ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন উদার মানবিক ছিলেন ফাহিম

নিউ ইয়র্কের প্রযুক্তি জগতে খুব একটা পরিচিত ছিলেন না বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং পাঠাও-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ। কিন্তু তাকে হত্যার ঘটনায় সব জায়গায় বেদনায় ভরে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া ও কলম্বিয়ায় তা খুব বেশি। এসব দেশে তার বিনিয়োগ দেখিয়েছে উদ্ভাবনী পথ। সৃষ্টি হয়েছে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। কিন্তু নিউ ইয়র্কে নিজের বিলাসবহুল এপার্টমেন্টে তাকে হত্যা করেছে তারই সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস হ্যাসপিল। ফাহিম সালেহ নাইজেরিয়াতে রাইড শেয়ারিং গোকাদা’র নির্বাহী। এ ছাড়া চমৎকার একজন উদ্যমী ব্যক্তি ছিলেন তিনি।

তিনি ও তার খুনি দু’জনেই মেধাবী। দু’জনেই অল্প বয়সে মেধার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের ভিতরে থাকা উদ্যোক্তা শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত ‘এ ইয়াং সিইও, অ্যান এক্স-এসিসট্যান্ট এন্ড এ গ্রিসলি মার্ডার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে মানবতাবাদী ফাহিম সালেহকে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের টগবগে এক গ্রীষ্মের দিকে ঢাকায় একটি অফিসের জন্য স্থান খুঁজছিলেন ফাহিম সালেহ। এ সময় রাস্তার একটি তৃষ্ণার্ত শিশু তার দিকে এগিয়ে যায়। এতে সালেহ এতটাই আবেগতাড়িত হয়েছিলেন যে, তিনি যত বোতল সম্ভব পানি কিনে তাতে সোডা মিশ্রতি করে বিলি করেছেন রাস্তায় মানুষের মাঝে। এই বৈশ্বিক উদ্যোক্তা ও যৌথ বাণিজ্যের তরুণ এতটাই উদার ছিলেন বলে তার বন্ধু ও সহকর্মীরা বলছেন। তিনি তরুণকে কাজের সুযোগ দিতেন। মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি এমন তরুণদের পথ দেখিয়েছেন। নাইজেরিয়া ও কলম্বিয়ার মতো দেশের উদীয়মান বাজারে তাদেরকে পথ দেখিয়েছেন তিনি। নিউ ইয়র্ক সিটিতে তার এক বন্ধু শাকিব জামাল বলেছেন, মানুষকে সাহায্য করে, তাদেরকে বিস্মিত করে দিয়ে অসীম আনন্দ পেতেন ফাহিম সালেহ। এ মাসের শুরুর দিকে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে নিজের এপার্টমেন্টে ৩৩ বছর বয়সী ফাহিম সালেহকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে তারই সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস হ্যাসপিল। ফাহিম সালেহ নাইজেরিয়ায় রাইড শেয়ারিং গোকাদা’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাকে হত্যার জন্য হ্যাসপিলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দারা বলেছেন, ফাহিম সালেহর ব্যাংক একাউন্ট থেকে প্রায় ৯০ হাজার ডলার আত্মসাৎ করেছে হ্যাসপিল। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ফাহিম সালেহকে হত্যা করা হয়েছে। ফাহিম সালেহ আত্মসাতের ঘটনা ধরতে পারায় তিনি হ্যাসপিলকে পুলিশে না দিয়ে, তাকে অর্থ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছিলেন। এই মানবতা দেখানোর কারণে ফাহিম সালেহকে হত্যা করেছে হ্যাসপিল।

ওদিকে গত সপ্তাহে হ্যাসপিলের আইনজীবীরা তাদের মক্কেলকে নির্দোষ দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, পুলিশ যে কথা বলে তাকে গ্রেপ্তার করেছে, তার বিরুদ্ধে ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি যে অভিযোগ গঠন করেছে সেখানে আরো অনেক কিছু বলার আছে। এ বিষয়ে ফাহিম সালেহর পরিবার মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। গোকাদা’র এক মুখপাত্র বলেছেন, গোকাদা’র কোনো কর্মচারী বা এর সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না হ্যাসপিল। এখনো ফাহিম সালেহ ও তার খুনি হ্যাসপিলের বন্ধুরা তাদের মধ্যকার সম্পর্ক কি ছিল তা বোঝার চেষ্টা করছেন। ফাহিম সালেহর কিছু বন্ধু ও কানেক সহকর্মী বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের আগে কখনো তারা হ্যাসপিলের নাম শোনেননি। আবার হ্যাসপিল সম্পর্কে যারা অবগত তারা তাকে সালেহর জীবনে একজন ‘পেরিফেরাল পারসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট। ফাহিম সালেহ ও টাইরেস হ্যাসপিল দু’জনেই ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। কিন্তু দু’জনেই অল্প বয়সে মেধা প্রদর্শন করেছেন। উদ্যোক্তা শক্তি প্রদর্শন করেছেন। ফাহিম সালেহর জন্ম সৌদি আরবে। তার পিতামাতা বাংলাদেশি। কিন্তু তিনি বড় হয়েছেন নিউ ইয়র্কের পোকিপসি এলাকায়। যখন তিনি হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন এবং বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স ডিগ্রি নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন, তখনই তিনি ওয়েবসাইট বানিয়ে তা বিক্রি করে হাজার হাজার ডলার কামিয়েছেন। তার বড় সফলতার প্রথমটি হলো প্রাঙ্কডায়াল ডট কম। এটি টেলিফোন প্রাঙ্ককলিং সার্ভিস। কয়েক বছর আগে একটি লেখায় ফাহিম সালেহ বলেছিলেন এ থেকে তিনি এক কোটি ডলার আয় করেছেন। ওয়েব ডিজাইন দক্ষতা ব্যবহার করে তিনি ফিউচার বিজনেস লিডারস অব আমেরিকা প্রতিযোগিতায় প্রথম হন।

অন্যদিকে হ্যাসপিল তার টিনেজ বয়সটা কাটিয়েছেন ফস্টার পরিবারে। নিউ ইয়র্কের ভ্যালি স্ট্রিমে হাইস্কুলে পড়াকালীন তিনি নিজে পিনাট বাটার তৈরি করে তা বিক্রি করতেন। তিনিও একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছেন। এর নাম রেন্ট এ ব্রাদার। সেখানে তিনি দিনের বেলা কাজ করতেন। তার বন্ধু ক্লাউডি প্যারোলা বলেছেন, হ্যাসপিলও উদার ছিলেন। নিজের পকেটের অর্থ দিয়ে তিনি মানুষকে খাওয়াতেন। বন্ধুদের তিনি বিভিন্ন রকম জিনিস উপহার দিতেন। প্যারোলা বলেন, হ্যাসপিল কখনো অর্থ নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি।
প্রায় ৫ বছর আগে ফাহিম সালেহ তার দৃষ্টিভঙ্গি ফেরান বাংলাদেশের দিকে। রাজধানী ঢাকায় তিনি একটি ইনকিউবেটর স্থাপন করেন। এর নাম রাখা হয় হ্যাকহাউজ। এটি সাজানো হয় সিলিকন ভ্যালির মতো। চারপাশের দেয়াল দেয়া হয় কাচে, রাখা হয় পিংপং টেরিল। তিনি সেখানে একদল প্রোগ্রামারকে তুলে নেন। তাদেরকে গেমস এবং বিভিন্ন অ্যাপ সৃষ্টির কাজে লাগিয়ে দেন। তার বেশকিছু বন্ধু ও সাবেক সহকর্মী বলেছেন, ফাহিম সালেহ মানুষকে নিয়ে পরীক্ষা করতেন। ঢাকায় ১১ গ্রেডে পড়ুয়া আহমেদ ফাহাদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন তিনি। তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার কাছের একটি অনলাইন পোর্টফোলিও বানিয়ে দিতে বলেন। এরপরও তাকে নিয়ে পরীক্ষা করেন তিনি। তারপর তাকে হ্যাকহাউজে একটি চাকরি দেন। আহমেদ ফাহাদ এখন ২২ বছর বয়সী যুবক। তিনি পাঠাও-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। বর্তমানে এটি বৃহৎ একটি কুরিয়ার, ই-কমার্স ও মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিংয়ে জনপ্রিয় নাম। বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীদের মতে, নতুন একটি ভেঞ্চার খোলার জন্য কয়েক সপ্তাহ বা মাস হঠাৎ করে ফাহিম সালেহ নিখোঁজ থাকতেন। এটা খুব একটা অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না।

২০১৮ সালের মার্টে তিনি মোটরবাইক রাইড শেয়ারিং অ্যাপ প্রতিষ্ঠার জন্য বোগোটায় তিনজনের একটি টিমের কাছে ইমেইল করেন। তাদের একজন ডানিয়েল রড্রিগুয়েজ বলেন, একদিন আমি তার ফোন পেলাম। পরের সপ্তাহে দেখি কলম্বিয়াতে তিনি আমাদের সঙ্গে। সেখানে চালু করা হলো মোটর শেয়ারিং অ্যাপ। ওই সময় সেখানে দিনে দুই হাজার মানুষ এই অ্যাপের সুবিধা নিতেন। এ জন্য প্রতিষ্ঠাতা ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিলেন ফাহিম সালেহ। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি ব্যাংক একাউন্টে তিনি জমা দিলেন আড়াই লাখ ডলার। এই একাউন্টের বিপরীতে কার্ড পাঠিয়ে দেন কলম্বিয়ায়। এই প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত বড় হতে লাগলো। করোনা মহামারির আগে এখান থেকে মাসে গড়ে ২০ লাখ মানুষ এই রাইড শেয়ারিং ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্যাকেজ ডেলিভারি ব্যবসা। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিলের মধ্যে দু’বার এই ব্যাংক একাউন্ট আনলক করতে সহায়তা করেছিলেন হ্যাসপিল। তবে তাকে ফাহিম সালেহ কখন সহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল তা তার বন্ধু বা সহকর্মীদের কেউই বলতে পারছেন না।

Share: