চীন-ভারত সমঝোতা বাস্তবায়ন নিয়ে ধোঁয়াশা, আরও বড় সংঘাতের আশঙ্কা

চীন-ভারত সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ৫ দফা সমঝোতা হলেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ী উভয় দেশই। দুই পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ তুলছে। দুই পক্ষই দাবি করছে, তারা যুদ্ধ চায় না। তবে কেউ কাউকে হুমকি দিতে ছাড়ছে না। সমঝোতার পরও দুই দেশের সংবাদমাধ্যমেই সম্ভাব্য ‘সামরিক হস্তক্ষেপের’ কথা এসেছে জোরেশোরে।

কয়েক মাস ধরে পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা এবং প্যাংগং সরোবরের দক্ষিণ তীরে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর ভারত দাবি করে, চীনা সেনারা ভারতের সামরিক ঘাঁটি দখলের চেষ্টা করলে বাধা পেয়ে শূন্যে গুলি চালায় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি। ১৯৭৫ সালের পরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় এটাই প্রথম গুলির ঘটনা। অপরদিকে চীনের দাবি, ভারতই উসকানিমূলক আচরণ করেছে।

চলমান উত্তেজনার মধ্যে ১০ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন সম্মেলনের ফাঁকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়্যাং ইয়ির সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের প্রায় আড়াই ঘণ্টা আলোচনা হয়।

বৈঠকের পরে যৌথ বিবৃতিতে ভারত ও চীন সরকারের তরফে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে জানানো হয়। বলা হয়, দুই দেশের নেতাদের চেষ্টায় গড়ে ওঠা দ্বিপাক্ষিক সম্প্রীতি ক্ষুণ্নকারী পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে দুই পক্ষই। বিশেষত সতর্ক থাকতে হবে যেন মতানৈক্য কোনোভাবেই চূড়ান্ত পর্যায়ে না পৌঁছায়।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিদ্ধান্তে পৌঁছান, সীমান্ত সমস্যা কোনও পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়। আর সে কারণেই চীন ও ভারত সামরিক পর্যায়ে বৈঠকের ভিত্তিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে অতিরিক্ত সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। সেই সঙ্গে দুই পক্ষের সেনা ঘাঁটির মাঝে ব্যবধান বাড়িয়ে উত্তেজনা প্রশমনের সিদ্ধান্তও হয় বৈঠকে।

সমঝোতা হলেও তা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কিনা তা নিয়ে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস-এ বলা হয়, দোকলাম সীমান্তে উত্তেজনার পর চীনা ও ভারতীয় নেতাদের মধ্যে অনেকবারই বৈঠক হয়েছে। তাদের মধ্যে সমঝোতাও হয়েছিল। তারপরও আবার সীমান্ত সংঘাত হতে দেখা গেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জুনে দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে এবং সোমবার ভারতীয় সেনারা চীনা সেনাদের প্রতি হুঁশিয়ারিমূলক গুলি ছুড়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি বারবারই এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সমঝোতা বাস্তবায়নের ব্যাপারে জনগণ আস্থা হারিয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘চীন ও ভারতের মধ্যকার মূল সমস্যাই হলো মৌলিকভাবে পারস্পরিক আস্থার সংকট। জাতীয়ভাবে চীন ও ভারতের মধ্যকার শক্তির ব্যবধান ১৯৬২ সালের তুলনায় অনেক বেশি। ভারতের আধিপত্যবাদের ধারণাটি তৈরি হয়েছে সে দেশের ভূরাজনৈতিক প্রভাবজনিত সক্ষমতা থেকে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া ভারতের মন জিতে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। নয়াদিল্লি বিশ্বাস করে, বেইজিং এ ব্যাপারে ভীত। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে চীনকে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রেখেছে।

গ্লোবাল টাইমস-এর দাবি, চীন আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাতের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতির সংযোগ তৈরি করতে চাইছে দিল্লি। একে জুয়াখেলা হিসেবে অভিহিত করেছে সংবাদমাধ্যমটি। তারা হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘আমাদের শক্তির কার্যকর ব্যবহার অপরিহার্য। আমাদের অবশ্যই সীমান্ত ইস্যুতে ভারতের ঝুঁকিপূর্ণ জুয়াখেলার মূল্য আরও বেশি করে দিতে হবে। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, যেন সে আলোচনা ব্যর্থ হলে আমরা সামরিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের ভ্রমকে পুরোপুরিভাবে পরাজিত করতে পারি।’

প্রতিবেদনে ভারতকে সতর্ক করে আরও বলা হয়, ‘আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রশান্তি বজায় রাখতে কোনও মূল্যই খুব বেশি নয়। এটি কোনও স্লোগান নয়, এটি আমাদের সত্যিকারের চাওয়া। চীনা জনগণ শান্তি ভালোবাসে। তবে প্রয়োজন হলে আমরা লড়াইয়ের জন্যও প্রস্তুত। এটি কেবল বহির্বিশ্বকে হুঁশিয়ার করার জন্য বলা কথা নয়, বরং এটাই চীন।’

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে দুই দেশের সেনারা খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে উল্লেখ করে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সমঝোতা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি না হলে সংঘাতের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সীমান্ত পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে আগাম অনুমান করাটা কঠিন কাজ। তবে মনে হচ্ছে বড় ধরনের একটি সংঘর্ষ শুরু হওয়াটা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

ভারতের জ্যেষ্ঠ সরকারি সূত্রকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কোনও জায়গাতেই ভারতীয় সেনাদের প্রস্তুতির ঘাটতি’ রাখা হয়নি। এছাড়া সীমান্ত পরিস্থিতি সামলাতে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টিও আলোচনার টেবিলে রাখা আছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্ত পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তার জন্য ভারত-চীন সেনা কমান্ডার পর্যায়ের পরবর্তী বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।

Share: