নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়া কি দেউলিয়া হয়ে যাবে?

রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই বলতে পশ্চিমা দেশগুলো কেবল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সীমিত থাকতে চাচ্ছে। হাতে অস্ত্র নেওয়ার মতো কোনো মানসিকতা এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তার সঙ্গীরা দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় এই যুদ্ধে নেমেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধারণা করা হয়েছিল, অর্থনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়া শুরু হলেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে।


রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক সাজার ধকল হানা দিলেই হতাহতের সংখ্যা কমে যাবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে কিয়েভের রাস্তায় লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব বুঝতে পেরেছে, রাশিয়াকে আর্থিকভাবে আঘাত করতে না-পারলে সে অনিরাপদই থেকে যাবে। অন্তত স্বল্পমেয়াদে তাকে আটকানো যাবে না।  

গত এক দশক ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সরকারি ও বেসরকারি ঋণ কমিয়ে আনার নীতি বাস্তবায়ন করেছে ক্রেমলিন। যুদ্ধকালীন প্রতিকূলতা মোকাবিলায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পর্যাপ্ত বিদেশি সম্পদ মজুদ করতে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, যাতে কয়েক বছর না হলেও অন্তত কয়েক মাস দেশের অর্থনীতিকে ধরে রাখা সম্ভব হয়।


গেল কয়েক দিনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও কানাডা মিলে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তাতে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারবে না কিংবা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নষ্ট হবে না। কেবল ইরানের মতো পরিপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেই কোনো ফল আসতে পারে। আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়াকে পুরোপুরি বের করে দিতে হবে।

দ্য ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল ইকনোমির প্রধান হোসুক লি-মায়িকিয়ামা বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপ অনেক বেশি একীভূত হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া নিজেকে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে।


তিনি বলেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে রাশিয়ার ৩০০ হাজার কোটি ইউরোপের সম্পদ আছে। পুরোদমে অর্থনৈতিক লড়াই শুরু হয়ে গেলে এসব সম্পদ আত্মসাত করে নিতে পারে তারা।

আর বিপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফার্মের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের কাছে কয়েক শত কোটি মার্কিন ডলারের রুশ অর্থ আছে। যাতে রাশিয়ার তেল কোম্পানি রোসনেফটের ২০ শতাংশ শেয়ার আছে।

এই রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ বলেন, এমন সংঘাতের পরিস্থিতি ইউরোপীয় দেশগুলো যেসব বিকল্প বেছে নিতে পারে, তার মধ্যে নিষেধাজ্ঞা একটি হতে পারে। যদি তারা উত্তর কোরিয়া ও ইরানকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বের করে দিতে পারে, তবে এক্ষেত্রেও তাদের বড় ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা নেই।
হোসুক লি-মায়িকিয়ামা বলেন, আমি বলছি না, রাশিয়াকে সুইফট ব্যবস্থা থেকে বের করে দেওয়া অসম্ভব। রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্র আছে, যা দিয়ে শত্রুসহ রাশিয়াকে তারা ধ্বংস করে দিতে পারে।

সুইফটের পুরো নাম দ্য সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন। দ্রুত ও নিরাপদ আন্তঃদেশীয় অর্থনৈতিক লেনদেনে প্রধান বার্তা ব্যবস্থা হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। এটির মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে আসছে।

রোজই ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার লেনদেন হয় সুইফটের মাধ্যমে। কিন্তু চীন সরকার সমর্থিত প্রতিদ্বন্দ্বী সিপসের কাছ থেকে ব্যাপক চাপে রয়েছে এটি। অর্থনৈতিক লেনদেনের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়া এটি ব্যবহার করতে পারে। এতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহজেই লেনদেন চালিয়ে যেতে পারবে মস্কো।

রাশিয়ার গ্যাস ও তেল ক্রয় বন্ধ করে দিতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জি৭ দেশগুলো। কিন্তু পণ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, তেলের বাজারে রুশ সরবরাহ বন্ধ করে দিলে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকলেও গ্যাসের ঘাটতি পূরণের কোনো আশা নেই। অর্থাৎ ইউরোপীয়দের গ্যাসের অভাব পূরণ করতে বিকল্প ব্যবস্থা নেই। আবার রুশ তেল সরবরাহ পুষিয়ে নিতে গেলে প্রতি ব্যারেল তেলের মূল্য ১৪০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

সংকট শুরু হয়ে গেলে ইউরোপে গ্যাসের দাম রকেটের গতিতে বাড়তে থাকবে। যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও ৯ গুণ বেশি হতে পারে। ১৯৭৪ সালে ক্রিসমাসের আগে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

কনসালটেন্সি ফার্ম ক্যাপিটাল ইকনোমিকসের প্রধান ইউরোপীয় অর্থনীতিবিদ অ্যান্ড্রু কেনিংহাম বলেন, চেক প্রজাতন্ত্র ও বাল্টিক দেশগুলোসহ কয়েকটি দেশ যখন রাশিয়ার গ্যাসে নিষেধাজ্ঞা দিতে উদগ্রীব, অন্যরা ততটাই নিরুৎসাহী। কারণ সংঘাতের মধ্যে এ রকম সিদ্ধান্তে তাদের আরও বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হতে পারে।


থিংকট্যাংক চাথাম হাউসের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ টম মায়ানি বলেন, বর্তমান নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। কারণ রাশিয়ানরা এখনো লন্ডনের অর্থনৈতিক বাজারের ক্রিপ্টোকারেন্সিতে প্রবেশ করতে পারছেন।

চাথাম হাউসের গত বছরের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ক্রিপ্টোকারেন্সিবিরোধী কার্যকর পদক্ষেপে আইনি ফাঁকফোকরও বন্ধ করে দিতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক বেশি স্বচ্ছ হতে হবে। সোভিয়েত-পরবর্তী অভিজাতদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। ক্ষমতা ব্যবহার করে অর্থপাচার করলে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদেরও সাজার আওতায় আনতে হবে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে বরিস জনসন সরকার ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ অর্থনৈতিক প্রবাহে অবৈধ রুশ অর্থ প্রবেশ বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রুশ জ্বালানি আমাদানি বন্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে রাশিয়া অনেক বেশি সক্রিয়। কিন্তু ব্রিটেনের চেয়ে রাশিয়ার ওপর ইউরোপীয়রা অনেক বেশি নির্ভরশীল। এতে মস্কোর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগ্রহেও তাদের ঘাটতি আছে।

গ্যাস ও তেল রফতানি বন্ধ, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে রাশিয়াকে তাড়িয়ে দিতে না পারলে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সীমিতই হবে।
Share: