়ের শুরুতে প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন জো বাইডেন। অন্যদিকে এ অঞ্চলের দিকে নজর রয়েছে চীনেরও। ফলে মধ্যপ্রাচ্যই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতার নতুন কেন্দ্রস্থল হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বাইডেন লিখেছিলেন, ‘চীনকে পরাজিত করার জন্য আমাদের নিজেদের সর্বোত্তম সম্ভাব্য ভালো অবস্থানে রাখতে হবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংয়ের পদচিহ্ন আগের চেয়ে আরও বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। ফলে চীনকে টেক্কা দিতে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নিজেদের অবস্থান বদলাতে চাইছে ওয়াশিংটন, যা বাইডেনের মন্তব্যে স্পষ্ট। আর এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠছে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার পরাশক্তি চীনের প্রতিযোগিতার সম্ভাব্য কেন্দ্রস্থল।

তেল ও গ্যাসের মতো চিরাচরিত সহযোগিতার ক্ষেত্র থেকে শুরু করে করোনা মহামারিকে বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা তথাকথিত ‘হেলথ সিল্ক রোড’ পর্যন্ত নিজেদের অর্থনীতি প্রসারিত করেছে চীন। এসবের মাধ্যমে বেইজিং স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতেই এসেছে।

এতে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আরও তীব্র প্রতিযোগিতার ভিত্তি স্থাপন হয়েছে, যা বৈশ্বিক নিরাপত্তায় মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে গেছে এক দৃঢ় অবস্থানে।

সৌদি আরবের কিং ফয়সাল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের এশিয়ান স্টাডিজ ইউনিটের প্রধান মোহাম্মদ তুর্কি আল-সুদাইরির মতে, মধ্যপ্রাচ্যে পদচিহ্ন বাড়িয়ে এ অঞ্চলের সমস্যাগুলোকে সারগর্ভ উপায়ে সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সম্ভাব্য বিকল্প ও ‘ধনী শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন।

লেনদেনে ডলারের বদলে ইউয়ান? 

কেউ কেউ দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যকে দূরে সরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি জ্বালানি ক্ষেত্রে তেলের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়ার সুযোগ নিয়েছে চীন। অদূর ভবিষ্যতে যা মধ্যপ্রাচ্যকে চীনের আরও কাছে ঠেলে দিতে পারে।

গেল মার্চে জানা যায়, চীনের কাছে তেল বিক্রির জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চীনা মুদ্রা রেনমিনবি (ইউয়ান) গ্রহণ করার কথা বিবেচনা করছে সৌদি আরব। যা বর্তমান আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্য ব্যবস্থায় ডলারভিত্তিক লেনদেন থেকে একটি বড় বিচ্যুতি।

সৌদি আরব চীনের শীর্ষ অপরিশোধিত তেল রফতানিকারক দেশ। চীনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কাস্টমসের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সৌদি আরবের কাছ থেকে ৮৭ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে চীন।

বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব এবং চীন উভয়ই এ ধরনের ব্যবস্থার সুবিধা দেখছে। চীনের জন্য, ইউয়ানে লেনদেন মূলত দেশটিকে মুদ্রার ওঠানামা এবং সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা করবে। আর সৌদি আরবের কাছে চীন একটি বড় বাণিজ্যিক অংশীদার।

অনেক বিশ্লেষক অবশ্য দাবি করেন, গত কয়েক দশক ধরে তেল ও গ্যাসের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে অন্যদের ‘সুসম্পর্ক’ থাকলেও এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র জ্বালানি খাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না।

বাইডেনের ‘আমেরিকান মূল্যবোধের’ বিপরীতে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান ‘কর্তৃত্ববাদ’ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে নতুন করে তীব্র মতাদর্শিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে।

যৌথ লাভ 

বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতা শেষ হতে পারে যদি এ অঞ্চলে চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ভূমিকা হারানোর ধারণাটি উড়িয়ে দেয়া যায়। এতে মধ্যপ্রাচ্যে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি সহজেই পারস্পরিকভাবে লাভজনক হতে পারে।

ব্রাসেলস স্কুল অব গভর্ন্যান্সের সহযোগী অধ্যাপক গাই বার্টনের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে মধ্যপ্রাচ্য হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে-এ ধারণাটি খুবই সহজ। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘকাল ধরে চীনের উপস্থিতি রয়েছে। সেখানে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক পদচিহ্ন কেবল জ্বালানি খাতে নয়, প্রসারিত হয়েছে ডিজিটাল, স্বাস্থ্যসেবা এবং রিয়েল এস্টেটেও।’

বার্টন আরও বলেন, ‘এর অর্থ এই নয় যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে পরিত্যাগ করছে। বেইজিংয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও, ওয়াশিংটনকে এখনই চীনের বিকল্প ভাবছে না মধ্যপ্রাচ্য।’

ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইসরাইল এবং সৌদি আরবকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি নিরাপত্তা জোট গঠনে বাইডেনের প্রচেষ্টা থেকে এটি স্পষ্ট যে, সুরক্ষার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখনও চীনের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বেশি বিনিয়োগ করছে এবং খুব শিগরিই এটি পরিবর্তন হবে না। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের কার্যক্রম অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট নয়।

অতীতে ইরাক থেকে কুয়েত পর্যন্ত মার্কিন ‘নিরাপত্তা উপস্থিতি’ থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছে চীন। কারণ বেইজিংয়ের বিস্তৃত বিনিয়োগের ভিত্তি এসব দেশের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। সেদিক বিবেচনায়, মার্কিন এবং চীনা স্বার্থ নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে একই।

চীন দীর্ঘকাল ধরেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলে আসছে যারা নিজেরাই কখনও কখনও প্রতিপক্ষ। বিশেষ করে সৌদি আরব এবং ইরান। এই দুটি দেশই এ অঞ্চলে চীনের বৃহত্তম অংশীদার।

এখন পর্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতিতে অটল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে বেইজিং।

ইরানের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি সহযোগিতামূলক চুক্তির পাশাপাশি ইসরাইল এবং সৌদি আরবের সঙ্গেও চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চীন। একইসঙ্গে সংঘাতে জর্জরিত একটি অঞ্চলে রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ না করার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের অবস্থানও সংহত করেছে দেশটি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ায় চীন কতদিন মধ্যপ্রাচ্যে তার অর্থনীতিভিত্তিক বৈদেশিক নীতি কার্যকর রাখতে পারবে সেটিও এখন বড় প্রশ্ন। যদিও তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার ক্ষেত্রে চীনের অতীত সাফল্য বেশ সমর্থন পেয়েছে।

অধ্যাপক গাই বার্টনের মতে, “অর্থনৈতিকভাবে আপনি যত বেশি বিনিয়োগ করবেন, এ অঞ্চলের (মধ্যপ্রাচ্য) সঙ্গে আপনি তত বেশি আবদ্ধ হবেন এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবেও সম্পৃক্ত হয়ে পড়বেন। একই সময়ে আমেরিকানরা তাদের মিত্রদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করার চেষ্টা করে নতুন ‘শীতল যুদ্ধের’ প্রেক্ষাপট তৈরি করছে।”

বিশ্ব এখন এক বৃহত্তর মাত্রার অনিশ্চয়তার পথে রয়েছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের জন্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে বেছে নেয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ পরিস্থিতি বিবেচনায় উভয় দেশই এখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Share: