বড় দিনের শুভেচ্ছা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অবদান -মোঃ হাবিবুর রহমান

প্রেসওয়াচঃ  খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন মূলত বড় দিন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ক্রিসমাস হলো খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ২৫শে ডিসেম্বর যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে খ্রিস্টান সম্প্রদায় উৎসব পালন করে। উল্লেখ্য যে, যিশু খ্রিস্ট এই বড় দিনে ফিলিস্তিনের বেথেলহাম নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত The Twelve Days of Christmas গানটি মূলত ক্রিসমাস এবং নিকট যিশুর আবির্ভাবের মাঝামাঝি সময়কে বুঝায়। আজ যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন। রোমান ইতিহাস অনুসারে ৪র্থ শতাব্দিতে ২৫ শে ডিসেম্বর প্রথম বারের মত যিশ খ্রিস্টের (Jesus Christ) জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। ক্রিসমাসের উৎসবগুলো মূলত মকরক্রান্তি এবং সংগৃহীত ফসল উৎপাদন শেষে রোমান এবং ইউরোপীয়ানরা এ দিবসটি উৎযাপন করতো। এ দিবসে কিছু রীতি নীতির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিলো শ্যামলিমা দিয়ে বাড়ি-ঘর সাজানো, উপহার-আদান প্রদান, গান গাওয়া, এবং বিশেষ খাবার পরিবেশন করা বিবিধ। কিংবদন্তী সেন্ট নিকোলাস এর সময়ে এ ছুটির দিবসটি বিশেষভাবে উন্নিত হয়। যে মানুষটি সেন্ট নিকোলাস ছিলেন, তিনি ৪র্থ শতাব্দির এশিয়ার মাইনরের বিশপ ছিলেন। যদিও তাঁর অধিকাংশ ইতিহাস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। যিশু খ্রিস্ট্রের জন্মদিনের ইতিহাস সেন্ট লুক এবং সেন্ট ম্যাথুর নিউ ট্যাস্টাম্যান-এর গসপলে বর্ণিত রয়েছে। উল্লেখ্য যে, সান্তা ক্লজ ১৯৩১ সাল নাগাদ চিত্রিত হয়েছে যখন কোকাকোলা এটাকে মানবাকৃতি হিসেবে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। যিশু ছিলেন একজন ইহুদি ধর্মপ্রচারক।

লেখকঃ মোঃ হাবিবুর রহমান
গবেষক ও কলামিষ্ট

যিশু খ্রিস্টের জন্ম, জন্মের তারিখ, ও তাঁর ইতিহাস নিয়ে গবেষক ও ধর্মীয় বিশ্লেষকদের মধ্যে বিভিন্ন মতপার্থক্য রয়েছে। কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষকদের মতে, যিশু আদৌ রহস্যোদঘাটনবাদী ছিলেন না। যিশুর ক্রুশারাহণের তারিখটি গুড ফ্রাইডে এবং পুনর্জীবন লাভের তারিখটি ইস্টার নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্মে যিশুকে আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ একজন নবী ও মসিহ বলে মনে করা হয়। ইসলামে তিনি ঈসা নামে পরিচিত। মুসলিম সম্প্রদায় বিশ^াস করে, ঈসা ছিলেন নবী ও রাসুল যার উপর ইঞ্জিল নামক আসমানি কিতাব নাযিল হয়েছিল যার ভাষা ছিলো সুরিয়ানি। তিনি হজরত মরিয়ম (আঃ)-এর কুমারীগর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে মুসলিমগণ ঈসাকে ঈশ^রপুত্র মনে করে না। আল কুরআন অনুসারে ঈসা নিজে কোনদিন নিজেকে ঈশ^র দাবি করেননি। তিনি ক্রুশবিদ্ধও হননি। হজরত মুহাম্মদ (স.) এর বাণী তথা হাদিস মতে, হজরত ঈসা (আ.Ñ ৪র্থ আসমানে অবস্থান করছেন। কিয়ামতের পূর্বে তিনি এ ধরণীতে হজরত মুহাম্মদ (স.) এর উম্মত হয়ে আসবেন। অতঃপর তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন এবং হজরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজার পাশেই তাঁকে দাফন করা হবে। বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশে^র খ্রিস্টান সম্প্রদায় আজ বড় দিন উৎযাপন করছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ^জিৎ ঘোষের মতে, বাঙালি সমাজের খ্রিস্ট্রান সম্প্রদায় আঠার শতকের শেষের দিকে এই দিনটিকে বড়দিন হিসেবে পালনের চর্চা শুরু করেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে এ সম্প্রদায়ের ইতিহাসও জড়িত। বাংলাশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে এ সম্প্রদায়ের অবদান ও ত্যাগ জড়িত। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রোমান ক্যাথলিক এবং প্রটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের জন্যে বিভিন্ন চার্চ রয়েছে এবং এ সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করছে। নীলফামারী জেলায় অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থাপত্য রয়েছে। এ জেলায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ১০২টি গির্জা রয়েছে। এ গির্জাগুলো যথাক্রমে ডিমলায় ০৬টি, ডোমারে ০৬টি, জলঢাকায় ১৪টি, কিশোরগঞ্জে ১০টি, সদরে ৬২টি, এবং সৈয়দপুর উপজেলায় ৪টি। এ জেলায় ২টি বিখ্যাত গির্জা রয়েছে যথাক্রমে প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের গির্জা- চার্চ বাংলাদেশ এবং রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের গির্জা- ক্যাথলিক চার্চ। ১৮৮৬ সালে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ইবাদত পালনের জন্য ব্রিট্রিশ সরকার সাহেবপাড়ার দুই প্রান্তে ২টি গির্জা নির্মাণ করে। রোমান ক্যাথলিক এবং প্রটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের এ দুইটি গির্জা উত্তারাঞ্চলের সর্বপ্রথম এবং প্রাচীনতম গির্জা। এ ২টি চার্চের স্থাপত্যশৈলি ইউরোপীয় এবং উন্নত রাষ্ট্রের আদলে নির্মিত হয়েছে।

নীলফামারীর সৈয়দপুর সংলগ্ন চার্চ ষ্ট্রিট সাহেব পাড়ায় ক্যাথলিক চার্চটি (Catholic Church) অবস্থিত। এ ক্যাথলিক চার্চের পাশেই ফাদার কুঠী রয়েছে। এছাড়াও নীলফামারী জেলার ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের নির্মিত ঐতিহাসিক চিনি মসজিদের পাশে সৈয়দপুর খ্রীস্টিয়ান কবর স্থান (Saidpur Christian Cemetery) অবস্থিত। এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন ধর্মের লোক অংশগ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য যে, মহান মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র বিদেশি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় নাগরিক উইলিয়াম ওডারল্যান্ড। তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদান যথাক্রমে তথ্য আদার-প্রদানে সহায়তা, খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের জন্যে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশের ৪র্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীরপ্রতীক প্রদান করে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের লোকেরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ছিলো অস্থায়ী সরকার গঠনের এক ঐতিহাসিক দিন। ঐ দিন ভবরপাড়া ক্যাথলিক চার্চের আসবাবপত্র ও বিভিন্ন সামগ্রি অস্থায়ী সরকার গঠনকালে ব্যবহৃত হয়। মেহেরপুর ক্যাথলিক চার্চের ফাদার ফ্রান্সিস এ গমেজ অস্থায়ী সরকার গঠনে সহায়তা করেছিলেন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী সুরকার সমর দাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একজন সুরকার হিসেবে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সকল খ্রিস্ট্রান সম্প্রদায় শহীদ হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন যথাক্রমে শহীদ সিলভেস্টার গনসালভেস (২০), চট্টগ্রামের শহীদ খ্রীষ্টোফার ডি সিলভা এবং গোপালগঞ্জের শহীদ সুভাষ বিশ^াস। রাজধানী ঢাকাতেও অনেকে শহীদ হয়েছেন। তারা হলেন যথাক্রমে ঢাকার তেজগাঁও-এর শহীদ খোকন সলোমন পিউরীফিকেশন এবং মোলাশিকান্দের শহীদ হিউবাট অনিল সুমন্তি। গাজীপুরের যে সকল মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছে গাজীপুরের রাঙামাটিয়ার শহীদ অনীল কস্তা, শহীদ রেজিনাল্ড গমেজ, শহীদ রবি ডিকস্তা, গাজীপুরের মঠবাড়ির শহীদ আগস্টিন পেরেরা, গাজীপুর নাগরীস্থ করানের শহীদ আন্তনী পিউরীফিকেশন। অন্যদিকে বরিশালে মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের মধ্যে যথাক্রমে শহীদ আশীষ ব্যাপারী, শহীদ টমাস আশীষ ব্যাপারী, গৌরনদীস্থ তারাইল হাটের শহীদ পরেশ চন্দ্র গাইন। ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যথাক্রমে হালুয়াঘাটস্থ মনিকুড়ার শহীদ পরিমল দ্রং, শহীদ আরং রিছিল, এবং শহীদ অনিল মান্দা। যশোর ক্যাথলিক চার্চ প্রাঙ্গণে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল শহীদ হয়েছেন ফাদার মারিও ভেরনেসি। অন্যদিকে দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের রুহিয়া ধর্মপল্লীর ফাদার লুকাস মারান্ডী ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল শহীদ হন। এছাড়াও ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর শহীদ হন ফাদার উইলিয়াম ইভান্স। অন্যদিকে যে সকল খ্রিস্টান যোদ্ধারা মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শহীদ ফাদার লুকাস মারান্ডী, শহীদ পবিত্র বিশ^াস,শহীদ সিস্টার ইন্মানুয়েল, শহীদ স্বপন কুমার বিশ^াস (২৬), শহীদ অনীল সরদার (৪৬), শহীদ ফুলকুমারী তরফদার (৫০), শহীদ প্রকাশ বিশ^াস (৫০), এবং শহীদ মাগদেলিনা থরফদার (৩০)। মুক্তিযুদ্ধে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অবদান ও ইতিহাস রক্ষায় কাজ করছে বাংলাদেশ খ্রিষ্টান মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবার কল্যাণ সমিতি। এ সমিতিটি প্রায় ৫০০ (পাঁচশত) খ্রিস্টান মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংগ্রহ করেছিল। বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ সহবস্থান করছে। এ সম্প্রীতি ও ভালবাসা অটুটের মাধ্যমে দেশের শান্তি ও ঐক্য রক্ষা পাবে। জাতীয় ও আন্তর্জার্তিক ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। গত বছর করোনা মহামারীর কারণে বৃহৎ পরিসরে এ দিনটি খ্রিস্টান সম্প্রদায় এ বারের মত পালন করতে পারেনি। এ বছর ওমিক্রনের সংকট থাকলেও বাংলাদেশে এ মহামারীর প্রকোপ কম থাকায় তা বৃহৎ পরিসরে পালিত হচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ খ্রিস্ট্রান অধ্যুষিত কিছু রাষ্ট্রে ওমিক্রন প্রকোপ থেকে বাঁচতে সীমিত পরিসরে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। সবাই করোনা মহামারী এবং ওমিক্রন থেকে মুক্ত থাকতে প্রার্থনা করছে। আমাদের সকলের মাঝে ধর্মীয় সম্প্রীতি অব্যাহত থাকুক, বড় দিনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। লেখক, মোঃ হাবিবুর রহমান গবেষক ও কলামিষ্ট ই-মেইল: mirmohammadhabib@gmail.com

Share: