লাখ লাখ মানুষকে বেকার রেখেই সম্প্রতি ওয়ার্ক পারমিট আর স্টুডেন্ট ভিসার শর্ত শিথিলের পদক্ষেপ নিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। ভিসার শর্ত শিথিলকে ব্রিটিশ সরকারের আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিভিন্ন ভিসায় ব্রিটেনে যারা আসবেন, তাদের আয়ের বড় অংশই ব্যয় হবে ভিসা টিকিয়ে রাখার বিভিন্ন ফি, ট্যাক্সসহ নানা খাতে। তাদের আয় করা টাকাগুলোর বড় অংশ যাতে ঘুরেফিরে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ফিরে যায় সেই রকম কৌশল রেখেই পয়েন্ট বেইজড ভিসা সিস্টেম প্রতিনিয়ত আপডেট করা হচ্ছে।
ব্রেক্সিট আর করোনার কবলে ব্রিটেন এখন বিপর্যস্ত। এই মুহুর্তে ১৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার। কেবল চলতি বছরের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৫ লাখের বেশি মানুষ কাজ হারান। ২০০৯ সালের পর থেকে গত ১১ বছরের মধ্যে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশটির অফিস ফর ন্যাশন্যাল স্টাটিসটিকস (ওএনএস)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটেনে গত তিন বছরের মধ্যে বেকারত্বের হার এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। আগষ্টে বেকারত্বের হার বেড়েছে ৪. ৫ শতাংশ যা পুর্ববর্তী তিন মাসের তুলনায় ৪.১ শতাংশ বেশি। ব্রিটেনের অর্থনীতির সব সুচক পড়তির দিকে।
কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন করোনার শুরু থেকেই নিজ দেশের লাখ লাখ কাজ হারানো মানুষকে বেকারত্ব ভাতাসহ নানা আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে। খোদ বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন লন্ডনের মেয়র থাকাকালে ও সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুলাইতে দেশটিতে বসবাসরত প্রায় এক লাখ বৈধ কাগজপত্রবিহীন বাংলাদেশিসহ পাঁচ লক্ষাধিক অ-নথিভুক্ত অভিবাসীকে বৈধতা দেবার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু, বরিস জনসনের সরকার নতুন করে ওয়ার্ক পারমিট ভিসার শর্ত শিথিল করে নতুন করে কর্মী আনবার পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই এটা এখন স্পষ্ট যে বৈধ কাগজপত্রবিহীনদের বৈধতা দেবার পরিকল্পনা সরকারের নেই। কারণ, ছয় লক্ষাধিক মানুষকে বৈধভাবে কাজের সুযোগ দেবার পাশাপাশি নতুন বিদেশি কর্মীদের কাজের ক্ষেত্র এই মুহুর্তে ব্রিটেনে নেই। বাস্তবতা হলো, করোনাকাল পার হলেও সম্ভাব্য নো ডিল ব্রেক্সিটের পর জব মার্কেট ও অর্থনীতি আপদকালীন পরিস্থিতিতে বরং নেতিবাচকতায় মোড় নেবার শংকাই বেশি।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
ব্রিটেনের লাখ লাখ নাগরিক বেকার। এর বাইরেও কর্মীর দরকার হলে বৈধ কাগজপত্রবিহীনদের বৈধতা দিতে পারত সরকার। তাদের দীর্ঘদিন এদেশে কাজের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। আর কাগজপত্র ঠিক না থাকলেও তারা গোপনে এদেশে কাজ করছেন। কিন্তু সে কাজের ট্যাক্স, এনআইয়ের অর্থ থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। এসব মানুদের ফেলে রেখে নতুন লোক নিয়ে আসাকে বিভিন্ন ফির নামে সরকারের আয় বাড়ানো আর মন্দা তাড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন সমালোচকরা। ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগবে না। শুধু ইংরেজিতে প্রাথমিক দক্ষতার বি ওয়ান (b1) পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে হবে। একটি কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তাকে নিয়োগ দিতে হবে।
নিকট অতীতে দেখা গেছে, ব্রিটেনে যখনই আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছে, তখনই স্টুডেন্ট ও ওয়ার্ক পারমিট ভিসার শর্ত শিথিল করে মানুষ আসার পথ সুগম করে দেয় সরকার। ভিসা আবেদনকারীদের বিভিন্ন ফির মাধ্যচমে সরকার সরাসরি আর্থিকভাবে লাভবান হয়। পরবর্তীতে ব্রিটেনে ভিসা পুনঃনবায়ন প্রক্রিয়ায় আবেদনকারীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারকে বিভিন্ন পর্যায়ে পরিশোধ করেন। দ্বিতীয় সারির কলেজ বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় গুলো টিকিয়ে রাখায় বিদেশী শিক্ষার্থীদের পরিশোধিত ফি বরাবরই বড় অবদান রেখে এসেছে।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত পুর্বদেশ সম্পাদক, অধ্যাপক ড. রেনু লুৎফা রবিবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্রিটেনের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় আছে। সরকার বলছে, আয় বাড়াতে যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, সবগুলো পদক্ষেপ তারা নেবে। ওয়ার্ক পারমিট বা স্টুডেন্ট ভিসার শর্ত কিছুটা শিথিল করার মুল কারণ সরকারের আয় বাড়ানো।’
ওয়ার্ক পারমিট ভিসার ক্ষেত্রেও সরকারের বেঁধে দেওয়া ন্যুনতম আয়সীমার শর্ত পুরণে অনেকে কাজ না করেও সরকারের ট্যাক্স পরিশোধে বাধ্য হন, বৈধভাবে দেশটিতে থাকার সুবিধার আশায়। এমন ঘটনা অতীতে হরহামেশাই দেখা গেছে। ঘটেছে একই ওয়ার্ক পারমিট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি, ওয়ার্ক পারমিটে মানুষ আনার পর কোম্পানি বন্ধ করে দেবার প্রতারণাও।
স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান স্টাডি এইডের কর্ণধার আহমেদ বখত চৌধুরী রতন বলেন, ‘অতীতে দেশে সার্টিফিকেট কিনেও স্টুডেন্ট ভিসায় ব্রিটেনে আসতেন। এখন আইইএলটিএস বাধ্যতামূলক করায় সে ধরনের প্রতারণা ঠেকানো গেছে। আগে অসংখ্য ভুয়া কলেজ ছিল, যেগুলোকে ভিসা কলেজ বলা হত এখন সেটা বন্ধ করেছে ইউকেবিএ। কিন্তু, সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। টাকার বিপরীতে পাউন্ডের দাম কমেছে। এখন যারা স্টুডেন্ট ভিসায় আসতে চান তাদের চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ না হয়ে সব বিষয় জেনে বুঝে আসতে হবে।’
ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের ট্রেজারার সাইদুল ইসলাম একসময় নিজেও ব্রিটেনে এসেছিলেন স্টুডেন্ট ভিসায়। তিনি বলেন, ২০০৭ বা তার পরবর্তী সময়েও যখনই একদিকে সরকার ষ্টুডেন্ট ভিসার পথ সুগম করে। অন্যদিকে,তারা শুরু করে ইউকে বর্ডার এজেন্সির মাধ্যেমে ধড়পাকড়। সরকার কৌশলের অংশ হিসেবেই ভিসার মেয়াদ হারানো বা শর্ত ভঙ্গের অপরাধীদের ধরতে শুরু করে ইমিগ্রেশন রেইড। ধরপাকড়ের মুখে অতীতেও হাজারো বাংলাদেশী শিক্ষার্থীকে শিক্ষাজীবন শেষ না করেই নিঃস্ব অবস্থায় দেশে ফিরতে হয়েছে।
ইমিগ্রেশন পরামর্শক ও কলামিষ্ট বিপ্লব কুমার পোদ্দারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, যাদের ভিসার মেয়াদ আগেই শেষ হয়ে গেছে, তারা দেশে ফেরত গিয়ে ওয়ার্ক পারমিটে নতুন করে ফিরে আসতে চাইলে সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা কতটুকু। তিনি জানান, ওভারস্টেয়ারদের ক্ষেত্রে ভিসা না পাবার সম্ভাবনাই বেশি। ভিসার মেয়াদের পরে এদেশে থাকার মানে ইমিগ্রেশন আইন ভঙ্গ করা। এছাড়া ওভারস্টেয়ার কেউ একবার দেশ থেকে বেরিয়ে গেলে তার বসবাসজনিত কন্টিনিউয়েশনের সুবিধা হারাবেন। তিনি বলেন, ‘যারা আসলেই লেখাপড়া করতে চান, ব্রিটেন মুলত তাদেরই স্বাগত জানাতে চায়।’
ব্রিটেনে বর্তমানে কী ওয়ার্কার হিসেবে কর্মরত হাজার হাজার বিদেশী কর্মী জানুয়ারী থেকে চালু হওয়া পয়েন্ট বেইসড ভিসা সিস্টেমে বিপাকে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছে বিভিন্ন ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, বহু কর্মরত কী ওয়ার্কার ব্রিটেনের কাজের ভিসার নতুন শর্ত পূরণে সক্ষম হবেন না। ব্রিটেনের ন্যাশন্যাল ইউনিয়ন অব জেনারেল এন্ড মিউনিসিপ্যাল ওয়ার্কার্সের (জিএমবি)সেক্রেটারি রেহানা আজম বলেছেন, দেশটিতে বর্তমানে কর্মরত অনেকের ক্ষেত্রেই নতুন ইমিগ্রেশন বিলের শর্ত পুরন করা অসম্ভব হবে।
এমন অবস্থায় নতুন কর্মীদের পরিস্থিতি কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।