ডেইলি প্রেসওয়াচ রিপোর্টঃ
নেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষক, নেই অবকাঠামোও। এর মধ্যেই প্র্যাকটিস টিচিং ছাড়া শুধু লিখিত পরীক্ষার নোট সরবরাহ করে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) সনদ দিচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত দেশের বেশ কিছু বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট।
অন্যদিকে অনুমোদনহীন শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প অফিস চালু করে প্রশিক্ষণার্থী সংগ্রহ করে ভর্তি করছে বিএড কোর্সে। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করে সনদ সংগ্রহ ও সরবরাহ করা হচ্ছে। আর অন্য প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার ব্যবস্থা না হলে পরীক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছেন প্রশিক্ষণার্থীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও অবকাঠামো নেই বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন না থাকা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে প্রশিক্ষণ ছাড়াই পরীক্ষার জন্য অন্য ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণার্থী সাপ্লাই দেয়। যদি সাপ্লাই দেওয়া সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে প্রতারিত হন প্রশিক্ষণার্থীরা। আবার যাদের অনুমোদন আছে কিন্তু শিক্ষক ও অবকাঠামো নেই, তারা প্রশিক্ষণ না করিয়ে শুধু লিখিত পরীক্ষায় পাস করার নোট সরবরাহ করে। এভাবেই হোম সার্ভিসের মতো দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ সনদ। নাম পরিচয় গোপন রেখে অনেক শিক্ষার্থী তাদের সঙ্গে প্রতারণা ও তাদের কাছে এই সনদ বিক্রির অভিযোগ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ফার্মগেট এলাকার বাংলাদেশ টিচার ট্রেনিং মহাবিদ্যালয়ের অনুমোদন বন্ধ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ২০১৮ সালের ২ জুন প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে বিএড প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে রশিদ মূলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম পূরণ ফিসহ মোট নেওয়া হয়েছে ১১ হাজার টাকা। আর ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ২২ জানুয়ারি রশিদ মূলে অন্য একজন প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৫ হাজার টাকা। ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে সনদ সংগ্রহ ও বিতরণ করে এই প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ জান্নাতুন নাহার বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধের আদেশের বিরুদ্ধে রিট করা হয়েছে। রিটের শুনানির অপেক্ষায় রয়েছি। যখন প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেয় তখন অন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরীক্ষার ব্যবস্থা করিয়েছি প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য।’
তারপরও বর্তমানেও কেন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ জান্নাতুন নাহার বলেন, ‘দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই তো আমার মতো অবস্থা। স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। অনেকের অনুমোদন নেই। সবারই একই অবস্থা, শুধু আমার বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ কেন?’
রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার ৯/এ সড়কের ৫৭ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করে হোম সার্ভিস চালাচ্ছে প্রাইম টিচার ট্রেনিং কলেজ। এই ঠিকানায় কোনও ধরনের ইনস্টিটিউটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব কোনও জায়গা বা ভবন নেই। ভাড়া করা ভবনও নেই বর্তমানে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে প্রশিক্ষণার্থী রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রশিক্ষণ না করিয়ে শুধু লিখিত পরীক্ষা নিয়েই সনদ বিতরণ চালিয়ে যাচ্ছে হোম সার্ভিসের মতো।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে রশিদের মাধ্যমে গত ১২ ডিসেম্বর বিএড প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ২ হাজার টাকা। অভিযোগ রয়েছে, জুরাইন আদর্শ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করেন তিনি। আর যখন ভর্তির জন্য কেউ ফোন দেয় তখন নিজেই প্রশিক্ষণার্থীর কাছে ছুটে যান। এভাবেই হোম সার্ভিস চালু রেখেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে অধ্যক্ষ আল মুজাহিদ বলেন, ‘করোনার কারণে ভাড়া দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনলাইনে আমরা ক্লাস নিচ্ছি। শিগগিরই অফিস নেওয়া হবে।’ এটা সনদ বাণিজ্য মনে করেন কিনা জানতে চাইলে অধ্যক্ষ আল মুজাহিদ বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা হয়। সনদ বিক্রি হয় না।’
উত্তরার ১২ নং সেক্টরের পারসেপশন ক্যারিয়ার সেন্টারকে ক্যাম্প অফিস বানিয়ে হামিদা আক্তার চালাচ্ছেন ‘কলেজ অব এডুকেশন রিসার্চ’ নামের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। পারসেপশন ক্যারিয়ার সেন্টারকে ক্যাম্প অফিস হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। শুধু তাই নয়, বিএড প্রশিক্ষণার্থীদের বেতনও নেওয়া হয় পারসেপশন ক্যারিয়ার সেন্টারের মানি রিসিভের মাধ্যমে। নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই প্রতিষ্ঠানটির।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজ অব এডুকেশন রিসার্চের অধ্যক্ষ হামিদা আক্তার বলেন, ‘মতিঝিলে ভাড়া করা ভবন রয়েছে প্রতিষ্ঠানের।’ পারসেপশন ক্যারিয়ার সেন্টারের মানি রিসিভ দিয়ে বিএড শিক্ষার্থীদের কেন বেতন নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। বলেন, ‘আমি জানি না।’ পরে পারসেপশন ক্যারিয়ার সেন্টারে ফোন করে জানা গেছে দুই প্রতিষ্ঠানেই রয়েছেন হামিদা আক্তার।
নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডের মাদানী নগর এলাকায় মর্নিংসান কেজি স্কুলের মালিক পরিচালিত আইডিয়াল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের নিজস্ব কোনও ক্যাম্পাস নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তও নয় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু মর্নিংসান স্কুল অ্যান্ড কলেজের মানি রিসিটে বিএড প্রশিক্ষণার্থীদের বেতন গ্রহণ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ আলী আজম বলেন, ‘আমি শুধু মর্নিংসান কেজি স্কুল পরিচালনা করি। আইডিয়াল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রস্তাবিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত না হওয়ায় পরিচালনা করা হয় না।’
আলী আজম বিষয়টি অস্বীকার করলেও মর্নিংসান কেজি স্কুলের মানি রিসিভে বিএড শিক্ষার্থীদের বেতন নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। গত ২০ ডিসেম্বরের একটি রশিদে একজন বিএড শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ১ হাজার টাকা। এছাড়া কলেজটির প্রসপেক্টাসে দেখা গেছে বিএড ও এমএড কোর্সসহ এলএলবি কোর্সে ভর্তির তথ্য।
পল্লবীর শেরেবাংলা টিটি কলেজ অন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ না করিয়ে শুধু পরীক্ষার ব্যবস্থা করে সনদ দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নেই সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণার্থী সংগ্রহ করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয় টাকার বিনিময়ে। তবে শেরেবাংলা টিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসেন হাওলাদার সনদ বিক্রি ও প্রশিক্ষণার্থী সংগ্রহের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। টাকা দিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের সনদ দেওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সার্টিফিকেট বিক্রি হয় নাকি? যেখানে হয় সেখানে যান। এসব কথা আমার লগে বলবেন না।’
শুধু এই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই নয়, দেশের বেশিরভাগ কলেজের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কোনও প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেই। কোনও প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই। আবার কোনও প্রতিষ্ঠানের ভাড়া করা ভবনও নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এসব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট যথাযথ মনিটরিং করার কথা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। তার পরও বছরের পর বছর এভাবেই চলছে ইনস্টিটিউটগুলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট ৭১টি বেসরকারি টিচার ট্রেনিং কলেজের অর্ধেকের বেশি চলছে সনদ ব্যবসানির্ভর।
জানা গেছে, টাকা দিয়ে সনদ পাওয়ার সুযোগ থাকায় দেশের মানসম্মত বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণার্থীরা ভর্তি হতে চান না।
আরও যেসব শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের বিরুদ্ধে সনদনির্ভর প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে ঢাকার আজিমপুরের মহানগর টিটি কলেজ, হাকিম চাঁদপুরের সেকান্দার টিটি কলেজ, মিরপুরের ফজিলাতুন্নেছা টিটি কলেজ, রাজধানীর সাইক টিটি কলেজ এবং নীলক্ষেতের নিউ রাজধানী টিটি কলেজ।
প্রতারণার শিকার একাধিক প্রশিক্ষণার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতারণা ও সনদ বিক্রি চলছে দীর্ঘদিন থেকে। দেখার কেউ নেই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন (স্নাতকোত্তর শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র) অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অধিভুক্ত নয় এমন কিছু টিটি কলেজের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। মামলা শেষ না হওয়ার আগে আমাদের কিছু করার নেই। যাদের অনুমোদন নেই তারা এখন ভর্তি করাতে পারবে না। অনলাইনে ভর্তি করা হয় নির্দিষ্ট আসনের ভিত্তিতে। আসন সংখ্যার অতিরিক্ত ভর্তির সুযোগ নেই।’ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষক ও অবকাঠামো নেই এমন প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মনিটরিং করতে হয়, তদন্ত করতে হবে, যাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষক ও অবকাঠামো নেই তারা অনুমোদন হারাবে।’
সুত্র-বাংলা ট্রিবিউন।