কিছু ‘ওষুধ’ই হয়ে উঠেছে রোগের কারণ।।একাধিক চক্র সক্রিয়,পাইকারি বাজার মিটফোর্ড

ডেইলি প্রেস ওয়াচ রিপোর্টঃ

ইদানীং কিছু ‘ওষুধ’ই হয়ে উঠেছে রোগের কারণ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ। কারখানা বানিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা যা ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অনেক ফার্মেসি মালিক জেনেশুনেই রোগীর হাতে তুলে দিচ্ছে ভেজাল ওষুধ। এ নিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দৃশ্যমান তৎপরতাও নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ এমন এক পণ্য, যার সঙ্গে জীবন-মৃত্যু জড়িয়ে। তাই ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হরত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ‘নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন ভয়াবহ অপরাধ। দৃষ্টান্তমূলক সাজা না হলে এটি থামবে না। এতে রোগ তো সারেই না, উল্টো আরও জটিলতা বাড়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নকল ওষুধের কারণে ব্যক্তির শারীরিক ক্ষতির সঙ্গে আর্থিক ক্ষতিও হয়। এর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাকে একযোগে কাজ করতে হবে।’

গত ১২ আগস্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কোতয়ালি জোনাল টিম রাজধানী ঢাকা, সাভার ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ বিসিক শিল্প এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ জব্দ করে। এসময় গ্রেফতার করা হয় আটজনকে। যারা রীতিমতো কারখানা বানিয়ে নামিদামি ব্র্যান্ডের মোড়কে নকল ওষুধ বানাতো। তাদের কারখানা থেকে নকল ওষুধ তৈরির যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন আয়ুবের্দিক ওষুধ তৈরির ভুয়া লাইসেন্সে কারখানা বানিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে ভেজাল ওষুধ বানাতো। সাভার ও পিরোজপুরেও তাদের কারখানা আছে। ভেজাল ওষুধগুলো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসিতে পাঠাতো চক্রটি।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারিতে বহুল ব্যবহৃত একমি ল্যাবরেটরিসের মোনাস-১০ ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস-এর মনটেয়ার-১০ নকল করতো চক্রটি। আবার স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস-এর সেফ-৩, সেকলো-২০, জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালস-এর ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস-৫০০ ও বানাতো ওরা।

নকল-ওষুধের-চক্রনকল ওষুধ তৈরির চক্র

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সেফ-৩ এর বাজার মূল্য প্রতি পিস ৩৫ টাকা ৫০ পয়সা। চক্রটি নকল সেফ-৩ বিক্রি করতো ৫ টাকা করে। একইভাবে ছয় টাকা দামের সেকলো ৭৫ পয়সা, ১৬ টাকা মূল্যের মনটেয়ার ৩ টাকা, ১১ টাকা মূল্যের ন্যাপ্রোক্সেন আড়াই টাকা এবং ১৬ টাকা মূল্যের মোনাস ৩ টাকায় বিক্রি করতো।ফার্মেসি মালিকরাও মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লোভে বিক্রি করতো এসব ভুয়া ওষুধ।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়া নকল ওষুধ উৎপাদনকারী চক্রটির মূল হোতা ফয়সাল। সে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে আয়ুবের্দিক ওষুধ তৈরির একটি লাইসেন্স নিয়েছিল। ওটা ব্যবহার করে সে পিরোজপুরের বিসিক শিল্পনগরীতে কারখানা স্থাপন করে। আতিয়ার নামের এক কেমিস্টের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধের ফর্মুলাও নিয়েছিল সে। তারপর শুরু করে নকল ওষুধ উৎপাদন।

রাজধানীর মিটফোর্ডের মুহিব নামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে রাসায়নিক সংগ্রহ করতো ফয়সাল। সেগুলো সাভার ও পিরোজপুর পাঠিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করে আবার নিয়ে আসতো মিটফোর্ডে। মিটফোর্ড থেকেই ফয়সালের সহযোগী মোবারক, নাসির, ওহিদুল, মামুন, রবিন, ইব্রাহীম, আবু নাইম ও আরেক ফয়সালের মাধ্যমে সারাদেশে বিক্রি করতো।

চক্র একাধিক, পাইকারি বাজার মিটফোর্ড
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে ঢাকাসহ সারাদেশে একাধিক চক্র সক্রিয়। গোয়েন্দাতথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে কিছু চক্রকে আইনের আওতায় আনা হয় ঠিকই, কিন্তু জামিনে বেরিয়ে তারা আবার শুরু করে ভেজাল ওষুধ তৈরির কাজ। গত কয়েকবছরে মিটফোর্ডের বাজার থেকেই কয়েক শ’ কোটি মূল্যের ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা বিভিন্ন এলাকায় কারখানা বানায়। তবে তাদের পাইকারি বাজার মিটফোর্ড। এখান থেকেই ভেজাল ওষুধ ছড়ায় সারাদেশে।

নকল-ওষুধ-তৈরির-মেশিনসম্প্রতি জব্দ হওয়া নকল ওষুধ তৈরির মেশিন

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক ফার্মেসি মালিক কম টাকায় ওষুধ কিনতে মিটফোর্ড আসেন। নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা তাদের প্রস্তাব দেয়। বেশি লাভের আশায় ফার্মেসি মালিকরা রাজি হলে কুরিয়ারের মাধ্যমে ওষুধ পাঠানো হয়।

মিটফোর্ডের পাইকারি ওষুধ মার্কেটের কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির এক পরিচালক জানান, তারাও নকল ওষুধ উৎপাদন এবং বিপণনের বিপক্ষে। এ জন্য ২০১৮ সালে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু প্রশাসন পদক্ষেপ নেয়নি।

ওই ব্যবসায়ী স্বীকার করেছেন, কেউ কেউ আয়ুর্বেদিক লাইসেন্সের আড়ালে কারখানা বানিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করছে। অনেকে বাসাবাড়িতেও ডাইস বানিয়ে ভেজাল ওষুধ বানাচ্ছে। এদের সংখ্যা কম। অল্প কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য পুরো মার্কেটের দুর্নাম হচ্ছে।

যোগাযোগ করা হলে মিটফোর্ডের ড্রাগিস্ট অ্যান্ড কেমিস্ট সমিতির সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন রনি বলেন, ‘আমরা চাই নকল ওষুধ যারা তৈরি করে তাদের সর্বোচ্চ সাজা হোক। যারা বিপণন করে তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি  যাবতীয় লাইসেন্স বাতিল করে কালোতালিকাভুক্ত করা হোক।’

নিম্নমানের ওষুধে সয়লাব
একই জেনেরিক নামের ওষুধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করলেও একেকটির মান একেকরকম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদারকির অভাবেই নিম্নমানের ওষুধ দেদার বিক্রি হচ্ছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এখন দেশে ২৪১টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ বানাচ্ছে। যেকোনও ওষুধ বাজারজাত করার আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে বাজারজাত করতে হয়। কিন্তু একবার বাজারজাত করার পর সেই ওষুধের গুণগত মান নিয়ে আর কোনও তদারকি হয় না। এই সুযোগেও অনেক নামসর্বর্স্ব প্রতিষ্ঠান ওষুধের মান কমিয়ে দেয়।

নকল-ওষুধ-তৈরির-ডায়াসসম্প্রতি জব্দ হওয়া নকল ওষুধ তৈরির ডায়াস

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফার্মেসি মালিক বলেন, ‘বড় ও নামকরা কোম্পানির ওষুধের দাম বেশি। কিন্তু অন্য আরেক কোম্পানি একই ওষুধ কমদামে বিক্রি করে। এজন্য অনেক ফার্মেসি মালিক প্রেসক্রিপশন দেখে জেনেরিক নাম ঠিক রেখে ব্র্যান্ড বদলে দেয়। তাদের কাছে লাভটাই বড়, মান নয়।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাজ হলো মাঝে মাঝে বাজার থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে মান পরীক্ষা করা। কিন্তু তাদের ল্যাবরেটরির সক্ষমতা কম। এই সুযোগ কাজে লাগায় অনেক কোম্পানি। লোকবলের অভাব ও ক্যাপাসিটি না থাকার দোহাই দিয়ে কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কর্ণধার এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ‘নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন প্রতিরোধে আমরা নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিঠি দিয়ে আসছি। এ ছাড়া আমরা নিয়মিত ড্রাগিস্ট, কেমিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার করছি। এ কারণে আমরা মডেল ফার্মেসির ওপরও জোর দিচ্ছি।’

সুত্র- বাংলা ট্রিবিউন।

Share: