দিপু সিদ্দিকীঃ চূড়ান্ত হচ্ছে না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। খসড়া নীতিমালার বিভিন্ন অংশ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদদের আপত্তির কারণে তা ঝুলে আছে। বিধিমালার ত্রুটি-বিচ্যুতি মাথায় রেখেই বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন রাজউক চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম।
রাজউক সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি এই বিধিমালা চূড়ান্ত করার জন্য একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এমন সংবাদে নগর পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তারা জানিয়েছেন, বিধিমালাটি এখন যে পর্যায়ে আছে তা পরিপক্ব নয়। এটি চূড়ান্ত করা হলে তা আধুনিক নগর গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এমন আপত্তির পর বিষয়টি আমলে নেয় কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণের জন্য ২০০৮ সালের যে বিধিমালা রয়েছে আমরা সেটা সংশোধন করে চূড়ান্ত করবো। এ নিয়ে এখনও অনেক কাজ বাকি। সব পক্ষের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) সম্পৃক্ততা রয়েছে।
বর্তমানে রাজউক জনমত গ্রহণের যে খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করেছে তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাদের মতে, প্রস্তাবিত এই বিধিমালায় ভবন নির্মাণে জোনভিত্তিক পরিকল্পনা বিবেচনা করা হয়নি। তারা বলছেন, নগরীতে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) অনুযায়ী ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। সব এলাকায় একই ‘ফার’ হওয়া উচিত নয়। বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তাদের মতে, ড্যাপ চূড়ান্তের আগে তড়িঘড়ি করে এই বিধিমালা প্রকাশের উদ্দেশ্যও প্রশ্নবিদ্ধ।
যেকোনও শহরের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় রাস্তাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকার ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮-এ ভবনের উচ্চতা নির্ধারণে রাস্তার প্রস্থ বাদ রাখা হয়েছে। জমি ছাড়লেই উঁচু ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। এতে অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদির ভিত্তিকে এলাকাভিত্তিক ভারবহন ক্ষমতাকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। সুউচ্চ ফ্লোর এরিয়া অনুপাত (এফএআর) প্রস্তাব করার ফলে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব ক্রমে বেড়েই চলবে। তাছাড়া, একটি ভবনে আলো-বাতাস প্রবেশেরও পর্যাপ্ত সুযোগ নেই এই বিধিমালায়। এতে রাজধানী ঢাকা দিন দিন আরও বাসের অযোগ্য হবে। নতুন বিধিমালায় এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে এফএআর প্রয়োগ অন্যতম। সারা শহরের জন্য একই ধরনের উচ্চ এফএআর মান ঢাকার জনঘনত্বকে অব্যবস্থাপনযোগ্য করে তুলেছে। এর মান নির্ধারণ করতে হয় পরিবহন সক্ষমতা, অবকাঠামো ও নাগরিক সেবার সংস্থানের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ঢাকার ভারবহন ক্ষমতাকে বিবেচনায় না নিয়ে সকল এলাকা নির্বিশেষে উঁচুমানের এফএআর প্রবর্তন করার ফলে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বাস করবে শহরে। ফলশ্রুতিতে পরিবহন ব্যবস্থা, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সামাজিক, পার্ক-উদ্যান-খেলার মাঠ ও অন্যান্য নাগরিক সেবা অপ্রতুল হয়ে পড়েছে।
নতুন এই নীতিমালায় ভবনে আলো-বাতাস প্রবেশের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়নি বলেও জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, এই বিধিমালায় অঞ্চলভিত্তিক কোনও ভিন্নতা নেই। সড়কের প্রস্থ বিবেচনায় না নেওয়ায় যানজটসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান হবে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুরো ঢাকা শহরের জন্য একই ফার তথা ফ্লোর এরিয়া রেশিও হতে পারে না। যে এলাকায় জনঘনত্ব বেশি সেখানে ফার কম হবে, আর ঘনত্ব কম হলে ফার বেশি হবে। এই বিষয়গুলো নতুন বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। আশা করছি রাজউক এটা বিবেচনা করবে।’
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, ছয় মিটার রাস্তার পাশে দুই কাঠা জমিতে সর্বোচ্চ পাঁচতলা ভবন নির্মাণের সুযোগ ছিল। ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় একই পরিমাণ জমিতে নয়তলা ভবন তৈরির সুযোগ রয়েছে। নতুন বিধিমালার খসড়াতেও সেটা রাখা হয়েছে। এই বিধিমালা উদ্বেগজনক। এটা কোনোভাবেই আধুনিক শহর গড়ার জন্য ইতিবাচক হতে পারে না।
তার মতে, বর্তমান নীতিমালায় কোনোভাবেই ভবনে আলো-বাতাস প্রবেশ করবে না। এতে জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত হবে। এই বিধিমালা নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) সঙ্গে এর সামঞ্জস্য রাখার দরকার আছে।
বিআইপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার অতিঘন এলাকায় ব্যক্তিগত মালিকানায় ১, ২ বা ৩ তলাবিশিষ্ট ভবনের সংখ্যা শতকরা ৪০-৫০ ভাগ। যেগুলো বিদ্যমান ইমারত সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী ভবিষ্যতে পুনঃউন্নয়ন করা হলে এসব এলাকার জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বাসযোগ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।