দিপু সিদ্দিকীঃ
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার অপতৎপরতা থেমে নেই। গত ১০ ডিসেম্বর র্যাব ও তার ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একতরফাভাবে নিষেধাজ্ঞার পরে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার নিজেও বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
এবার কয়েকটি এনজিও ও মানবাধিকার সংগঠনের জাতিসংঘকে দেওয়া চিঠিতে নতুন অপতৎপরতার কথা জানা গেছে। ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর জাতিসংঘের শান্তি মিশনে র্যাবকে নিষিদ্ধ করতে চিঠি দেয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এনফ্রেল) ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বেশি কয়েকটি বিদেশি সংগঠন। চিঠি দেওয়ার পর আড়াই মাস পার হলেও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অপারেশনস বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিক সাড়া মেলেনি।
এদিকে এসব সংস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের অভিযোগ রয়েছে। কোনো কোনো সংস্থা ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নীরব থাকলেও বাংলাদেশ নিয়ে সরব রয়েছে। আবার কোনো সংস্থা নিজেরাই মানবাধিকার লঙ্ঘনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময়েও এসব সংস্থা ন্যাক্কারজনকভাবে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার চালিয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে অপচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে চিঠিতে সই করা ব্যাংককভিত্তিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনের (এনফ্রেল) বিরুদ্ধে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে এনফ্রেল ৩২ প্রতিনিধি পাঠানোর কথা জানিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যথাসময় ছাড়পত্র ও ভিসা না পাওয়ার অভিযোগ তুলে তারা পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কথা জানায়। পরে এ নিয়ে হতাশা ও অসন্তোষ ব্যক্ত করতে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে।
এনফ্রেল ব্যাংককভিত্তিক সংস্থা হলেও অর্থায়ন করে ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট।
আবার দুর্নীতি ছাড়াও অ-পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে। এশীয় দেশগুলোর মানবাধিকার নিয়ে তারা সক্রিয় থাকলেও পশ্চিমাদের অপরাধ নিয়ে তাদের তেমন প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না।
অ্যামনেস্টির অভ্যন্তরীণ কর্মপরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অবহেলা, উত্ত্যক্ত ও অমর্যাদার শিকার হয়ে ২০১৮ সালে সংস্থাটির দুই কর্মী আত্মহত্যা করেছিলেন।
অ্যামনেস্টির কর্মীরা বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কাজ করলেও নিজেদের কর্মস্থলে তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ২০২০ সালে অর্থনৈতিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ভারতে অ্যামনেস্টির ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছিল।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিরুদ্ধেও অভিযোগের কমতি নেই। সংস্থাটি মার্কিন সরকারের নীতির মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত হলেও দাবি করা হচ্ছে। ব্রিটিশ দৈনিক টাইমস বলছে, মানবাধিকার চর্চার ক্ষেত্রে এইচআরডব্লিউ সবসময় স্বচ্ছতা, সহনশীলতা ও জবাবদিহিতার চর্চা করে না। কোনো কোনো অঞ্চলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তারা সচেতনভাবে এড়িয়ে যায়।
দ্য টাইমস বলছে, কাশ্মীরের নিপীড়ন নিয়ে দুই দশকে মাত্র চারটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এছাড়া ইরানের নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা নিয়েও তাদের প্রতিবেদন প্রকাশে অনীহা দেখা গেছে।
২০১৪ সালের মে মাসে এক খোলা চিঠিতে মার্কিন সরকারের সঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। এতে শান্তিতে নোবেলজয়ী অডলফ পেরিজ ইসকুয়েভেল, মেইরিড কোরিগান, জাতিসংঘের সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হ্যান ভন স্পনেক, ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের বিশেষ দূত রিচার্ড এ. ফলকসহ শতাধিক পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সই করেছেন।
এছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচারের আগে-পরে বাংলাদেশের জন্মের সময়ে নির্বিচারে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে, শুধু তাদের মানবাধিকার কোনোভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে আলোকপাত করতে দেখা গেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টিকে। যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধেও তারা বাংলাদেশকে সুপারিশ করেছিল।
টাইম সাময়িকীসহ উল্লেখযোগ্য প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই একমত হয় যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ শুধু নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠী বা দলের মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করার কারণে নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।
‘কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততাবিহীনভাবে কাজ করার নীতি’ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সৌদি আরবের সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিপুল অংকের অনুদান নেওয়ার অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ও নার্ভ গ্যাস ব্যবহারের প্রমাণ আছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, যা প্রকারান্তরে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ইরাক আক্রমণের পক্ষে সায় দেয়।
তাদের দেওয়া সেই ঘোষণাটি পরবর্তীতে শতভাগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। মিথ্যা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুরু হওয়া ইরাক যুদ্ধের ৬ লাখ অকারণ হত্যাকাণ্ডের দায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কখননোই স্বীকার করেনি।
এদিকে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের সদস্য ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, যে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমরা কখনোই সমর্থন করি না। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অবশ্যই ভূমিকা পালন করে এবং করবে। সেটা যে সংস্থাই করুক।
তিনি বলেন, যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে—তখন অতীতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়—এর মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে যে, এ ধরনের একটা অবস্থান থাকতে পারে। র্যারেব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে বিভ্রান্তিকর বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ড. কামাল বলেন, বলা হচ্ছে ৪০০-৬০০ অভিযোগ। যাকে আমরা মনে করি কনফিয়ুজিং (বিভ্রান্তিকর)। সুস্পষ্টভাবে যদি প্রত্যেকটা অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়, তখন আমরা খতিয়ে দেখতে পারি কে এটা বলেছেন এবং কেন বলেছেন?