আঠারােটি বুলেট ও রক্তস্নাত বাংলাদেশ – বাহালুল মজনুন চুন্ন

আঠারােটি বুলেট ও রক্তস্নাত বাংলাদেশ  – বাহালুল মজনুন চুন্ন  পর্ব -১
কী নিষ্ঠুর! কী পাষণ্ড! এও কী সম্ভব? ওরা কি মানুষ? পারল কিভাবে ওরা ? ওদের বুক কি একটুও কাঁপল না? একটুও কি বিবেক দংশালাে না? এমনই হাজারাে প্রশ্ন আজ একচল্লিশটি বছর ধরে মনের মধ্যে বারে বারে উকি দিয়ে যায়, কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। ওদেরকে নির্দয়, নিষ্ঠুর, পাষণ্ড কত কিছুতেই তাে আখ্যা দেই, তবু মন ভরে না। নাহ, ওরা মানুষ নয়। তবে হায়েনা? হায়েনাদেরই অপমান হয় তাতে। ওরা নরকের কীট। না, তারচেয়েও অতি জঘন্য কিছু। হবেই না কেন, ওরা যে ওদের পিতাকেই হত্যা করেছে। ওরা সেই পিতাকেই আঠারােটি বুলেট ছুঁড়ে হত্যা করেছে, যে পিতার কারণে ওরা পরাধীনতার বিষবাষ্প থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন দেশে শান্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। ওরা সেই পিতাকেই হত্যা করেছিল, যে পিতা নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে ওদের মুক্তির জন্য ফাসিমঞ্চেও যেতে দ্বিধা করেননি একটুখানির জন্যও। ওরা সেই পিতাকেই সপরিবারে হত্যা করেছিল, যে পিতা ওদেরকে প্রজাপতির রঙিন ডানায় আঁকা নবকিরণের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মন্ত্র শিখিয়েছিল! মীরজাফরের থেকেও ভয়ানক সেই বিশ্বাসঘাতকের দল এতটাই পিশাচতুল্য যে, শিশুর কান্নাও ওদের মনকে একটুও ভেজাতে পারেনি। ওদেরকে তাই জঘন্য, অতিব জঘন্য কোন কিছুর সঙ্গে তুলনা করেই শেষ করা যায় , ওরা সেই তুলনার চেয়েও বেশি জঘন্য।
সেই পনের আগস্টের ভােরে পুরাে ধরত্রীই থমকে গিয়েছিল, বেদনায় মুষড়ে পড়েছিল বিষম। বাতাস ফুপিয়ে কাঁদছিল, আকাশ হয়ে গিয়েছিল অধিক শােকে পাথর। সৃষ্টির পর থেকে এমন শােকের ঘটনা বিশ্ব প্রকৃতি আর কখনই বােধ হয় প্রত্যক্ষ করেনি। এমন বিশ্বাসঘাতকতাও বােধহয় আর কখনই দেখেনি।                                                                                                                                  তাই পুরাে বিশ্ব প্রকৃতির হয়ে গিয়েছিল নিস্তব্ধ, শােকে মুহ্যমান পাষাণ। আর বিমূঢ়, বাকহারা হয়ে গিয়েছিল বিশ্বমানব সম্প্রদায়। যে মহান ব্যক্তি একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিল, সেই তাঁকেই তাঁরই দেশের মানুষের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে, তা বিশ্ববাসীর কাছে ছিল যেমন অবাক বিস্ময়ের, তেমনি শােকের। তাঁরা সেদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির পিতা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে কেঁদেছিলেন। কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়েছিলেন। অশ্রু তাদের বাঁধ মানেনি। অকূল ধারায় বহমান তাদের সেই অস্র বাম্প হয়ে ধরণীর নানা প্রান্ত থেকে এসে জড়াে হয়েছিল ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরের ছয়শ সাতাত্তর নম্বর বাড়ির আঙিনায়।
বিশ্বচোখে বঙ্গবন্ধু – দিপু সিদ্দিকী
তারপর মেঝেতে পড়ে থাকা মহামানবের রক্তের স্রোতের সাথে মিশে গিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল। কিন্তু দুভার্গ্য, যাদের জন্য তিনি আজীবন মরণপণ লড়াই করে গিয়েছিলেন, যাদের সুখের জন্য, যাদের মুখে হাসি ফোটানাের জন্য নিজের জীবনের সকল আরাম আয়েশকে ত্যাগ করেছিলেন, জেলজুলুম-অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছিলেন, সেই তারাই তাঁর নির্মম মৃত্যুতে উচ্চস্বরে কাঁদতে পারেনি। ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন তাদের কাদতে দেয়নি, পিতা হারানাের শোক গাঁথা তৈরি করতে দেয়নি। কিন্তু সর্বত্রই ছিল চাপা দীর্ঘশ্বাস, চাপা কান্না। গুটিকয়েক নরপিশাচ তথা পাকিস্তানি হানাদারদের প্রেতাত্মারা ছাড়া দিকভ্রান্ত, দিশেহারা পুরাে জাতি চাপা দীর্ঘশ্বাস আর চাপা কান্নার মধ্যে দিয়েই তাদের পিতাকে মনে মনে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। সেই রাতটি ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময়, অশ্রুভেজা এক রাত।
সেই রাতের কথা ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জনপদের প্রতিটি ধূলিকণা কখনও ভুলতে পারবে না। পারা সম্ভবও নয়। রক্তের কালিতে লেখা সেই রাতের শােকগাঁথা বীণার করুণ সুর হয়ে বাঙালির হৃদয়ে বেজে চলে অনবরত। আমার হৃদয়ে অনিশ সেই সুর বেজে চলে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন কর্মী হওয়ায় সেই মহামানবের, সেই মহান বীরের সান্নিধ্যে আসার সুযােগ হয়েছিল আমার। সেই অকুতােভয় দেশপ্রেমিক যােদ্ধাকে, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি, বােঝার ও শেখার চেষ্টা করেছি। তাঁর সান্নিধ্য যতবার পেয়েছি, ততবারই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি, নিজের মাঝে নতুন এক শক্তিকে জেগে উঠতে দেখেছি। যখন শুনলাম আমার সেই শক্তির উৎসধারা আঠারােটি বুলেটে বিদ্ধ, তখন বুক ফেটে কান্না দুমড়ে উঠেছিল। কী নিদারুণ কষ্ট! পিতা হারানাের বেদনা যে কত কঠিন, তা সেই ভয়ংকার কাল রাতের পরের সকালেই বুঝেছিলাম।
পিতা আমাদের মাঝে আসবেন, এই খুশিতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রঙিন করে তুলেছিলাম। অনেকগুলাে সুসজ্জিত গেট করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে পুরাে ক্যাম্পাসকে ঝকঝকে তকতকে করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল প্রায় একমাস ধরেই। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন অন্যায়ের প্রতিবাদের কারণে তাঁর ছাত্রত্ব চলে গিয়েছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আসবেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। তাকে সাদরে বরণ করে নিতে আমরাও ফুলের ঢালি সাজিয়ে রেখেছিলাম । আমাদের হৃদয়ের সকল ভালােবাসা উজার করে তাঁকে পুষ্পমাল্যে বরণ করে নেব এই প্রত্যাশায় আমরা ছিলাম উজ্জীবিত প্রাণ। কিন্তু হায়! আঠারােটি বুলেট তার প্রাণবায়ুকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল। মহামানবের স্মৃতিমাখা বিদ্যাপীঠে তাঁর পুর্নবার পদচারণা বাস্তবে রূপ পায়নি সেদিন। তাঁকে আমরা বরণ করে নিতে পারিনি পুষ্পমাল্যে দিয়ে। সেদিন থেকে অদ্যবদি এই না পারার অতৃপ্তি আমাকে দপ্ধ করে, কাদায়।
সেরাতে আমরা কলাভবনের পূর্বদিকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে অনুষ্ঠান পরিচালনা ও সকল ডেকোরেশনের তদারকি করছিলাম। ক্লান্তিহীনভাবে আমরা কয়েকজন বন্ধু কাজ করে গিয়েছিলাম। আমাদের আর্দশের মহানায়ক আসবেন, তাই ক্লান্তি আমাদের কাছে ঘেঁষতে পারেনি। সকল কাজকর্ম সেরে আমরা কয়েকজন বন্ধু মহসিন হলের গেস্টরুমে বসে নানান বিষয় নিয়ে আলাপ-আলােচনা করতে করতে সেই রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছিলাম। আনুমানিক পৌনে পাঁচটার দিকে আমাদের বন্ধু আবু বকর সিদ্দিক দৌড়ে এসে গােলাগুলির আওয়াজ হওয়ার কথা বলে। আমরাও শুনতে পেলাম। আমরা দৌড়ে হলের ছাদে উঠে যাই। ধানমন্ডি দিক থেকে আর মিন্টো রােডের দিক থেকে গােলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই। অজান্তেই শরীর হিম হয়ে যায়। অজানা আশংকা চিত্তমাঝে খেলা করতে থাকে। যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল। আমরা বেরিয়ে পড়ি, কী হয়েছে তা না জানা পর্যন্ত পরিত্রাণ নেই।
প্রথমা শাহবাগ এসে দেখে কালো পােশাক পরিহিত ট্যাঙ্ক বাহিনী সেখানে অবস্থান নিয়েছে; তখন আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় গুলি হচ্ছিল। আমারা মিন্টু রােডের দিকে যেতে চাইলে ওরা বাধা দেয়। এরপর আমরা নানা উপায়ে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের কাছে যাই। সেখান থেকে আর সামনের দিকে এগােতে পারি না। বাসস্ট্যান্ডে কিছু লােক দাঁড়িয়ে কানাঘুষা করছিল। তাদের কানাঘুষায় শুনতে পেলাম আমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যে পিতা একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে সেই রাষ্ট্রেরই কেউ হত্যা করেছে! ভাবতেই পারছিলাম না। আমাদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ফোটা ফোটা অশ্রু মুছতে মুছতে আমরা হলে ফিরে আসি।      ————————————- চলবে
লেখকঃ সিনেট ও সিণ্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
Share: