“ক্রীতদাসের হাসি ও আমেরিকার জর্জ ফ্লয়েড” ——জাঁ-নেসার ওসমান

“ক্রীতদাসের হাসি ও আমেরিকার জর্জ ফ্লয়েড”
——জাঁ-নেসার ওসমান
বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী শওকত ওসমান তাঁর রচিত “ক্রীতদাসের হাসি” উপন্যাসের ১৯৯৫ সালের
শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা প্রকাশিত ১১তম, সংস্করণের ১৯, পৃষ্ঠায়, লিখছেন,
“ হারুণঃ মাশ্রুর, মানুষের লাশ কি কবরে পড়ে থাকে আর পচে?
মশ্রুরঃ আলেমেরা সেই রায় দেন।
হারুণঃ না, না-মশরুর। লাশ কবরে শুয়ে থাকে না। লাশ কথা বলে। তার ধাক্কা আরো শক্ত আরো কঠিন। জেন্দা মানুষের কন্ঠ সেখানে ফিস্ ফিসানি, ভাঁড়ার ঘরে নেংটি ইঁদুরের পায়ের আওয়াজ মাত্র।”
জ্বী হ্যাঁ, লাশের কন্ঠ অনেক জোরালো। লাশের প্রতিবাদ জেন্দা লোকের চেয়ে বহুগুণে তীব্র।
আজ যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিশে, এক পুলিশে, ঘেডিতে পাড়া দিয়া কৃষ্ণাঙ্গঁ জর্জ ফ্লয়েডকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করায়- যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা ইউরোপ ফুঁসে উঠেছে। বিশ্ব সেরা ধনীর দেশ, উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্তরের বর্ণবাদ, আজ হীং¯্র কুকুরের মতো মুখব্যাদন করছে।
গণতন্ত্রের গলা পুলিশি পায়ের চাপায়, কালোর আইন, সাদার আইনের বাঘছাল ঢাকা গাধাটার স্বরুপ বেরিয়ে পড়েছে। বর্ণবাদের বিভিষিকা যুক্তরাষ্ট্রের অলিতে গলিতে সদম্ভে বিরাজ করছে।
আজ জর্জ ফ্লয়েডের লাশ জেন্দা মানুষের ক্ষীণ ফিস্ফিস্ানিকে অতিক্রম করে তীব্র চিৎকার করছে, আমি শ্বাস নিতে পারছিনা “ আই কান্ট ব্রীদ্” ।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে বিশ্বের কোনায় কোনায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের লাশের গোঙানী ইথারে ইথারে ভেসে বেড়া”েছ, “ আই কান্ট ব্রীদ্” “ আই কান্ট ব্রীদ্” ।
হাজার হাজার বিক্ষোভকারীরা কারফিউ উপেক্ষা করে প্রতিবাদ করছে। হাজার হাজার প্লাকার্ড, শ্লোগানে মুখরিত পোর্ট-ল্যান্ড, ওয়াশিংটন, নিউইয়কর্, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্রের সীমা পেরিয়ে জর্জ ফ্লয়েডের লাশের কন্ঠ ইউরোপের প্রতিটি রাজ্যে প্রতিধ¦নীত হ”েছ।
এই সেই খুনের যুক্তরাজ্য যেখানে, প্রেসিডেন্ট এ্যব্রাহাম লিংকন আততায়ীর গুলিতে নিহত।
আমেরিকান আততায়ীর গুলিতে নিহত প্যট্রিস লুমুম্বা! জন ফিট্ জেরাল্ড কেনেডি,
কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং, গুলিতে নিহত জন. এফ. কেনেডির সহদোর জন রবার্ট কেনেডি।
এই সেই মহান গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র যার এক একটা ভিসার দাম, চোরা পথে, ঢাকার টাকায় বিশ লাখ।
সেই পৃথিবীর স্বর্গের এই রূপ।
কথাশিল্পী শওকত ওসমানের “ক্রীতদাসের হাসির” অনুরণন শুনি ওই আমেরিকাতেই।
