মূর্তি ও ভাস্কর্য বিভ্রান্তি বিড়ম্বনায় মনীষী দৃষ্টি বনাম রাজনীতির ইসলাম এবং একটি সচিত্র ভাবনা – দিপু সিদ্দিকী

দিপু সিদ্দিকী,প্রেসওয়াচঃ ভাস্কর্য শিল্প একটি দেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নানা সময়ে আবিষ্কৃত নানা ভাস্কর্য থেকে বোঝা যায়, সুদূর অতীতকাল থেকেই পৃথিবীতে ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশ ঘটেছিলো। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ভাস্কর্য পৃথিবীর ইতিহাস ও সংস্কৃতির গৌরব বহন করে চলেছে। আজো দেশে দেশে ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে নিপুণ সৃষ্টিশীলতায়। এর মাধ্যমে ফুটে উঠছে নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, ভাস্কর্য তার একটি মোক্ষম উপাদান। সবচেয়ে রক্ষণশীল মুসলিম এবং আমাদের দেশে ইসলামের আদর্শ ভূমি হিসেবে বিবেচিত সৌদি আরবে উন্মুক্ত স্থানে ভাস্কর্য রয়েছে।

মুসলিম বিশ্বও ভাস্কর্য শিল্প থেকে পৃথক নয়। খোদ সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, ইরান, ইরাকসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশেই রয়েছে ভাস্কর্য।

দেশে এখন মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে উত্তেজনা চলছে। বিষয়টির সঙ্গে হেফাজতিরা ইসলামকে জড়িয়ে ফেলেছে। তাই চলুন আমরা সূত্র ধরে দেখি এ ব্যাপারে কোরান, হাদিস, সিরাত (ইবনে হিশাম ইবনে ইবনে ইসহাক), তারিখ আল তারারি ও অন্যান্য দলিল কী বলে। ডেইলি প্রেসওয়াচ পাঠকদের সন্মুখে তা তুলে ধরেছেন দিপু সিদ্দিকী।

মুসলিম দেশে নানা রকমের ভাস্কর্য

মুসলিম দেশে নানা রকমের ভাস্কর্য।সেসব ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে ইতিহাসের বীরত্বগাথা, মনীষীদের প্রতি শ্রদ্ধা আর নিজ সংস্কৃতির নানা দিক। রয়েছে আলাদা কদর। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনাকে ইসলামের দৃষ্টিতে অনুচিত দাবি করেছেন হেফাজতে ইসলামের একাধিক নেতা৷ ছবিঘরে দেখুন তুরস্ক, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, আলজেরিয়ার মতো মুসলিমপ্রধান দেশের কিছু ভাস্কর্য।

  • Iran Corona-Pandemie | Statue mit Maske
    ইরান – গত মার্চ মাসে     তাবরিজ শহরে তোলা ছবি৷ করোনার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ভাস্কর্যের মুখেও পরানো হয়েছে মাস্ক৷

 

হাঙ্গামা করার আগে বাংলাদেশের নেতাদের ভেবে দেখা দরকার কেন মধ্যপ্রাচ্যের ইমামেরা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে নন। সৌদি আরবেও বহু ভাস্কর্য আছে। গুগল করুন ‘স্ট্যাচু ইন মুসলিম ওয়ার্ল্ড’ কিংবা ‘স্ট্যাচু ইন সৌদি আরব’– রাস্তার মোড়ে মোড়ে উটের, কবজি থেকে হাতের আঙুলের, মুসলিম বীরদের এবং আরও কত ভাস্কর্য। সেখানকার মওলানারা জানেন কোরান ও রাসুল (সা.) সুস্পষ্টভাবে প্রতিমাকে নিষিদ্ধ করে মূর্তি ও ভাস্কর্যকে বৈধ করেছেন। তাই তাঁরা মুসলিম বিশ্বে অজস্র মূর্তি ও ভাস্কর্যকে অস্বীকৃতি জানাননি।

 

  • Irak Sulaymaniyah Coronavirus

    ইরাক

    ইরাকের সুলেমানিয়া শহরের একটি ভাস্কর্য৷ করোনা ভাইরাসের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করতে ভাস্কর্যের মুখেও পরানো হয়েছে মাস্ক৷

 

  • Libanon, Beirut: Alltag - Banken und Wirtschaft

    লেবানন

    লেবাননের রাজধানী বৈরুতে সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির ভাস্কর্য৷ ২০০৫ সালে এক গাড়িবোমা বিস্ফোরণে তিনি মারা যান৷ ঘটনাস্থলেই প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর ভাস্কর্য৷

 

 

 

  • Algerien Stauten Zerstörung durch Islamisten

    আলজেরিয়া

    আলজেরিয়ার সেতিফ শহরে আইন-আল-ফাওয়ারার ভাস্কর্য৷

     

  • BdTD Libanon Statue Hafenexplosion

    লেবানন

    বৈরুতে কাঁচ এবং বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে তৈরি একটি ভাস্কর্য৷গত ৪ আগস্ট ভয়াবহ রাসায়নিক বিস্ফোরণে যে ভবনগুলো ধ্বংস হয় সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ ব্যবহার করে ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন লেবাননের শিল্পী হায়াত নাজের৷ সরকারবিরোধী আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এটি তৈরি করেছেন তিনি৷

     

     

 

‘হিজিবিজি’ ও ভাস্কর্য প্রসঙ্গঃ

জনপ্রিয় কথা সাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদ সাধারণত ধর্ম কিংবা রাষ্ট্রের আলোচিত কোন বিষয়ে তেমন মুখ খুলতেন না। কিন্তু তিনি তাঁর ‘হিজিবিজি’ বইতে ভাস্কর্য নিয়ে ‘এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব?’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন। সেই প্রবন্ধটি এখানে হুবহু তুলে ধরছি:

“মাদ্রাসার কিছু ছাত্র হইচই করেছে, সঙ্গে সঙ্গে সরকার নতজানু। সরকার জনতার চেতনারই ছায়া, কাজেই আমরাও নতজানু। ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। হুংকার শুনছি–সব ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হবে। শিখা অনির্বাণ নিভিয়ে দেওয়া হবে।
সরকার দেরি করছে কেন? শিখা অনির্বাণ নিভিয়ে অন্ধকারে প্রবেশ করলেই হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের দরজা-জানালা এখনই সিল করে দেওয়া দরকার।
মাদ্রাসার যেসব বালক না বুঝেই হইচই করছে, তাদের কিছু ঘটনা বলতে চাচ্ছিলাম। তাদের না বলে আমি বর্তমান সরকারের সদস্যদের ঘটনাগুলো বলতে চাচ্ছি। তারা কি শুনবেন?

  • Flash-Galerie Obama besucht Indonesien

    ইন্দোনেশিয়া

    সবচেয়ে বেশি মুসলিমের বাস যে দেশে, সেই ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শৈশবের ভাস্কর্য৷

     

আমাদের মহানবী (সা.) কাবা শরিফের ৩৬০টি মূর্তি অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেয়ালের সব ফ্রেসকো নষ্ট করার কথাও তিনি বললেন। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল কাবার মাঝখানের একটি স্তম্ভে, যেখানে বাইজেন্টাইন যুগের মাদার মেরির একটি অপূর্ব ছবি আঁকা। নবীজি (সা.) সেখানে হাত রাখলেন এবং বললেন, এই ছবিটা তোমরা নষ্ট কোরো না। কাজটি তিনি করলেন সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর অসীম মমতা থেকে। মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের পরেও ৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ খলিফাদের যুগে কাবা শরিফের মতো পবিত্র স্থানে এই ছবি ছিল, এতে কাবা শরিফের পবিত্রতা ও শালীনতা ক্ষুণ্ন হয় নি।
মহানবীর (সা.) প্রথম জীবনীকার ইবনে ইসহাকের (আরব ইতিহাসবিদ, জন্ম : ৭০৪ খ্রিষ্টাব্দ, মদিনা; মৃত্যু: ৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দ, বাগদাদ) লেখা দি লাইফ অব মোহাম্মদ গ্রন্থ থেকে ঘটনাটি বললাম। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বইটি অনুবাদ করেছেন আলফ্রেড গিয়োম প্রকাশকাল ২০০৬, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৫২)।
  • Iran | Statue von Abu Dschafar Muhammad ibn Muhammad Nasir ad-Din at-Tusi

    ইরান

    ইরানে কিংবদন্তি মুসলিম বিজ্ঞানী আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আদ-দীন-তুসির ভাস্কর্য৷

আমরা সবাই জানি, হজরত আয়েশা (রা.) নয় বছর বয়সে নবীজির (সা.) সহধর্মিণী হন। তিনি পুতুল নিয়ে খেলতেন। নবীজির তাতে কোনো আপত্তি ছিল না; বরং তিনিও মজা পেতেন এবং কৌতূহল প্রদর্শন করতেন। (মুহাম্মদ আলী আল সাবুনী, রাওযাইউল বয়ন, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৩)।
৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত ওমর (রা.) জেরুজালেম জয় করেন। প্রাণীর ছবিসহ একটি ধূপদানি তার হাতে আসে। তিনি সেটি মসজিদ-ই-নববিতে ব্যবহারের জন্যে আদেশ দেন। (আব্দুল বাছির, ইসলাম ও ভাস্কর্য শিল্প : বিরোধ ও সমন্বয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদ পত্রিকা, জুলাই ২০০৫ জুন ২০০৬)
  • Türkei Referendum Wahllokal in Istanbul

    তুরস্ক

    ইস্তাম্বুলে আধুনিক তুরস্কের স্থপতি কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য৷

  • Papst Franziskus besucht die Türkei 28.11.2014 Kirche in Istanbul

    তুরস্ক

    ইস্তাম্বুলে সেন্ট আনতুয়ান ক্যাথলিক চার্চের বাইরে পোপ জন পল ২৩-এর ভাষ্কর্য৷

  • Die Statue von Ghaemmagham Farahani in Teheran

    ইরান

    রাজধানী তেহরানে ঘায়েম মাঘাম ফারাহানির ভাষ্কর্য৷১৮৩৫ সালে মারা গেলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজসংস্কারক ফারাহানিকে এখনো এভাবে জনজীবনের অংশ করে রেখেছে ইরান৷

     

    আঙ্কারায় বঙ্গবন্ধু, ঢাকায় কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য বসছে

     

তুরস্কে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ।
পারস্যের কবি শেখ সাদিকে কি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু আছে? উনি হচ্ছেন সেই মানুষ, যার নাত এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মিলাদে সবসময় পাঠ করে থাকেন।
বালাগাল উলা বি কামালিহি
কাশাফাদ্দুজা বি জামালিহি..
মাদ্রাসার উত্তেজিত বালকেরা শুনলে হয়তো মন খারাপ করবে যে, শেখ সাদির মাজারের সামনেই তাঁর একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য আছে। সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা তা ভাঙে নি।
ইসলামের দুজন মহান সুফিসাধক, যাদের বাস ছিল পারস্যে (বর্তমান ইরান) এঁদের একজনের নাম জালালুদ্দিন রুমি। অন্যজন ফরিদউদ্দিন আত্তার (নিশাপুর)। তার মাজারের সামনেও তাঁর আবক্ষমূর্তি আছে। (বরফ ও বিপ্লবের দেশে, ড. আবদুস সবুর খান, সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)
কঠিন ইসলামিক দেশের একটির নাম লিবিয়া। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে বিশাল একটি মসজিদ আছে। মসজিদের সামনেই গ্রিকদের তৈরি একটি মূর্তি স্বমহিমায় শোভা পাচ্ছে। সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা মূর্তিটি ভেঙে ফেলে নি।
আফগানিস্তানের তালেবানরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি (যা ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ) ভেঙে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। আমরা ভাঙছি সাঁইজির মূর্তি, যাঁর জীবনের সাধনাই ছিল–আল্লাহর অনুসন্ধান।
মাওলা বলে ভাব রসনা,
গেল দিন, ছাড় বিষয় বাসনা
যেদিন সাঁই হিসাব নিবে
আগুন পানি তুফান হবে
এই বিষয় তোর কোথায় রবে?
একবার ভেবে দেখ না।
–লালন শাহ
দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে আমার দম বন্ধ লাগছে। কীভাবে প্রতিবাদ করব তা-ও বুঝতে পারছি না। একজন লেখকের দৌড় তার লেখা পর্যন্ত। বিটিভিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের গাথা জোছনা ও জননীর গল্প প্রচার হচ্ছে। প্রতিবাদ হিসেবে এই গাথার প্রচার আমি বন্ধ করলাম। দেশ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার জন্যে এখনো তৈরি না।
বাংলাদেশে তো অনেক বড় বড় ইসলামি পণ্ডিত আছেন। তাঁরা কেন চুপ করে আছেন? তারা কেন পূজার মূর্তি এবং ভাস্কর্যের ব্যাপারটি সবাইকে বুঝিয়ে বলছেন না?
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের মতো বুদ্ধিমান কোনো প্রাণীর সন্ধান এখনো পাওয়া যায় নি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় অতি তুচ্ছ এই প্রাণী নিজের মেধায় সৃষ্টিরহস্যের সমাধানের দিকে এগোচ্ছে। তার পরিচয় সে রেখে যাচ্ছে কাব্যে, সাহিত্যে, সংগীতে শিল্পকলায়। মাত্র সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার এই প্রাণী তার দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। মানুষের সৃষ্টির প্রতি সম্মান দেখানো মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতিই সম্মান দেখানো। কারণ সব সৃষ্টির মূলে তিনি বাস করেন।
এ দুর্ভাগা দেশ হতে, হে মঙ্গলময়
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়—
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর
দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার।
এই চিরপেষণ যন্ত্রণা, ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি, দহগু পলে পলে
এই আত্ম অপমান, অন্তরে বাহিরে
এই দাসত্বের রজ্জু, ত্রস্ত নতশিরে
সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারম্বার
মনুষ্য মর্যাদাগর্ব চিরপরিহার
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গল-প্রভাতে
 মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক-মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে।
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”

এবারে কোরান। কোরানে সুস্পষ্ট বলা আছে: (ক.) মূর্তিপূজা শয়তানের কাজ (মায়েদা ৯০) এবং (খ.) “এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ?” (আম্বিয়া ৫২)।

অর্থাৎ কোরানের নিষেধ মূর্তিপূজা, উপাসনা-আরাধনা-ইবাদত সম্পর্কে। কারণ, মূর্তি স্রষ্টার অংশীদার অর্থাৎ শরিক হয়ে দাঁড়ায়। এটাই মানুষকে মুশরিক বানায়। তাহলে যে মূর্তিকে আরাধনা ইবাদত করা হয় না, যে মূর্তি সৌন্দর্য্য বাড়ায়, সুসজ্জিত করে সে ব্যাপারে কোরান কী বলে? এখানে আমরা অবাক হয়ে দেখব কোরান সুস্পষ্ট ভাষায় ভাস্কর্যের অনুমতি দেয়। উদ্ধৃতি:

“তারা সোলায়মানের (আ.) ইচ্ছানুযায়ী দূর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত।” (সুরা সাবা, আয়াত ১৩)

নবীজি (সা.) মূর্তি-ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সেটা কোরানের ওই আয়াতের বিরুদ্ধে যেত, সেটা সম্ভব নয়। আরাধনা করলে সেটা হয় প্রতিমা আর না করলে হয় ভাস্কর্য (মূর্তি)। ইসলাম প্রতিমার বিরুদ্ধে, ভাস্কর্য ও মূর্তির বিরুদ্ধে নয়।

আদি থেকে মানুষ স্রষ্টা খুঁজেছে, সূর্য-চন্দ্র থেকে শুরু করে পশু-পাখিকে, এমনকি নিজেরাই মূর্তি বানিয়ে আরাধনা করেছে। যে হযরত মুসা (আ.) মানুষকে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্রষ্টার দিকে ডেকেছেন তাঁর বিশ্বাসীরা বাছুরের মূর্তির আরাধনা করেছে। যে ঈসা (আ.) মানুষকে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্রষ্টার দিকে ডেকেছেন তাঁর বিশ্বাসীরা তাঁর তো বটেই, তাঁর মায়েরও (মাতা মেরি) মূর্তি বানিয়ে আরাধনা শুরু করেছে। যে গৌতম বুদ্ধ স্রষ্টার ধারণা ত্যাগ করে কর্মফলের কথা বলেছেন, তাঁর অনুসারীরা তাঁর মূর্তি বানিয়ে আরাধনা শুরু করেছে। এখানেই ইসলামের আপত্তি: ইসলাম আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক বা অংশীদার করার ঘোর বিপক্ষে।

তাই হয়তো অতীত বর্তমানের কিছু ইমাম সরাসরি মূর্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, প্রতিমা ও ভাস্কর্যের পার্থক্য উপেক্ষা করছেন। ইমামেরা প্রতিমার বিরুদ্ধে বলুন অসুবিধা নেই, কিন্তু ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সেটা কোরান-রাসুলের (সা.) বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হয় কি না, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন।

 

(ক) সহি বুখারি ৮ম খণ্ড হাদিস ১৫১:
আয়েশা বলিয়াছেন, আমি রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুলগুলি লইয়া খেলিতাম এবং আমার বান্ধবীরাও আমার সহিত খেলিত। যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার খেলাঘরে প্রবেশ করিতেন, তাহারা লুকাইয়া যাইত, কিন্তু রাসুল (সা.) তাহাদিগকে ডাকিয়া আমার সহিত খেলিতে বলিতেন।

(খ) সহি আবু দাউদ বুক ৪১ হাদিস নং ৪৯১৪:
বিশ্বাসীদের মাতা আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন, যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) তাবুক অথবা খাইবার যুদ্ধ হইতে ফিরিলেন তখন বাতাসে তাঁহার কক্ষের সামনের পর্দা সরিয়ে গেলে তাঁহার কিছু পুতুল দেখা গেল। তিনি [(রাসুল (সা.)] বলিলেন, “এইগুলি কী?” তিনি বলিলেন, “আমার পুতুল।” ওইগুলির মধ্যে তিনি দেখিলেন একটি ঘোড়া যাহার ডানা কাপড় দিয়া বানানো হইয়াছে এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি যাহা উহার উপর রহিয়াছে?” তিনি উত্তরে বলিলেন, “দুইটি ডানা।” তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডানাওয়ালা ঘোড়া?” তিনি উত্তরে বলিলেন, “আপনি কি শোনেননি যে সুলেমানের ডানাওয়ালা ঘোড়া ছিল?” তিনি বলিয়েছেন, ইহাতে আল্লাহর রাসুল (সা.) এমন অট্টহাসি হাসিলেন যে আমি উনার মাড়ির দাঁত দেখিতে পাইলাম।”

(গ) সহি মুসলিম – বুক ০০৮, নং ৩৩১১:
আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন যে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁহাকে সাত বৎসর বয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন (যদিও অন্য রেওয়াতে আমরা পাই ছয় বছর: হাসান মাহমুদ) এবং তাঁহাকে নয় বৎসর বয়সে কনে হিসেবে তাঁহার বাসায় লইয়া যাওয়া হয়, এবং তাঁহার পুতুলগুলি তাঁহার সাথে ছিল এবং যখন তিনি দেহত্যাগ করিলেন তখন তাঁহার বয়স ছিল আঠারো।

(ঘ) সহি মুসলিম – বুক ০৩১ নং ৫৯৮১:
আয়েশা (রা.) বলিয়াছেন যে তিনি আল্লাহর রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুল লইয়া খেলিতেন এবং যখন তাঁহার সঙ্গিনীরা তাঁহার কাছে আসিত তখন তাহারা চলিয়া যাইত। কারণ তাহারা আল্লাহর রাসুলের (সা.) জন্য লজ্জা পাইত। যদিও আল্লাহর রাসুল (সা.) তাহাদিগকে তাঁহার কাছে পাঠাইয়া দিতেন।

সহি বুখারির ব্যাখ্যা শুনুন। হাদিসটার ফুটনোটে ‘ফতহুল বারি’র লেখক ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর উদ্ধৃতি: “পুতুল ও একই রকম ইমেজ অবৈধ কিন্তু ইহা বৈধ করা হইয়াছিল তখন আয়েশার (রা.) জন্য। কারণ তিনি ছিলেন ছোট বালিকা, তখনও তিনি বয়স্কা হননি।” (ফতহুল বারি, পৃষ্ঠা ১৪৩, ১৩ খণ্ড)

নবী (সা.) পুতুল বৈধ করেছিলেন এটাই আসল কথা। কী কারণে করেছিলেন সেটা ইমামের জানা সম্ভব নয়। কারণ তিনি রাসুলের (সা.) ৮০০ বছর পরের হাজার মাইল দূরে মিসরের লোক, রাসুলের (সা.) সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি। ওটা তাঁর ব্যক্তিগত মত মাত্র।

এবারে আরও কিছু সংশ্লিষ্ট দলিল।

তখন কাবার দেয়ালে ৩৬০টি মূর্তি (বুখারি ৩য় খণ্ড – ৬৫৮) ও অনেক ছবির সঙ্গে ছিল হযরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবিও। উদ্ধৃতি দিচ্ছি, “রাসুল (সা.) হযরত ঈসা (আ.) ও মাতা মেরির ছবি বাদে বাকি সব ছবি মুছিয়া ফেলিতে নির্দেশ দিলেন।” (সিরাত (ইবনে হিশাম/ইবনে ইশাক-এর পৃষ্ঠা ৫৫২)

এবারে সাহাবি ও খলিফারা।

দুনিয়ার প্রায় এক চতুর্থাংশ জয় করেছিলেন মুসলিমরা। সবই অমুসলিমের দেশ এবং সেখানেও নিশ্চয়ই অনেক প্রতিমা-ভাস্কর্য ছিল, সেগুলোর তো সবই ভেঙে দেওয়ার কথা। কিন্তু সেখানেও আমরা তেমন দলিল পাই না। ৭১০ সালে হিন্দু রাজা দাহিরের দেশ সিন্ধু জয় করার পর কয়টা মূর্তি ভেঙেছিলেন মুহম্মদ বিন কাশেম? ভাস্কর্য-মূর্তি তো দূরের কথা কোনো প্রতিমাও ভেঙেছেন বলে জানা যায় না।

রাসুলের (সা.) অজস্র ছবি স্বচক্ষে দেখতে চাইলে ইরানে চলে যান। দেখবেন দেয়ালে ঝুলানো সুদৃশ্য কার্পেটে আছে মা আমিনার কোলে শিশু নবী (সা.), সাহাবি পরিবেষ্টিত নবীজি (সা.), আসমানে বোরাখে উপবিষ্ট নবীজি (সা.) ইত্যাদি।

এবারে সাম্প্রতিক কাল। ছবি তো ছবি, নবীজির (সা.) আট ফুট উঁচু, ১০০০ পাউণ্ড ওজনের মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যও ছিল দীর্ঘ ৫৩ বছর। ১৯০২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ২৫ নং স্ট্রিট ম্যাডিসন এভিনিউতে অবস্থিত ম্যাডিসন পার্কের মুখোমুখি নিউইয়র্ক আপিল বিভাগের কোর্ট দালানের ছাদে। ইতিহাসের আরও নয়জন আইনদাতাদের সঙ্গে নবীজির (সা.) আট ফুট উঁচু মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যও রাখা ছিল সসম্মানে।

গুগলে ‘এ স্ট্যাচু অব মুহাম্মদ’ সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। মুসলিম সমাজ ও দেশগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষিতে ওটা সরানো হয়েছে। এখন ইতিহাসের বাকি নয়জন আইনদাতার ভাস্কর্য রাখা আছে। কোর্টের ভেতরের দেয়ালে ওই দশজনের সঙ্গে তাঁর ভাস্কর্য এখনও আছে কি না জানি না। ওটার ছবি এখনও আছে কি না জানি না।

বাংলাদেশে ভাস্কর্য – খবরঃ দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামা, মাশায়েখ ও মুফতিরা এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মানুষ বা অন্য যে কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য অথবা মূর্তি নির্মাণ, স্থাপন ও সংরক্ষণ পূজার উদ্দেশ্যে না হলেও সন্দেহাতীতভাবে নাজায়েজ, স্পষ্ট হারাম এবং কঠোরতম আজাবযোগ্য গুনাহ। আর যদি পূজার উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে তা স্পষ্ট শিরক।

জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় আটক ৪প্রয়োজনীয় বাংলা বই -T@NB!R: বাংলাদেশের সকল ঐতিহাসিক স্থান ,ভাস্কর্য ও  গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা [ এদের স্থান - স্থপতি (শিল্পী)-সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ...

এ ধরনের শরিয়তবিরোধী কাজ মুসলমানদের জন্য অনুসরণযোগ্য নয়। যারা বলছেন মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়, তারা ভুল বলছেন। সত্যকে গোপন করছেন। এটি কোরআন ও সুন্নাহকে অমান্য করা। অন্য কোনো মুসলিম দেশে ভাস্কর্য থাকলেও উদাহরণ দিয়ে ভাস্কর্যকে জায়েজ করা যাবে না।

বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে একটি বিবৃতি উপস্থাপন করা হয়। সেখানে সই করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ দেশের ৯৫ জন শীর্ষ মুফতি।মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি প্রকল্পে এবার ভাস্কর্য হবে ব্রোঞ্জের

উলামা-মাশায়েখদের পক্ষে এটি প্রকাশ করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরার প্রিন্সিপাল মুফতি আরশাদ ও মাওলানা মাহফুজুল হক। এর আগে বুধবার ঢাকার বসুন্ধরায় ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে দেশের শীর্ষ মুফতিদের উপস্থিতিতে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এই বিবৃতি তৈরি করা হয়।সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরার মুফতি এনামুল হক কাসেমী। উপস্থিত ছিলেন- আল্লামা হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জি হুজুর, আল্লামা আব্দুল হামিদ পির সাহেব মধুপুর, হেফাজত ইসলামের নায়েবে আমির আব্দুর রব ইউসুফী, মুফতি আরশাদ রহমানী বসুন্ধরা, মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদপুর, মুফতি মাহফুজুল হক প্রমুখ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী ও মুফতি এনামুল হক বসুন্ধরা।ধোলাইরপাড় চত্বরে ভাস্কর্য তৈরির বিপক্ষে ইসলামপন্থী দলগুলো ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ করেছে।

সেখানে বলা হয়েছে, ইসলামের সুস্পষ্ট বিধানকে পাশ কাটিয়ে প্রাণীর ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে পার্থক্য করে প্রাণীর ভাস্কর্যকে বৈধ বলা সত্য গোপন করা এবং কোরআন ও সুন্নাহর বিধান অমান্য করার নামান্তর। উপরন্তু, কোরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বিধানের সামনে বিভিন্ন দেশের ভাস্কর্য ও মূর্তির উপমা টেনে আনা ইসলামের একটি অকাট্য বিধানের অবজ্ঞা করার শামিল।

কোনো মুসলিম দেশের শাসকদের শরিয়তবিরোধী কাজ মুসলমানদের জন্য অনুসরণযোগ্য নয়। তাদের জন্য একমাত্র অনুসরণীয় হচ্ছে কোরআন, সুন্নাহ ও ইসলামি শরিয়ত। এ বিষয়ে মুফতিগণ সর্বসম্মতিক্রমে এ রায় দিয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়।ইত্তেফাক রিপোর্ট০২:৫১, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২০।

এটাই রাজনীতির ইসলাম  ??

কৃতজ্ঞতা ও সুত্র-
Dhaka University Literature Society – DULS,ফাহিম ইসলাম, হাসান মাহমুদ ,গুগুল।
Share: