আনিস আলমগীর
বাংলাদেশের খুব কম লোক আছেন বোধহয় যারা ১৮ এপ্রিল ২০২১ রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে একজন ডাক্তারকে পুলিশ পথ আটকানোর পর ওই ডাক্তারের সঙ্গে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের ঝগড়ার ঘটনা জানেন না। নেটিজেনরা তো এক্ষেত্রে সবার আগে আছেন। আমি অবাক হয়েছি একজন ডাক্তারকে পুলিশ এই সময়ে কেন পথ আটকাবে! তার গাড়িতে প্রতিষ্ঠানের স্টিকার রয়েছে, উনি যে ডাক্তার পোশাকে চেনা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই পরিচয়ও দিয়েছেন। হতে পারে তিনি আইডি কার্ড সঙ্গে রাখেননি। পুলিশের এটুকু কমনসেন্স কী থাকবে না, কে ডাক্তার আর কে ডাক্তার না- এটা চেনার! তাহলে পুলিশ আর সাধারণ মানুষের পার্থক্যটা কীসের!
আগের দিন আমি বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকা নিয়ে এসেছি। রাস্তায় বহু মানুষ ছিল, গলিতে তো আরেকটু বাড়লে ধাক্কাধাক্কি হওয়ার অবস্থা। রাস্তার যখন এমন দৃশ্য তখন আইডি কার্ড দেখানো নিয়ে একজন ডাক্তারের সঙ্গে পুলিশের ঝামেলার বিষয়টি ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। বর্তমান সময়ে ডাক্তাররাই তো অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে আছেন। ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী শুনেই তো তাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।
পুলিশ কি তাহলে ঘুষের জন্য গাড়ি ধরে? সেদিনের সব দোষ পুলিশের ছিল? ব্যক্তিগতভাবে আমি পুলিশ সম্পর্কে ঢালাও বক্তব্যে বিশ্বাস করি না। ছাত্রজীবন থেকে পুলিশ আমাকে গোলযোগের মাঠে সামনে পেয়ে ছেড়ে দিয়েছেন বারবার, চেহারা দেখে কেন তাদের দয়া হয় জানি না। কোনও ঝামেলায় পুলিশ ডেকেছি বা নিজে থানায় গিয়েছি, সহায়তা করেছেন, সম্মান দিয়েছেন তারা। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সহায়তা চেয়েছি, পেয়েছি। এমনও হয়েছে, এইমাত্র অন্যদিকের গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু আমার তাড়া থাকায় অনুরোধ করেছি, ওই রাস্তা বন্ধ করে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। ভাববেন না, সুবিধা নিতে নিজের পরিচয় জাহির করেছি কোথাও।
ওহ, কী কদর্য আমাদের পরিচয় দেওয়ার ভঙ্গি! ডাক্তার, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট- সবাই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় দিয়েছেন সেদিন। বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি রাস্তাঘাটে বিক্রয় করার বিষয় নয়। এটাকে যত্রতত্র কদর্যভাবে ব্যবহার করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অবমাননা করা। আসলে বাঙালির আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আছে। নিজের পরিচয় বাদ দিয়ে অমুক আর তমুকের পরিচয়ে বাহাদুরি দেখায় তারা। অন্যের ফ্ল্যাটে ঢুকতে দারোয়ান আটকালে, রাস্তায় পুলিশ পরিচয় চাইলে– এরা পরিচয় দিতে বিরক্ত হয় কিন্তু নিজের নিরাপত্তাও চায় ষোল আনা। আবার যিনি পরিচয় চানতে চান ‘আপনি কে’ জিজ্ঞেস করার আগে জানতে চায়- কোথা থেকে এসেছেন বা কোথায় যাবেন?
ডাক্তার সমাজের প্রতি আমার শ্রদ্ধা শিশুকাল থেকে। ঘরে বড় ভাই ডাক্তার। আত্মীয়-স্বজন ডাক্তার। আমার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীদের বড় অংশ ডাক্তার। তাদের যখন হেয় করে কেউ কথা বলে খারাপ লাগে। ১৮ এপ্রিল ওই চিকিৎসকের সঙ্গে পুলিশের প্রাথমিক ব্যবহার কী ছিল সেটা উনি বা কারও কাছ থেকে বিস্তারিত আসেনি। ঘটনায় ডাক্তার-পুলিশের পাল্টাপাল্টি বিবৃতিতেও উল্লেখ নেই। তবে ভিডিওতে ডাক্তারের বডি ল্যাংগুয়েজ এবং মুখের ভাষা চিকিৎসক সমাজের জন্য সুনাম আনেনি। তিনি কথায় কথায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন, পেশাগত শ্রেষ্ঠত্বের ইগো দেখিয়েছেন, ডাক্তারদের প্রতি সরকারের কথিত অবহেলা, অবমূল্যায়নের ক্ষোভ ঝেড়েছেন। সর্বোপরি, পুলিশের প্রতি চলমান লকডাউনে ‘ডাক্তার হয়রানি’- এর বিরুদ্ধে ‘মহান নেতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছেন। এসবের দরকার ছিল না।
চিকিৎসক নিজেকে যুগ্ম সচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা দাবি করে তেমন ট্রিটমেন্টও চেয়েছেন। সচিব, যুগ্ম সচিবদের কি রাস্তায় চেকিং হয় না! তারা কি আইনের ঊর্ধ্বে! যুগ্ম সচিব মর্যাদার বিষয়টিও আসলে কথার কথা। একই স্কেলে বেতন পেলেই মর্যাদা এক হবে ভাবার কোনও কারণ নেই। তার সমপরিমাণ অন্তত ৫ হাজার সরকারি কর্মকর্তা আছেন এই দেশে, তার মধ্যে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল থেকে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বা কোনও কলেজের শিক্ষকও রয়েছেন।
নিজের পেশাটাই দুনিয়ার সেরা- এরকম চিন্তা বাংলাদেশের ডাক্তারদের মধ্যে প্রবল। ডাক্তাররা মনে করেন, সবাই ডাক্তার হতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে (স্কুলের বইয়ের ‘এইম ইন লাইফ’ রচনাকে সত্য মনে করে বোধহয়)। পুলিশও কিন্তু তার পেশাটিকে দেশসেবার সেরা মাধ্যম মনে করে নিয়েছে। যিনি পশুর ডাক্তার তিনিও নিজের পেশাকে ভালোবেসে দেশের সেবায় এ কাজ করছেন। যিনি সাংবাদিক, তারও চিন্তা সমাজের মানুষের উপকার করা। তাহলে কে শ্রেষ্ঠ- এই প্রশ্ন অবান্তর। কার পেশা শ্রেষ্ঠ সেদিকে না তাকিয়ে, যে যেই পেশায় জড়িত সেখানে শ্রেষ্ঠ হয়ে সবার লক্ষ হওয়া উচিত- মানুষের কাজে আসা, দেশের সেবা করা।
আলোচিত শিক্ষক-চিকিৎসকের মতো কেউ যদি শ্রেষ্ঠত্বের ইগোতে ভোগেন, সেটা তার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ছড়াতে বাধ্য। এই সোশ্যাল সাইকির প্রভাব আমরা ইতোমধ্যে দেখছি। ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে এমবিবিএস পাস ডাক্তারদের নিয়োগ দেওয়া হলেও কোনোরকমে তারা দুই বছর পার হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। প্রতিষ্ঠানটি আসলে চালায় উপ-সহকারী মেডিক্যাল অফিসার। এমবিবিএস পাস ডাক্তার মাঠে গিয়ে হতাশ হন তার থেকে ‘কম মেধার’ এসি ল্যান্ড, ইউএনও সরকারি গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরেন দেখে। অথচ এসি ল্যান্ড হওয়ার বিসিএস পরীক্ষায় তিনিও হয়তো অংশ নিয়েছেন। বুয়েট বা মেডিক্যাল কলেজ থেকে একটি বিশেষায়িত শিক্ষা নিয়ে কেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের কূটনীতিক বা প্রশাসক হতে হবে! যারা হতে চান তাদের যেমন ভুল আছে তেমনি সরকারেরও দায়িত্ব আছে পেশাগত সুযোগ-সুবিধার এসব ছোট-বড় বৈষম্য দূর করার।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বাংলাদেশের ডাক্তাররা অনেক দিন থেকে সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স নিয়ে হতাশার মধ্যে পড়ছেন। ছোটকাল থেকে সমাজ তাকে মেধাবী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর পেশাগত জীবনে এরা চারপাশের অনেকের চেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত দেখেন নিজেকে। বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের লোকদের মাতব্বরি, সুবিধা ও চাকচিক্য তাদের আরও বেশি হতাশ করে। ডাক্তাররা কঠোর পরিশ্রম করেন শিক্ষাজীবনে,পরিশ্রম করেন কর্মজীবনেও- সেই পরিশ্রমের তুলনায় তাদের প্রাপ্তি কম। সবাই ক্লিনিক খুলে বড় লোক হওয়ার চান্সও পান না। অনেক সময় নিজের ক্লাসের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ, বড়লোক সহপাঠীর হাসপাতাল-ক্লিনিকেই হয়তো তাকে চাকরি করতে হয়। রাষ্ট্র এবং সোসাইটির কাছ থেকেও যখন তারা যথাযথ সম্মান পান না, তখন মনোবেদনা থাকাটা স্বাভাবিক।
এই করোনাকালে আমাদের ডাক্তাররা, ইন্টার্নিরা তাদের জীবনবাজি রেখে মানুষের সেবা করছেন- এই কথা সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে। এটাও ঠিক, পুলিশের ভূমিকা নগণ্য নয়। এ পর্যন্ত কর্তব্যরত অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ৯১ জন পুলিশ মারা গেছেন এবং আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি। শুরুতে ডাক্তারদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টিও অবহেলা করা হয়েছে। যখন একটি পেশার লোকজন নিজের জীবন, পরিবার উপেক্ষা করে মানুষের সেবায় নেমেছে, সেখানে লকডাউনের চেকিংয়ের নামে রাস্তায় তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার না করা, মর্যাদা না দেওয়া জাতির জন্যও লজ্জার। পুলিশ যদি সেদিন শুরুতে সত্যি অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহার করে থাকেন, তা যেকোনও ডাক্তারের মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার মতোই। আমরা আবেগের ঝামেলায় ডাক্তারের কাছে যাই কিন্তু ডাক্তারদেরও আবেগ আছে। রোগীরা তাকে ঈশ্বর জ্ঞান করেন বলে অন্যরকম একটি অনুভূতির মধ্যে বসবাস করেন তারা। সেটাকে অন্যদের কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করা উচিত।
সবশেষে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই সেদিন স্পটে থাকা সেই ম্যাজিস্ট্রেটকে, যার প্রশংসনীয় ভূমিকাটি জাতির কাছে, নেটিজেনদের কাছে কোনও স্বীকৃতি পায়নি। লক্ষ করুন, মহিলা ডাক্তারটিকে ঘিরে রেখেছিল ২০-৩০ জন পুলিশ কনস্টেবল। উনি যখন তাদের বড় পুলিশ কর্তাকে অপমান করে কথা বলছেন তখন এই উত্তেজিত পুলিশ বাহিনী চিকিৎসককে আক্রমণ করার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। ঠিক ক’দিন আগেই এমন ঘটনা ঘটেছে সুপ্রিম কোর্টের গেটে। একজন আইনজীবীকে একদল পুলিশ ধাক্কা-ঘুসি মেরে অত্যাচার করেছে। সেটাও ছিল আইডি দেখানোকে কেন্দ্র করে।
এমন হাঙ্গামায় ঊর্ধ্বতন পুলিশের কর্তাদের ইশারা যেমন থাকে আবার বেশিরভাগ সময় ঘটনা তাদের কন্ট্রোলের বাইরেও চলে যায়। হ্যালমেট পরা পুলিশ চেনাও কঠিন। কিন্তু ঘটনাস্থলে উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেট বারবার অনুরোধ করে ডাক্তার ভদ্রমহিলাকে গাড়িতে তুলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। তারপর গাড়িটি সাইড করিয়েছেন। তার সঙ্গে তুলনামূলক ভালো ব্যবহার করেছেন। পরিস্থিতি লংকাকাণ্ড হওয়ার আগে সামাল দিয়েছেন। তবে ডিউটিরত অবস্থায় কেউ তাকে ফোনে মন্ত্রী ধরিয়ে দিলে কথা না বলাই ছিল উত্তম। ওপাশে প্রধানমন্ত্রী আছে বললেও তখন কারও ফোনের রেসপন্স করা অনৈতিক। এখানে শুধু জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ফোন ধরা তার জায়েজ আছে।
গত বছর যশোরের মনিরামপুরে লকডাউনের মধ্যে মাস্ক না পরায় তিন বৃদ্ধকে এক ম্যাজিস্ট্রেট কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল প্রশাসন ক্যাডারের কর্তারা। এবার পুলিশ ও ডাক্তারের বসচায় ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা তাদের স্বস্তি দিয়েছে। সে কারণে তারা ‘বিবৃতি যুদ্ধে’ নেই বলে ধরে নেন।
আগের দিন আমি বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকা নিয়ে এসেছি। রাস্তায় বহু মানুষ ছিল, গলিতে তো আরেকটু বাড়লে ধাক্কাধাক্কি হওয়ার অবস্থা। রাস্তার যখন এমন দৃশ্য তখন আইডি কার্ড দেখানো নিয়ে একজন ডাক্তারের সঙ্গে পুলিশের ঝামেলার বিষয়টি ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। বর্তমান সময়ে ডাক্তাররাই তো অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে আছেন। ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী শুনেই তো তাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।
পুলিশ কি তাহলে ঘুষের জন্য গাড়ি ধরে? সেদিনের সব দোষ পুলিশের ছিল? ব্যক্তিগতভাবে আমি পুলিশ সম্পর্কে ঢালাও বক্তব্যে বিশ্বাস করি না। ছাত্রজীবন থেকে পুলিশ আমাকে গোলযোগের মাঠে সামনে পেয়ে ছেড়ে দিয়েছেন বারবার, চেহারা দেখে কেন তাদের দয়া হয় জানি না। কোনও ঝামেলায় পুলিশ ডেকেছি বা নিজে থানায় গিয়েছি, সহায়তা করেছেন, সম্মান দিয়েছেন তারা। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সহায়তা চেয়েছি, পেয়েছি। এমনও হয়েছে, এইমাত্র অন্যদিকের গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু আমার তাড়া থাকায় অনুরোধ করেছি, ওই রাস্তা বন্ধ করে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। ভাববেন না, সুবিধা নিতে নিজের পরিচয় জাহির করেছি কোথাও।
ওহ, কী কদর্য আমাদের পরিচয় দেওয়ার ভঙ্গি! ডাক্তার, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট- সবাই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় দিয়েছেন সেদিন। বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি রাস্তাঘাটে বিক্রয় করার বিষয় নয়। এটাকে যত্রতত্র কদর্যভাবে ব্যবহার করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অবমাননা করা। আসলে বাঙালির আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আছে। নিজের পরিচয় বাদ দিয়ে অমুক আর তমুকের পরিচয়ে বাহাদুরি দেখায় তারা। অন্যের ফ্ল্যাটে ঢুকতে দারোয়ান আটকালে, রাস্তায় পুলিশ পরিচয় চাইলে– এরা পরিচয় দিতে বিরক্ত হয় কিন্তু নিজের নিরাপত্তাও চায় ষোল আনা। আবার যিনি পরিচয় চানতে চান ‘আপনি কে’ জিজ্ঞেস করার আগে জানতে চায়- কোথা থেকে এসেছেন বা কোথায় যাবেন?
ডাক্তার সমাজের প্রতি আমার শ্রদ্ধা শিশুকাল থেকে। ঘরে বড় ভাই ডাক্তার। আত্মীয়-স্বজন ডাক্তার। আমার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীদের বড় অংশ ডাক্তার। তাদের যখন হেয় করে কেউ কথা বলে খারাপ লাগে। ১৮ এপ্রিল ওই চিকিৎসকের সঙ্গে পুলিশের প্রাথমিক ব্যবহার কী ছিল সেটা উনি বা কারও কাছ থেকে বিস্তারিত আসেনি। ঘটনায় ডাক্তার-পুলিশের পাল্টাপাল্টি বিবৃতিতেও উল্লেখ নেই। তবে ভিডিওতে ডাক্তারের বডি ল্যাংগুয়েজ এবং মুখের ভাষা চিকিৎসক সমাজের জন্য সুনাম আনেনি। তিনি কথায় কথায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন, পেশাগত শ্রেষ্ঠত্বের ইগো দেখিয়েছেন, ডাক্তারদের প্রতি সরকারের কথিত অবহেলা, অবমূল্যায়নের ক্ষোভ ঝেড়েছেন। সর্বোপরি, পুলিশের প্রতি চলমান লকডাউনে ‘ডাক্তার হয়রানি’- এর বিরুদ্ধে ‘মহান নেতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছেন। এসবের দরকার ছিল না।
চিকিৎসক নিজেকে যুগ্ম সচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা দাবি করে তেমন ট্রিটমেন্টও চেয়েছেন। সচিব, যুগ্ম সচিবদের কি রাস্তায় চেকিং হয় না! তারা কি আইনের ঊর্ধ্বে! যুগ্ম সচিব মর্যাদার বিষয়টিও আসলে কথার কথা। একই স্কেলে বেতন পেলেই মর্যাদা এক হবে ভাবার কোনও কারণ নেই। তার সমপরিমাণ অন্তত ৫ হাজার সরকারি কর্মকর্তা আছেন এই দেশে, তার মধ্যে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল থেকে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বা কোনও কলেজের শিক্ষকও রয়েছেন।
নিজের পেশাটাই দুনিয়ার সেরা- এরকম চিন্তা বাংলাদেশের ডাক্তারদের মধ্যে প্রবল। ডাক্তাররা মনে করেন, সবাই ডাক্তার হতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে (স্কুলের বইয়ের ‘এইম ইন লাইফ’ রচনাকে সত্য মনে করে বোধহয়)। পুলিশও কিন্তু তার পেশাটিকে দেশসেবার সেরা মাধ্যম মনে করে নিয়েছে। যিনি পশুর ডাক্তার তিনিও নিজের পেশাকে ভালোবেসে দেশের সেবায় এ কাজ করছেন। যিনি সাংবাদিক, তারও চিন্তা সমাজের মানুষের উপকার করা। তাহলে কে শ্রেষ্ঠ- এই প্রশ্ন অবান্তর। কার পেশা শ্রেষ্ঠ সেদিকে না তাকিয়ে, যে যেই পেশায় জড়িত সেখানে শ্রেষ্ঠ হয়ে সবার লক্ষ হওয়া উচিত- মানুষের কাজে আসা, দেশের সেবা করা।
আলোচিত শিক্ষক-চিকিৎসকের মতো কেউ যদি শ্রেষ্ঠত্বের ইগোতে ভোগেন, সেটা তার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ছড়াতে বাধ্য। এই সোশ্যাল সাইকির প্রভাব আমরা ইতোমধ্যে দেখছি। ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে এমবিবিএস পাস ডাক্তারদের নিয়োগ দেওয়া হলেও কোনোরকমে তারা দুই বছর পার হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। প্রতিষ্ঠানটি আসলে চালায় উপ-সহকারী মেডিক্যাল অফিসার। এমবিবিএস পাস ডাক্তার মাঠে গিয়ে হতাশ হন তার থেকে ‘কম মেধার’ এসি ল্যান্ড, ইউএনও সরকারি গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরেন দেখে। অথচ এসি ল্যান্ড হওয়ার বিসিএস পরীক্ষায় তিনিও হয়তো অংশ নিয়েছেন। বুয়েট বা মেডিক্যাল কলেজ থেকে একটি বিশেষায়িত শিক্ষা নিয়ে কেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের কূটনীতিক বা প্রশাসক হতে হবে! যারা হতে চান তাদের যেমন ভুল আছে তেমনি সরকারেরও দায়িত্ব আছে পেশাগত সুযোগ-সুবিধার এসব ছোট-বড় বৈষম্য দূর করার।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বাংলাদেশের ডাক্তাররা অনেক দিন থেকে সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স নিয়ে হতাশার মধ্যে পড়ছেন। ছোটকাল থেকে সমাজ তাকে মেধাবী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর পেশাগত জীবনে এরা চারপাশের অনেকের চেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত দেখেন নিজেকে। বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের লোকদের মাতব্বরি, সুবিধা ও চাকচিক্য তাদের আরও বেশি হতাশ করে। ডাক্তাররা কঠোর পরিশ্রম করেন শিক্ষাজীবনে,পরিশ্রম করেন কর্মজীবনেও- সেই পরিশ্রমের তুলনায় তাদের প্রাপ্তি কম। সবাই ক্লিনিক খুলে বড় লোক হওয়ার চান্সও পান না। অনেক সময় নিজের ক্লাসের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ, বড়লোক সহপাঠীর হাসপাতাল-ক্লিনিকেই হয়তো তাকে চাকরি করতে হয়। রাষ্ট্র এবং সোসাইটির কাছ থেকেও যখন তারা যথাযথ সম্মান পান না, তখন মনোবেদনা থাকাটা স্বাভাবিক।
এই করোনাকালে আমাদের ডাক্তাররা, ইন্টার্নিরা তাদের জীবনবাজি রেখে মানুষের সেবা করছেন- এই কথা সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে। এটাও ঠিক, পুলিশের ভূমিকা নগণ্য নয়। এ পর্যন্ত কর্তব্যরত অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ৯১ জন পুলিশ মারা গেছেন এবং আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি। শুরুতে ডাক্তারদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টিও অবহেলা করা হয়েছে। যখন একটি পেশার লোকজন নিজের জীবন, পরিবার উপেক্ষা করে মানুষের সেবায় নেমেছে, সেখানে লকডাউনের চেকিংয়ের নামে রাস্তায় তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার না করা, মর্যাদা না দেওয়া জাতির জন্যও লজ্জার। পুলিশ যদি সেদিন শুরুতে সত্যি অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহার করে থাকেন, তা যেকোনও ডাক্তারের মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার মতোই। আমরা আবেগের ঝামেলায় ডাক্তারের কাছে যাই কিন্তু ডাক্তারদেরও আবেগ আছে। রোগীরা তাকে ঈশ্বর জ্ঞান করেন বলে অন্যরকম একটি অনুভূতির মধ্যে বসবাস করেন তারা। সেটাকে অন্যদের কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করা উচিত।
সবশেষে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই সেদিন স্পটে থাকা সেই ম্যাজিস্ট্রেটকে, যার প্রশংসনীয় ভূমিকাটি জাতির কাছে, নেটিজেনদের কাছে কোনও স্বীকৃতি পায়নি। লক্ষ করুন, মহিলা ডাক্তারটিকে ঘিরে রেখেছিল ২০-৩০ জন পুলিশ কনস্টেবল। উনি যখন তাদের বড় পুলিশ কর্তাকে অপমান করে কথা বলছেন তখন এই উত্তেজিত পুলিশ বাহিনী চিকিৎসককে আক্রমণ করার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। ঠিক ক’দিন আগেই এমন ঘটনা ঘটেছে সুপ্রিম কোর্টের গেটে। একজন আইনজীবীকে একদল পুলিশ ধাক্কা-ঘুসি মেরে অত্যাচার করেছে। সেটাও ছিল আইডি দেখানোকে কেন্দ্র করে।
এমন হাঙ্গামায় ঊর্ধ্বতন পুলিশের কর্তাদের ইশারা যেমন থাকে আবার বেশিরভাগ সময় ঘটনা তাদের কন্ট্রোলের বাইরেও চলে যায়। হ্যালমেট পরা পুলিশ চেনাও কঠিন। কিন্তু ঘটনাস্থলে উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেট বারবার অনুরোধ করে ডাক্তার ভদ্রমহিলাকে গাড়িতে তুলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। তারপর গাড়িটি সাইড করিয়েছেন। তার সঙ্গে তুলনামূলক ভালো ব্যবহার করেছেন। পরিস্থিতি লংকাকাণ্ড হওয়ার আগে সামাল দিয়েছেন। তবে ডিউটিরত অবস্থায় কেউ তাকে ফোনে মন্ত্রী ধরিয়ে দিলে কথা না বলাই ছিল উত্তম। ওপাশে প্রধানমন্ত্রী আছে বললেও তখন কারও ফোনের রেসপন্স করা অনৈতিক। এখানে শুধু জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ফোন ধরা তার জায়েজ আছে।
গত বছর যশোরের মনিরামপুরে লকডাউনের মধ্যে মাস্ক না পরায় তিন বৃদ্ধকে এক ম্যাজিস্ট্রেট কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল প্রশাসন ক্যাডারের কর্তারা। এবার পুলিশ ও ডাক্তারের বসচায় ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা তাদের স্বস্তি দিয়েছে। সে কারণে তারা ‘বিবৃতি যুদ্ধে’ নেই বলে ধরে নেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।