যেখানে তথাকথিত কুড়ি ডলারের জাল নোটের জন্য, কুড়ি লক্ষ টাকা দামের গাড়ীর মালিককে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ ঘাড়ে হাঁটু দিয়ে চেপে হত্যা করে।
জর্জ ফ্লয়েডের ছেলে বলেছে; “ কাউকে যাতে আর এভাবে বাবা হারা হতে না হয়”।
কি লজ্জা সারা বিশ্বের পুলিশ কর্মচারীদের।
কথাশিল্পী শওকত ওসমানের “ক্রীতদাসের হাসির” নায়ক তাতারীও একজন কৃষ্ণাঙ্গ হাবসী ক্রীতদাস।
যার লাশের চীৎকারে ১৯৬৩ সালের পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালীরা পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নড়ে চড়ে ওঠেন।
কথাশিল্পী শওকত ওসমান, লিখলেন; “ লাশ কথা বলে। তার ধাক্কা আরো শক্ত আরো কঠিন।”
তার প্রমাণ বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে, রফিক, সালাম-বরকতের আত্মার তীব্র প্রতিবাদে- রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলো,। ১৯৭১ সালে, লক্ষ মুক্তিসেনা, ছাত্র-জনতা,মা-বোনের সম্ভ্রম, ভারতীয় সৈন্য বাহিণী,পুলিশ, বিডিআর আর আপামর জনতার লাশের প্রতিবাদে বাংলা দেশ স্বাধীন হলো।
কিš‘ শওকত ওসমান এই লাশ চেয়েছিলেন বুঝি!!
আজ বাংলাদেশের জেন্দা মানুষের কন্ঠ ও লাশের কন্ঠ সব ভাঁড়ার ঘরের নেংটি ইঁদুরের পায়ের আওয়াজের সাথে মিলেমিশে একাকার।
এখন বাংলার যত কাজী,গাজী,জামান,আমান, রহমান,ওসমান,বনমালি,চেরাগ আলি,সত্যব্রত, মনোব্রত,দেবব্রত, শীলাব্রত,চ্যেগাব্রত,আন্দালিব,ধান্দালিব,ওয়োম্যান লিব,এ্যারোমা,সুষমা,পরমা,হাসি,খুশি, লুলু,টুলু,দুলু, রবিউল, মনিরুল, সবাই এসি বাতাসের গাড়ী, মাস শেষের বেতন কাঁড়ি কাঁড়ি, এসবের লোভে আর মাতে না।
আর চ্যেতে না! চুপ চাপ ইন্দুরের মতো ফিস্ ফিস্ করে।
অখিল, নিখিল, শাকিল,বখিল, ব্যাংগা-চ্যাংগা,ঠ্যাংগা, কে কোথায় মরলো, কে কাকে মারলো, কেন মারলো?
কি দরকার এসব লাশের চীৎকার শুনে!
চামে চামে জীবনটা পার করো, এমনে না মরলে, করোনায় মরো, তবুও প্রমাণ করো কথাশিল্পী শওকত ওসমান আপনার লেখা ভুল!! এখানে লাশ আর কথা বলে না।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ফ্লয়েডের লাশ জেন্দা মানুষের ক্ষীণ ফিস্ফিস্ানিকে অতিক্রম করে তীব্র চিৎকার করছে
“ আই কান্ট ব্রীদ্” আমি শ্বাস নিতে পারছিনা।
জর্জ ফ্লয়েডের লাশ কথা বলে। তার ধাক্কা আরো শক্ত আরো কঠিন হতে পারে কিš‘ না, আপনার বাংলায় তা হবে না। কারণ বাংলার অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত দুঃখী মানুষ, লতাপাতা, কচু-ঘেঁচু, মরা মুরগী-শুঁটকি উঁটকি, খেয়ে চুপ চাপ জীবন কাটায়। কোনো কথা বলে না। কোনো প্রতিবাদ করে না!
তাই ওরা মরলে ওদের লাশও চুপ চাপ থাকে, তীব্র চিৎকার করার সাহস পায় না, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ফ্লয়েডের লাশের মতো!!

জাঁ-নেসার ওসমান
Share: