রাতারাতি এসব ঘটালো কী করে তালেবানরা?

প্রেসওয়াচ ডেস্কঃ ডোমিনো বলে একটা খেলা আছে। একটার পর একটা চারকোণা বাক্স দাঁড় করানো থাকে। একটায় ধাক্কা দিলেই ওটা গড়িয়ে পড়বে অন্যটার ওপর। এরপর একে একে সবকটা বাক্সই পড়ে যাবে। শুরুর একটি টোকা ঘটিয়ে দিতে পারে মহা বিপর্যয়। সম্প্রতি আফগানিস্তানের অবস্থা হয়েছে ডোমিনোর মতো। একটার পর একটা শহর-প্রদেশ পড়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো প্রথম টোকাগুলো পড়েছে কোথায়?

সংবাদ দেখে আর বোঝার অপেক্ষা থাকে না যে আফগানিস্তানে কাদের উত্থান হতে চলেছে। আশরাফ ঘানির সরকারও ক্রমাগত ঢোক গিলে চলেছে। আদৌ তিনি আর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ করা যায়। কিন্তু রাতারাতি এমনটা ঘটালো কী করে তালেবানরা?

তালেবানের সঙ্গে পেরে উঠছে না আফগানবাহিনীতালেবানের সঙ্গে পেরে উঠছে না আফগানবাহিনী

২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো বন্ধুরা মিলে আফগান বাহিনীকে ভালোই ট্রেনিং দিয়েছে (বিশ্ব এমনটাই জানে)। গোলাবারুদ, ভারী অস্ত্রও কম দেয়নি। আমেরিকান ও ব্রিটিশ জেনারেলরা ক্রমাগত বলে গেছেন, এমন শক্তিশালী আফগান আর্মি ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। তবু উল্টে গেলো পাশার দান। তারমানে জেনারেলরা এতদিন ফাঁকা বুলি আওড়েছিলেন? বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রতিনিধি জোনাথন বিয়েলে এ নিয়ে একটি চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন।

তালেবানের শক্তিমত্তা

খাতাপত্রে আফগান সরকার এখনও খুব ক্ষমতাবান। আর্মি, এয়ারফোর্স ও পুলিশ মিলিয়ে আফগান সিকিউরিটি ফোর্সেও আছে প্রায় তিন লাখ সেনা। স্পেশাল ফোর্স আছে আরও ১০ হাজার। কিন্তু এদের সবাইকে ঠিক ‘অকুতোভয়’টাইটেল দেওয়া যাচ্ছে না। একে তো আফগান বাহিনীতে নিয়োগে মোটেও আগ্রহ দেখায় না দেশটির তরুণরা, এরমধ্যে যারা নিয়োগ পায় তাদেরও মতলব বিশেষ সুবিধার থাকে না। ভালো বেতনের লোভ, ঘুষ খাওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সুযোগ বুঝে পোস্ট ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া তাদের নিয়মিত চর্চা। দুর্নীতিটাও এমন পর্যায়ে যে, সেনা নিয়োগ না দিয়েও বেতন তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে দেশটিতে। সুতরাং আফগান বাহিনীর ওই তিন লাখ সেনা মানে আদৌ কতজন, এ প্রশ্ন করা যায় সবার আগে।

এমন দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে ইউএস কংগ্রেসের হালনাগাদ প্রতিবেদনে। সেখানে স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান (সিগার) খুব টেনশন নিয়ে জানিয়েছে, ‘আফগান বাহিনীর দুর্নীতিটাই দেশটিকে ক্ষয় করে ফেলছে। তাদের বাহিনীর শক্তিমত্তাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ।’ আবার রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউট-এর মুখপাত্র জ্যাক ওয়াটলিংও বলেছেন, আফগান আর্মি নিজেরাও জানে না যে তাদের লোকবল কত। সুতরাং, এমন একটা খবর শুনে কি তালেবানরা বগল বাজাবে না?

কাবুলে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক হাজার আফগানকাবুলে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক হাজার আফগান

জ্যাক ওয়াটলিং এও বলে দিয়েছেন, আফগান সেনাদের নীতিবোধের মতো তাদের যন্ত্রপাতিতেও (অস্ত্র বুঝিয়েছেন) ঘুণ ধরেছে। যে কারণে তালেবান আসার খবর শুনেই পোস্ট ছেড়ে পালিয়েছেন অনেকে। কিছু শহর দখলে তাই তালেবানকে লড়তেই হয়নি।

এ তো গেলো আফগান বাহিনীর কথা। তালেবানের শক্তি কতটা সেটা মাপা তো আরও কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস কমব্যাটিং টেরোরিজম সেন্টার-এর তথ্যমতে, তালেবান যোদ্ধা আছে কমপক্ষে ৬০ হাজার। এদের সঙ্গে অন্য জঙ্গি গ্রুপ ও সমর্থক মেলালে সংখ্যাটা দুই লাখ ছাড়াবে। আবার তালেবান মানেই একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা, এমনটাও ভাবতে বারণ করেছিলেন আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ড. মাইক মার্টিন। যে কেউ যখন তখন তালেবান বনে যেতে পারে।

তিনি এও বলেছেন, আফগানিস্তানের সরকারও স্থানীয় অনেক গোষ্ঠীর মতামতে ঘন ঘন প্রভাবিত হয়। সেসব গোষ্ঠী তো বটেই, সরকারি লোকজনও নিজের জান বাঁচাতে দ্রুত পক্ষ বদলায় সেখানে।

কার হাতে কত অস্ত্র?

এদিকে অর্থ ও অস্ত্র, দুটো দিক দিয়ে এখনও আফগান সরকার শক্ত অবস্থানে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সেনাদের বেতন ও অস্ত্র কেনার জন্য কোটি কোটি ডলার পেয়েছে তারা। ২০২১ সালের সিগার-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এ পর্যন্ত আফগানিস্তানের নিরাপত্তাতেই যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে আট হাজার আট শ’ কোটি ডলারের বেশি। সিগার এও বলল, ওই অর্থ আদৌ ঠিকমতো ব্যয় হলো কিনা সেটা এখন লড়াইয়ের ময়দানেই বোঝা যাবে।

কিন্তু টাকা আর যুদ্ধবিমান দিলে কী হবে, সেগুলোর তাৎক্ষণিক ব্যবহারেও হওয়া চাই সিদ্ধহস্ত। আফগান বাহিনীকে এখনও তাদের ২১১টি এয়ারক্রাফট সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এদিকে আবার তালেবানরাও টার্গেট করে হত্যা করছে পাইলটদের। লস্কর গাহ এলাকাতেও মার্কিন বিমানবাহিনী লড়াই চালিয়ে গেলেও সেটা তারা আর কতদিন চালাবে সেটা নিয়ে আছে সন্দেহ।

এদিকে আবার তালেবানের অর্থ আর অস্ত্রের যোগানটাও আছে ঠিকঠাক। অর্থ আসছে মাদক কারবার থেকে। আর বাদবাকি সমর্থনের জন্য পাশে এক মিত্রদেশ তো আছেই। কিছুদিন আগে আবার আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর বড়সড় অস্ত্রাগার ও গোলাবারুদ লুট করেছে তালেবানরা। যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া হামভি গাড়ি, নাইট সাইট, মেশিন গান, মর্টার, আর্টিলারি; এসবও এখন তালেবানের হাতে।

সোভিয়েত যখন এসেছিল, তখনই অস্ত্রের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তানে। দেশটিতে একে-৪৭ রাইফেল হয়ে গেলো মুড়িমুড়কি। আর এখন তো তারা ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসও (আইডি) বানাতে পারে।

এরচেয়েওবড় কথা এই তালেবানরা হুট করে মাটি ফুঁড়ে বের হয়নি। তারা এতদিন ঘাপটি মেরেই ছিল। কোথায় হামলা করতে হবে, কার দুর্বলতা কোথায়, কোন পাইলটের বাড়ি কোথায়- এসব তথ্য কি তাদের হাতে নেই?

শেষ খেলা কী?

আফগান সরকার নিশ্চিতভাবে চোখে অন্ধকার দেখছে। তবে জ্যাক ওয়াটলিংয়ের মতো কেউ কেউ আবার এখনও আশা দেখছেন পরিস্থিতি ঘুরে যাওয়ার। তাদের মতে, চলমান সংঘাতে রাজনৈতিক সমাধান আছে এখনও। ঘানি সরকার যদি কোনোভাবে আফগানিস্তানের আদিবাসী নেতাদের হাতে আনতে পারে তবে লড়াইটা সমানে সমান করার সুযোগ আছে। এমনটা মনে করার কারণ হলো, ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের ‍যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক নেতা খ্যাত আবদুল রশিদ দোস্তুম ইতোমধ্যে মাজার-ই-শরিফে গেছেন। জানা গেছে, সরকারের সঙ্গে তিনি এরইমধ্যে একটা চুক্তিতে আসার চেষ্টা করছেন।

বছর শেষে রাজনৈতিক সমাধানে একটা কিছু হোক না হোক, শান্তির প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যে কতটা ব্যর্থ, সেটা এখন রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা আফগান শিশুটিও জানে।

Share: