বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচারের ৫০ বছর

প্রেসওয়াচ ডেস্কঃ শুরুটা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। এদিন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে প্রথম শোনা যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ডাক। নামটা ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। তবে সে নামটা থেকে ‘বিপ্লবী’ অংশটা ফেলে দেওয়া হয়। সেখানে বেশিদিন থিতু হওয়ার সময় পায়নি কেউ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বোমা হামলায় দ্রুত বন্ধ হয়ে যায় কেন্দ্রটির কার্যক্রম।

পরবর্তী সময় ২৫ মে কলকাতার বালিগঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

কেন্দ্রটির তরুণ সুরযোদ্ধা ছিলেন সুজেয় শ্যাম। তিনি  বলেন, ‘চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভারত সরকার বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার (৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ) প্রদান করে। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার মূলত সবকিছু দেখভাল করছিল। প্রথম অধিবেশনের দিন ধার্য করা হয় কবি নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে)। এ প্রস্তাবনাটি ছিল জননেতা আব্দুল মান্নানের। তিনি মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এম.এন.এ ছিলেন। তবে আমি যোগ দিই আরও কয়েকদিন পরে।’

 সুজেয় শ্যাম জানান, জুনের ৭ তারিখে তিনি বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডের বাসাটিতে যান। ততদিনে এটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যালয় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

এই সুরস্রষ্টার ভাষ্য, ‘‘৭টি পরিবার নিয়ে সিলেট থেকে আমি কলকাতাতে গিয়েছিলাম। সেখানেই ছিলাম কয়েকদিন। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতারের সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু বলতে পারত না। একদিন ট্রামে করে যাওয়ার সময় দেখি সুভাস দত্ত দা বসে আছেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘চলো আমার সঙ্গে’। তারিখটা সম্ভবত ৭ জুন। গেলাম বালিগঞ্জে। দেখি আমার পরিচিত অনেকেই আছেন। সমর দাস, আপেল মাহমুদ, আবদুল জব্বার, মালা খুররম, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, রথীন্দ্রনাথ রায়, অশীথ, অনুপ ভট্টাচার্যসহ অনেকেই ছিলেন। সেদিনই কাজ শুরু করি।’’

 সুজেয় শ্যাম সুজেয় শ্যাম জানান, প্রথমদিনেই গানের কাজে লেগে পড়েন। তৈরি করেন ‘আয়রে চাষি মজুর কুলি’। এই সংগীত পরিচালক মোট নয়টি নতুন গান সৃষ্টি করেন। এমনকি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ গানও তার তৈরি।

দিনটা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সকালবেলা পশ্চিমবঙ্গের বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আলাদা উত্তেজনা। শোনা যাচ্ছিল, যেকোনও মুহূর্তে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। আর এ জন্য নেওয়া হলো প্রস্তুতিও। বেতারের দুই কর্মকর্তা আশফাকুর রহমান ও তাহের সুলতান ডেকে পাঠালেন সুজেয় শ্যামকে। উদ্দেশ্য, বিজয়ের গান তৈরি। বেশ তড়িঘড়ি করেই গীতিকার শহীদুল ইসলাম লেখেন ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’। আর এটাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গাওয়া শেষ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান।

 তবে শুধু গানই নয়, প্রায় সাত মাস ধরে চলা এই বেতার প্রচার করেছে নানা ধরনের উদ্দীপনী গান ও অনুষ্ঠান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিছু নিয়মিত অনুষ্ঠান হলো- চরমপত্র, মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধক্ষেত্রের খবরাখবর, রণাঙ্গনের সাফল্যকাহিনি, সংবাদ বুলেটিন, ধর্মীয় কথিকা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, সাহিত্য আসর ও রক্তের আখরে লিখি। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল অনুষ্ঠান এম আর আখতার মুকুল উপস্থাপিত ‘চরমপত্র’। এখানে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অসংলগ্ন অবস্থানকে পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার সংলাপে তুলে ধরতেন। চরমপত্রের পরিকল্পনা করেন আবদুল মান্নান।

এছাড়া ‘জল্লাদের দরবার’ পরিচালনা করতেন কল্যাণ মিত্র। অনুষ্ঠানটিতে ইয়াহিয়া খানকে ‘কেল্লা ফতে খান’ হিসেবে ব্যঙ্গাত্মকভাবে ফুটিয়ে তোলা হতো। ‘বজ্র কণ্ঠ’ অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের অংশবিশেষ সম্প্রচার করা হতো। যা বাঙালি জাতিকে নতুন করে উদ্দীপ্ত করত।

 স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেসময়ের আয়োজন নিয়ে কেন্দ্রটির আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি প্রয়াত কামাল লোহানীর বক্তব্য ছিল এমন, ‘আমাদের জন্য বেতার ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধক্ষেত্র, যার মাধ্যমে আমরা জনগণের সাহস বাড়াতে সহায়তা করেছিলাম।’ সুত্র-বাংলা ট্রিবিউন।

Share: