জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য মত দিলেও এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার ভার শীর্ষনেতৃত্বের ওপর দেওয়ার পক্ষে তারা। স্থায়ী কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখন এ বিষয়ে মতামত দেবেন। এরপর আবারও ‘কনক্লুসিভ আলোচনা’ সেরে বিষয়টি সম্পর্কে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপরেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব অর্পণ করবেন তারা। ফলে, মত দিলেও শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে ছাড়া বা রাখার বিষয়টি নির্ধারণ করতে হবে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকেই, এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য।
জামায়াতকে ছাড়া বা রাখার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে বিদ্যমান উভয়পক্ষের রাজনীতিকরা মনে করছেন, ১৯৯৯ সালে দলটিকে সঙ্গে নিয়ে জোট করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে নিজেই নেতাদের জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ১৯ বছর পর যখন তাদের ছাড়তে দলের নীতিনির্ধারকরা একে একে মত দিচ্ছেন, এই সময়েও বিষয়টি নিয়ে দলের হাইকমান্ডকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কারণ হিসেবে নেতাদের ভাষ্য, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনাকালে দুটি মত উঠে আসে, তখন হাইকমান্ডকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানান স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নির্বাচনের পর সংসদে যোগদান, মির্জা ফখরুলের সংসদে যোগদান থেকে বিরত থাকাসহ বেশকিছু বিষয়ে তারেক রহমানই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এসব বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করেছেন দলটির নেতারা।
বিএনপির দায়িত্বশীল ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, শনিবার (২৫ জুলাই) বিকালে স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে মূলতবি থাকা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তার বক্তব্য শেষ করবেন, এমন ইঙ্গিত মিলেছে। একইসঙ্গে এজেন্ডায় নতুন কোনও ইস্যু যুক্ত না হলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার মতামত তুলে ধরবেন।
স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য জামায়াতকে বাদ দেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। এ বিষয় নিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত বিরতি দিয়ে আলাপ করেছে বাংলা ট্রিবিউন। এসব আলাপেও পক্ষ-বিপক্ষ মত এসেছে।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘যারা জামায়াতকে ছাড়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তাদের যুক্তি কী। তাদের যুক্তি হাইকমান্ডকে সন্তুষ্ট করবে কী না, এ বিষয়টিও খেয়াল করতে হবে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে একটি মাত্র দল রাজনীতি বুঝে, সংগঠন আছে, সেটি হচ্ছে জামায়াত। এটা আমাদের বিপক্ষে গেলেও সত্যি, কারণ বিএনপি যতবার ক্ষমতায় এসেছে, জামায়াতের সহযোগিতা ছিল। ১৯৯১ সালে সরকার গঠন, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার গঠন কী তাদের ছাড়া সম্ভব ছিল? এ বিষয়টি নিশ্চয়ই বিএনপিকে মাথায় রাখতে হবে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা। তার যুক্তি, বিএনপি কাদের নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেটা পরিবর্তিত ভূ-রাজনীতিতে আর ম্যাটার করে না। সাবেক এই প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেন, ‘নাইন-ইলেভেনের পর থেকে সারা দুনিয়াজুড়েই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এসেছে। রাষ্ট্রপতি থাকাকালে জিয়াউর রহমান সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফিসহ পশ্চিমাবিরোধী অনেক মুসলিম শাসককেই এক টেবিলে এনেছেন, সেই বাস্তবতা কী এখন ব্যবহারযোগ্য?’
তিনি বলেন, ‘২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরও যদি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে সমস্যা হয় যে, ভোট না হলেও ক্ষমতায় থাকতে পারে আওয়ামী লীগ- আর এর পেছনে পরাশক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ রয়েছে। এই পরাশক্তিগুলোর কাছে যারা ক্ষমতা নির্ধারণে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে, তাদের কাছে জামায়াত কিংবা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর অবস্থান কী, সেটি বিবেচনা করার সুযোগ নিশ্চয়ই রাখে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও দায়িত্বশীল ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভেতরে-ভেতরে তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। জামায়াত ও দলটির নেতাকর্মীরা স্থানীয়ভাবে বিএনপির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কী-কী সমস্যা বা সুবিধা করেছে, সেটি তিনি জানার চেষ্টা করছেন। তবে কোনও কোনও সদস্য মনে করেন, দলের সর্বস্তর থেকেই তারেক রহমান চাইলে মতামত গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া তরান্বিত করতে পারেন।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘খুঁজে দেখা দরকার যেখানে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী, সেখানে জামায়াত নেই কেন। কিন্তু যেখানে বিএনপি শক্তিশালী সেখানে জামায়াত গত ১৯ বছরে কীভাবে বিএনপির সংগঠন ও রাজনীতিকে দুর্বল করেছে।’ এর ব্যাখ্যা এখন বিএনপিকে বের করতে হবে, বলে জোর দেন এই নেতা।
স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্র জানায়, গত ১৮ জুলাই আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জামায়াত বিষয়ে দীর্ঘ মতামত তুলে ধরেছেন। প্রায় দুই ঘণ্টার মতামতের অধিকাংশ সময় দলের সাংগঠনিক পুনঃতৎপরতা ও জামায়াত নিয়ে মতামত দেন তিনি।
এ বিষয়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ইন্টারনাল অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলি। এসব বিষয়গুলো সেক্রেটারি জেনারেল সবার সামনে তুলে ধরেন।’
শনিবার অনুষ্ঠেয় বৈঠকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার মতামত দিতে পারেন, এমন ইঙ্গিত মিলেছে একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বাম এই ছাত্রনেতার মতামতেও রাজনৈতিকভাবে বিএনপির ভবিষ্যৎ ও জামায়াতের জোটসঙ্গত্যাগের বিষয়টির উল্লেখ থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
বিএনপির ফরেন রিলেশন্স কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য জানান, ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে জামায়াতকে ছাড়ার খবরে নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করেছেন দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে আগ্রহী বিদেশি কয়েকজন কূটনীতিক। তাদের কাছে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে, বিএনপির নেতৃত্ব দীর্ঘ সময়ের বিতর্কিত এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘কথায় কথাই বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কথা আর তাদের সঙ্গে সন্ধ্যায় চা-টেবিলের গল্পে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় না। জামায়াতকে লুজ করলে বিএনপির ক্ষতি হবে, এটা আমি বলতে পারি। কখনো রাজপথে নামতে হলে কাকে দরকার হবে?’
একই ইস্যুতে নীতিনির্ধারকদের আরেকজন বলেন, ‘জামায়াত মন্ত্রিত্ব পেয়েছে, পতাকা উঠেছে, গ্রেনেড হামলা হয়েছে, ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, ক্ষমতার নেতৃত্বে থাকায় এসব বিষয়ের দায় বিএনপির ওপর বর্তেছে। ভবিষ্যতে এই দায় নিয়েই দল চলবে কিনা, এই সিদ্ধান্ত তো বিএনপিকেই নিতে হবে। অন্য কেউ নেবে না। যে দলটি সরাসরি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তাদের সঙ্গে রেখে রাজনৈতিক কী লাভ হলো, তার ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই হাইকমান্ড জানে।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণতম সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘স্থায়ী কমিটিতে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। মতামত উঠে আসছে। আমরা অতীতেও দলের শীর্ষনেতৃত্বকে দায়িত্ব দিয়েছি। কাউন্সিলে যেমন ম্যাডামকে কাউন্সিলররা দায়িত্ব দিয়ে থাকেন, গঠনতান্ত্রিকভাবেই শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’সুত্র-বাংলা ট্রিবিউ্ন।