হাতিরঝিলের স্লুইসগেট খুললে জলে যাবে ৫০ কোটি টাকা

প্রেস ওয়াচ রিপোর্টঃ রাজধানীর হাতিরঝিলের পানি পরিষ্কার ও দুর্গন্ধ দূর করতে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক। প্রকল্পের মাধ্যমে দুর্গন্ধ দূর করে পানির প্রকৃত রঙ ফিরিয়েও আনা হয়েছে। এ অবস্থায় জলাবদ্ধতা নিরসনে চলতি বর্ষায় ঝিলের সব গেট খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন সরকারের এ সিদ্ধান্তে হাতিরঝিলের ক্ষতি হবে। এতে বাড়বে দুর্গন্ধ। বৃষ্টির পানির সঙ্গে সুয়ারেজের পানি এসে ঝিলের বারোটা বাজাবে। ঝিলের পানি শোধনে যে ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল, সেটাও জলে যাবে। এ অবস্থায় আরও গবেষণা করে বিকল্প পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিলেন তারা।

হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, যানজট নিরসন এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি। এ জন্য প্রকল্পের লেকটিকে একটি স্টর্ম ওয়াটার রিটেনশন বেসিন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। বর্ষা মৌসুমে যাতে করে বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য ঝিলের সব গেট খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু লেকের নালা এলাকায় স্টর্ম ও সুয়ারেজ লাইন আলাদা ছিল না। ফলে ওয়াসার সুয়ারেজ লাইনের বর্জ্যমিশ্রিত পানিই হাতিরঝিল লেকে পড়ছে। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির সময় লেকের সব পথ খুলে দেওয়া হলে আরও বেশি পয়োবর্জ্য সরাসরি ঝিলে পড়বে। আর তা যেন না ঘটে সেই জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।

হাতিরঝিল প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, ৯টি মেকানিক্যাল স্ক্যানারের মাধ্যমে ঝিলের আশপাশের এলাকার বাসাবাড়ির ও বৃষ্টির পানি ঢাকা ওয়াসার ড্রেনের মাধ্যমে হাতিরঝিলে পড়ে। কিন্তু ৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে স্ক্যানারগুলো পানির চাপ সামলাতে পারে না। তখন এলাকা প্লাবিত হয়। তখন ঝিলের সব গেট খুলে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

জলাবদ্ধতা দূর করতে হাতিরঝিলের সব গেট খুলে দিতে গত ১২ মে রাজউককে চিঠি দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ। চিঠিতে তিনি বলেন, ধানমণ্ডি ৩২ নং রোডসহ শুক্রাবাদ, পরিবাগ, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান ও পান্থপথ এলাকার বৃষ্টির পানি পান্থপথ বক্সকালভার্ট দিয়ে হাতিরঝিল হয়ে রামপুরা খালে নির্গত হয়। হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় হোটেল সোনারগাঁওয়ের দক্ষিণে পানি নির্গমণের অংশে নির্মিত প্রতিবন্ধকতার কারণে বৃষ্টির পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিপাতে এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। রাস্তাঘাট ডুবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

‘বিকল্প নেই, গেট খুলে দেবো’
এদিকে গতবছরের ২৩ জুলাই হাতিরঝিল স্লুইসগেট পরিদর্শনে গিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পের স্লুইসগেট বর্ষাকায় উন্মুক্ত রাখার কথা বলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। সম্প্রতি তিনি কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বর্ষায় ঝিলের গেট খোলা রাখতে রাজউককে নির্দেশ দেন।

এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী ও হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক এএসএম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা হাতিরঝিলের গেটগুলো খুলে দেবো। মানুষকে তো আর দুর্ভোগে ফেলে রাখা যাবে না। পানি অপসারণের বিকল্প ব্যবস্থাও নেই। হাতিরঝিলের মুখ খুলেই এটা করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, আমরা গত দুই বছর হাতিরঝিলের পানি পরিষ্কার রাখলাম। দুই বছরে একটা পর্যায়ে নিয়ে আসলাম। এখন খুলে দিলে পানিতে দুর্গন্ধ দেখা দিবে। দেখা যাক কী হয়। কারণ একটা সিস্টেম তো দাঁড় করিয়েছি। যে পরিমাণ ময়লা আসবে রাসায়নিক দিলে হয়তো তা আবার পরিষ্কার করা যাবে। এটাকে অপচয় বলা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাতিরঝিলের পানি দূষণ রোধ করতে স্টর্ম ড্রেনেজ ও রেইন ওয়াটার ড্রেনেজ আলাদা করতে হবে। কিন্তু ওয়াসা সে দিকে নজর দিচ্ছে না। দু’টি লাইন আলাদা করা গেলে সমস্যাটি হতো না। তখন আমরা বৃষ্টির পানি সরাসরি হাতিরঝিলে ছেড়ে দিতে পারতাম। কারণ, ওতে আবর্জনা থাকে না। সুয়ারেজ লাইনের পানি শোধন করতে বেশি সময় লাগতো না। এখন সুয়ারেজের পানিও ঝিলে পড়ে।’

 বিশেষজ্ঞরা বললেন
হাতিরঝিল প্রকল্পের নকশা প্রণয়নে যুক্ত ছিলেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মজিবুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাতিরঝিল তৈরি হয়েছে বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য। বর্ষাকালে তো এর গেট খুলে দিতে হবে। মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি সঠিক। কিন্তু এখানে বিনষ্ট করবে ওয়াসার সুয়ারেজ লাইন। ওই বর্জ্যই ঝিলের পানিকে দুর্গন্ধময় করে। তাই আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি ওয়াসার ড্রেনেজ ও বৃষ্টির পানির নালা আলাদা করতে হবে।’

মন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম হাতিরঝিল প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘সুয়ারেজের পানি তো ঝিল বা খাল-বিলে যাওয়ার কথা নয়। এই পানি তো সেফটি ট্যাংক করে শোধন করার কথা। কিন্তু আপনার কেন প্রকল্প তৈরির সময় বিষয়টি মাথায় নেননি। এখন গেট খুলে দিতে হবে। পাশাপাশি দূষণ রোধে বিকল্প ব্যবস্থাও নিতে হবে।’সুত্র- বাংলা ট্রিবিউন

Share: