✍️ ড. দিপু সিদ্দিকী:ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সাত রাস্তার পাশের চিত্র এখন আর শিল্প ও আধুনিক নগর পরিকল্পনার প্রতিচ্ছবি নয়—বরং তা এক চরম বিশৃঙ্খলা, দখলদারিত্ব এবং দায়িত্বহীনতার প্রতীক। এখানে অবস্থিত কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, চ্যানেল ২৪, দৈনিক সমকাল, হামিম গ্রুপসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও কেপিআই (Key Point Installation) প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। অথচ সেই গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকেই যেন পঙ্গু করে তুলেছে ট্রাক মালিক-শ্রমিকদের অবৈধ কার্যকলাপ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর নির্লিপ্ততা।
সড়ক ও ফুটপাতের ৮০ ফুট প্রশস্ত পুরো এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে একের পর এক অবৈধ গাড়ি মেরামতের কারখানা। সেখানে দিনরাত চলে ধাতব কাটাকাটি, স্প্রে রং, ওয়েল্ডিং, মেশিনের বিকট শব্দ। এর ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণের মাত্রা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে, অন্যদিকে শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার ঘোরতর অবনতি হয়েছে। এখানকার পথচারী, প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছেন চরম দুর্ভোগে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন সেই শিক্ষার পথেই ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া, গ্যাস ও মাদকাসক্ত ভবঘুরেদের উৎপাত। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি, হতাশা ও ক্ষোভ—এই তিনটি মানসিক অবস্থা নিয়মিতভাবে তৈরি হচ্ছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে; ক্যাম্পাসে তাদের উপস্থিতিও দিনদিন কমে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হচ্ছে। পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরাও তাদের রাগ ও অসন্তোষ চাপা রাখতে পারছে না।
এত বড় একটি নৈরাজ্য চলতে থাকলেও প্রশাসনের ভূমিকা যেন ‘দেখেও না দেখা’র উদাহরণ। রয়েল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর এএনএম মেশকাত উদ্দিন এর নেতৃত্বে একটি টিম ঢাকার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গেও এই বিষয়ে সাক্ষাৎ করেন এবং গুরুতর সমস্যাটি গভীরতা তুলে ধরেন। কমিশনার মহোদয় সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন। কিন্তু কার্যত কোন ফলাফলি দেখা যায় নাই। একাধিকবার পুলিশ কমিশনার, ট্রাফিক বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠনকে অবহিত করা হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। বরং দিনের পর দিন অবৈধ কারখানাগুলোর দখল আরও বেড়েছে। ফুটপাত ও সড়ক দুটি দিকেই ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে—যেখানে আগে শুধু এক পাশে ছিল। এটি শুধু অব্যবস্থাপনা নয়, এটি রাষ্ট্রের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সামিল।

রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হল নাগরিকদের নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা—এই তিনটি খাতে যদি সরকার ব্যর্থ হয়, তবে উন্নয়নের সূচকে এগিয়ে যাওয়া শুধুই এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা।
এই মুহূর্তে জরুরি কিছু ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই:
🔹 অবিলম্বে অবৈধ মেরামত কারখানা উচ্ছেদ করতে হবে।
🔹 সড়কের উভয় দিক থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড স্থানান্তর করতে হবে।
🔹 কেপিআই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
🔹 নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশি টহল ও সিসিটিভি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
🔹 পরিবেশ অধিদপ্তরকে স্প্রে ও শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালাতে হবে।
সর্বোপরি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে—আজ যদি শিক্ষার্থীরা নিরাপদ না থাকে, আগামীকাল রাষ্ট্র নিরাপদ থাকবে না।
আমরা যারা নগরবাসী, আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে, গণস্বাক্ষর, প্রতিবাদ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পেইন চালিয়ে সরকারকে জোরালো বার্তা দিতে হবে—এই শহরের রাস্তাগুলো গাড়ির নয়, মানুষের জন্য।
তেজগাঁওয়ে আজ যে নৈরাজ্যের চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা যেন আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যে না ঘটে। এখনই সময় প্রশাসনের ঘুম ভাঙানোর—কারণ, আগামীকাল হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।
লেখক: প্রফেসর ড. দিপু সিদ্দিকী
শিক্ষাবিদ ও কলাম লেখক