বাংলাদেশের সাহায্যেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভোলবদল দেখছেন শ্রিংলা

বাংলাদেশে বহুচর্চিত সফর সেরে সদ্যই ফিরেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। সেই সফরের উদ্দেশ্য কী, অর্জনই বা কী – তা নিয়ে দুই দেশের সংবাদমাধ্যমে জল্পনা ও বিতর্কও কম হয়নি। কিন্তু সেই সফরের মাত্র কয়েকদিনের মাথায় মিস্টার শ্রিংলা একটি সেমিনারের কি-নোট ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন, ভারতের তথাকথিত অবহেলিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বীজ নিহিত আছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সহযোগিতার ওপরই। ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত ভারতের এই অঞ্চলটির স্বার্থ যে বাংলাদেশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সেই স্বীকৃতিও এলো সরাসরি তার মুখ থেকে।.

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা (ছবি: ফোকাস বাংলা)

উপলক্ষটা ছিল সিকিমের আইসিএফএআই বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত একটি ওয়েবিনার। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ ও ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির কী প্রভাব দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পড়ছে, তা নিয়ে এ সপ্তাহের ওই আলোচনায় মূল ভাষণটি উপস্থাপন করেন পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা। আর সেখানেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গের অবতারণা করেন তিনি।

কিন্তু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে নিয়ে ঠিক কী বলেছেন শ্রিংলা?

(ক) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিদেশনীতির মূল স্তম্ভ নেইবারহুড ফার্স্ট (সবার আগে প্রতিবেশীরা) ও অ্যাক্ট ইস্ট (পূর্বমুখী নীতির বাস্তবায়ন) পলিসি। যার সুবাদে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির নতুন নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে। আর এর ফলে উপকৃত হচ্ছে উভয় ভূখণ্ডই।

(খ) ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে পর্যন্ত ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ছয়টি রেল সংযোগ চালু ছিল। এর মধ্যে আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চারটি রেল সংযোগই আবার চালু হয়ে গেছে। আর বাকি দুটি আছে চালু হওয়ার অপেক্ষায়।

গ) পশ্চিমবঙ্গের হলদিবাড়ি থেকে বাংলাদেশের চিলাহাটি পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেলপথের কাজ শেষ হলে ব্রিটিশ আমলের ঐতিহ্যবাহী দার্জিলিং মেল আবার সেই পুরনো পথে চলতে পারবে। শিয়ালদা থেকে শিলিগুড়ি যেতে (বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে) সময় লাগবে মাত্র সাত ঘণ্টা। (দিল্লির সাউথ ব্লক সূত্রের আভাস, এই রেলপথের উদ্বোধন হতে পারে আগামী বছর ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে)।

(ঘ) এছাড়া বাংলাদেশের আখাউড়া থেকে ভারতের আগরতলা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজও শেষের পথে। দুই দেশের নাগরিকরা শুধু মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপ্রেসেই রেলপথে যাতায়াত করতে পারছেন তা-ই নয়। ঢাকা থেকে শিলং এবং আগরতলা থেকে ঢাকা হয়ে কলকাতা রুটেও বাসে সীমান্ত পারাপার করছেন অজস্র যাত্রী।

(ঙ) উত্তর-পূর্ব ভারত আর বাংলাদেশকে সংযুক্ত করে রেখেছে একটি অভ্যন্তরীণ নদী নেটওয়ার্ক। এই পথে নৌ আর পণ্য চলাচল উৎসাহিত করতে ব্রহ্মপুত্র আর বরাক অববাহিকা জুড়ে মোট কুড়িটি বন্দর-নগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা সমগ্র অঞ্চলের মাল্টিমোডাল লিঙ্কেজকেই (বহুমুখী সংযোগ) আমূল বদলে দেবে। ওদিকে আশুগঞ্জ নদী-বন্দর হয়ে এবং তারপর আখাউড়া-আগরতলা সড়কপথেও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন শুরু হয়ে গেছে।

(চ) বাংলাদেশ ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পর কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য পণ্যের প্রথম চালান দিনকয়েক আগেই বাংলাদেশে ভিড়েছে। গোমতী নদী দিয়ে বাংলাদেশ থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্যের চালান গেছে ভারতের ত্রিপুরাতেও।

(ছ) বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের যে ভৌগোলিক নৈকট্য, সে কারণে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য ও প্রসেসড ফুডের বিরাট চাহিদা রয়েছে ভারতের ওই রাজ্যগুলোতে। এই বাণিজ্যের প্রসারের জন্য স্থল বন্দরগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে, তাতে দুদিকেই কর্মসংস্থান বাড়বে ও উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।

(জ) এই মুহূর্তে বাংলাদেশ তার লাগোয়া ভারতীয় রাজ্যগুলো থেকে মোট ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে থাকে। এছাড়া ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন দিয়েও অচিরেই বাংলাদেশে হাউড্রোকার্বন (জ্বালানি) রফতানি শুরু হবে। উত্তর-পূর্ব ভারতের যে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা, সেটাও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে রফতানি করতে চায় ভারত।

এইভাবে একের পর এক দৃষ্টান্ত দিয়ে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভবিষ্যৎ কীভাবে বাংলাদেশের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করেছে। নিজের ভাষণে তিনি জাপানের সহযোগিতার প্রসঙ্গও এনেছেন। কিংবা মিয়ানমার-ভুটান-নেপালও কীভাবে এই ‘বাংলাদেশ মডেল’ প্রয়োগ করতে পারে সে কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তার বক্তব্যের সিংহভাগ জুড়েই ছিল বাংলাদেশ।

দীর্ঘদিন ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত পদে থাকার সুবাদে বাংলাদেশের সঙ্গে তার যে আলাদা একটা কানেকশন, সে কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি মিস্টার শ্রিংলা।

পররাষ্ট্র সচিবের এই দীর্ঘ ভাষণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ইতিবাচক ইঙ্গিতই দেখছেন দিল্লির পর্যবেক্ষকরা।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক বীণা কুকরেজাও মনে করেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক ঢাকা সফর যে সর্বতোভাবে সফল ছিল এই ভাষণও তার একটা প্রমাণ।

বাংলা ট্রিবিউনকে ড. কুকরেজা বলছিলেন, ‘ঢাকা থেকে খালি হাতে ফিরতে হলে মি. শ্রিংলা তার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশের এই সব সহযোগিতার কথা এত ফলাও করে বলতেন না বলেই আমার ধারণা। আর তার ভাষণ থেকে এটাও পরিষ্কার, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক খুবই পরিণত ও ঋদ্ধ। এখানে চীনের ছায়া খোঁজার কোনও প্রয়োজনই নেই।’

Share: