ডেইলি প্রেসওয়াচ/দিপু সিদ্দিকীঃ
যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি অভাবের কারণে গণটিকা কর্মসূচি যেন সাধারণ মানুষের জন্য গণহয়রানিতে পরিণত হয়েছিল। টিকা নিতে যেয়ে মানুষ হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়েছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে; অনেকে লাঠিপেটার শিকারও হয়েছেন। দীর্ঘ সময় লাইনে থেকেও কেউ কেউ টিকা পাননি। আবার কেউ পরে এসে আগে টিকা নিয়ে চলে গেছেন। অনেকে আবার একদিনেই পেয়েছেন ‘দুই ডোজ’!
গত সোমবার (১৬ আগস্ট) রাজধানীর তেজগাঁও জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের টিকাকেন্দ্রে হুড়োহুড়িতে এক নারী আহত হয়েছেন। ওই কেন্দ্রে সকাল ৯টা থেকে মডার্না ও কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টিকা আসে সাড়ে ১০টার পর। এরপর সিরিয়াল ভেঙে কিছু মানুষ টিকা নেওয়া শুরু করলে, ভোর থেকে অপেক্ষায় থাকা অন্যরা ক্ষুব্ধ হন। শুরু হয় হুড়োহুড়ি। সবাই এক সঙ্গে বুথে ঢুকতে গেলে ভেঙে যায় কাচের গেট। এসময় কাচের আঘাতে এক নারীর ঠোঁট ও মুখের কিছু অংশ কেটে যায়।
এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকাদান কেন্দ্রে গিয়েও দেখা গেছে টিকা প্রত্যাশীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। এখানে এখন টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে পরীবাগে অবস্থিত ডক্টরস ডরমেটরিতে।
সোমবার গিয়ে দেখা যায়, পরীবাগ ওভারব্রিজের নিচ থেকে এ ভবনের প্রধান ফটক পর্যন্ত ভিড়। মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। টিকাদান কেন্দ্রের ভেতরে তাবু টাঙিয়ে টিকাপ্রত্যাশীদের বসতে দেওয়া হয়েছে। সবাই টোকেন নিয়ে বসে আছেন। তাদের নাম ধরে ডাকার পর সেখানে টিকা দেওয়া হবে। কিন্তু সিরিয়াল কখন আসবে সেটা বলা হচ্ছে না। সেখানে দেখা ৬০ বছরের ইদ্রিস মোল্লার সঙ্গে। তিনি অসুস্থ। টিকা নিতে এসেছেন সকাল সাড়ে ৮টায়। কিন্তু দুপুর ১১টা পর্যন্ত টিকা পাননি। ইদ্রিস মোল্লা এ প্রতিবেদককে জানান, টেলিভিশনে শুনেছি অসুস্থ এবং বৃদ্ধদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু কোথায় কী! কতবার বললাম আমি অসুস্থ, বেশিক্ষণ বসে থাকতে
পারবো না- কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।
গত ১৪ আগস্ট টিকা নিতে যান মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, টিকা নিতে এত অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে যে এ কেন্দ্রের নিরাপত্তারক্ষীরা সেখানে লাঠিচার্জ করেছেন। মানুষ টিকা নিতে এসে লাঠিচার্জের শিকার হচ্ছেন- এটা বোধহয় কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব।
টিকা নিতে এসে লাঠিচার্জের শিকার হয়েছেন এমন একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমিতো পরিবারের সবাইকে বলব, দ্বিতীয় ডোজ নিতে না আসার জন্য। টিকা নিতে এসে যদি লাঠির বাড়ি খেতে হয় তাহলে সে টিকা আমি নিতে চাই না।
গত ১২ আগস্ট ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী উপজেলা ধোবাউড়ায় খোদেজা বেগম (৬৫) নামের এক বৃদ্ধাকে পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে করোনাভাইরাসের টিকার দুই ডোজ (সিনোফার্ম) দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ধোবাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকা নিতে গেলে এমন ভুলের শিকার হন তিনি।
হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ উপজেলার নৌ পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) বিদ্যুৎ দাসকে করোনার দুই ধরনের টিকার দুটি ডোজ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। করোনা ভ্যাকসিন হিসেবে তাকে দেওয়া হয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ। তবে শনিবার (১৪ আগস্ট) দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে তাকে সিনোফার্মের টিকা পুশ করা হয়েছে!
এদিকে, করোনার টিকাসহ সার্বিক কোভিড ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ তুলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সংসদীয় কমিটিও। অপর্যাপ্ত টিকার সংগ্রহ নিয়ে গণটিকার আয়োজন, শহর ও গ্রামাঞ্চলে ভিন্ন ধরনের টিকা কার্যক্রম পরিচালনাসহ নানা বিষয়ে অব্যবস্থাপনার কথা জানিয়েছেন কমিটির সদস্যরা। তবে, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কমিটির এ বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও অনুপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘সংসদীয় কমিটিতে গণটিকা নিয়ে কথা হয়েছে। দেশের মানুষ ১৭ কোটি। কিন্তু এক কোটি টিকার সংগ্রহ নিয়ে গণটিকার ঘোষণা কী করে সম্ভব? এ ধরনের কার্যক্রম সরকারকে বিব্রত করে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘টিকাকেন্দ্রে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কোভিড-১৯ এ যত কিছু উল্টাপাল্টা হলো, এর কারণ হচ্ছে- অব্যবস্থাপনা, অপরিপক্কতা, অপরিকল্পনা এবং দূরদর্শীতার অভাব।’
তিনি বলেন, ‘টিকা হাতে না পেয়ে টিকা আসছে- এ ভাবনা থেকে যখন গণটিকার ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। টিকাতো আমার দেশে তৈরি হচ্ছে না। যে টিকা আসার অপেক্ষা করা হচ্ছে, সেটা কোনও কারণে দেরি হতে পারে; কোনও কারণে বন্ধ হতে পারে- এগুলো ভাবা হয়নি। এখানেই দূরদর্শীতার অভাব ছিল। আবার টিকা না এলে কী করা হবে তারও কোনও ব্যাকআপ প্ল্যান ছিল না অধিদফতরের।
‘মানুষ যখন ভ্যাকসিন নিতে বেশি বেশি আসতে শুরু করলো, তখন এটা বন্ধ করে দেওয়া হলো। এই যে গণটিকা বন্ধ করে দেওয়া হলো, সেটাও যে মানুষকে ভালোভাবে বলতে হবে; বোঝাতে হবে- তারও কোনও নমুনা দেখা যাচ্ছে না’- বলেন তিনি।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ইকবাল আর্সলানও বললেন একই কথা।
তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে ব্যবস্থাপনা ভালোই ছিল। কিন্তু গণটিকা শুরু করার পরই অব্যবস্থাপনা শুরু হয়েছে। গণটিকাদান শুরু করার আগে আরও ভালো প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল। যেসকল কেন্দ্রে টিকাদান আগে থেকে চালু ছিল, সেখানে যে গণটিকা দেওয়া হবে না- এ বিষয়ে মানুষের কাছে পরিষ্কার তথ্য ছিল না। মানুষকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হইনি। ফলে মানুষ সব টিকাকেন্দ্রে ভিড় করেছে।’
‘প্রি-রেজিস্টার্ড ও নন রেজিস্টার্ড- সবাই মিলে জড়ো হওয়ার কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের ভুল হয়েছে এবং সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছে’- বলেন ইকবাল আর্সলান।