
যৌথ বিশ্লেষণ : ড. এমাদুল ইসলাম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, ওশান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, জাপান এবং অধ্যাপক ড. দিপু সিদ্দিকী
প্রাক-কথন : বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জাপান
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই জাপান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদার। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন, অবকাঠামো নির্মাণ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে জাপানের অবদান অনন্য। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও জেআইসিএ-এর মাধ্যমে ৫ দশকে ৩৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অনুদান ও ঋণ প্রদান করেছে, যা ঢাকা মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু-সহ মেগা প্রকল্পগুলোতে প্রাণসঞ্চার করেছে। এই ঐতিহাসিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায়ও জাপান নীতিগত ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট: জাপানের বহুমাত্রিক উদ্যোগ
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১২ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জের সূচনা। জাপান এই সংকটকে কৌশলগতভাবে শনাক্ত করে “মানবিক সাহায্য, কূটনৈতিক মধ্যস্থতা ও টেকসই স্থিতিশীলতা”—এই তিন স্তম্ভের ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
১. মানবিক সাহায্য ও কূটনৈতিক তৎপরতা
– ২০১৭-২০২৩ পর্যন্ত ২১০ মিলিয়ন ডলার** বরাদ্দ (বাংলাদেশের একক বৃহত্তম দাতা)।
– মিয়ানমারের সাথে গোপন সংলাপে আসিয়ান ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা।
– জাপানের প্রস্তাবিত “টোকিও ডায়ালগ” আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভ করেছে।
২. স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বের উদ্যোগ
– স্কিলস ফর স্ট্যাবিলিটি : ১০,০০০ রোহিঙ্গাকে সেলাই, কাঠের কাজ ও ডিজিটাল লিটারেসি প্রশিক্ষণ।
– সৌরশক্তি প্রকল্প : ২০টি সৌরচালিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপন, যা দৈনিক ৩০ লিটার পানির চাহিদা মেটায়।
– জাপান-বাংলাদেশ যৌথ AI প্রযুক্তি : ভূমিধস পূর্বাভাসে ৮৫% নির্ভুলতা অর্জন (২০২৩)।
৩. গবেষণাভিত্তিক নীতি প্রণয়ন
– টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণা : শরণার্থীদের ৬৮% বিষণ্নতা ও PTSD-তে আক্রান্ত (২০২৩ সমীক্ষা)।
– জেএএক্সএ-র উপগ্রহ ডেটা ব্যবহার করে কক্সবাজারের ৬,০০০ হেক্টর বনভূমি পুনরুদ্ধারে প্রকল্প।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাপানের অবদান: একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা
| ক্ষেত্র | জাপানের অবদান (১৯৭২-২০২৩) | রোহিঙ্গা সংকটে সাহায্য (২০১৭-২০২৩) |
|————————-|————————–|———————————-|
| আর্থিক সহায়তা | ৩৫ বিলিয়ন ডলার | ২১০ মিলিয়ন ডলার |
| অবকাঠামো প্রকল্প | ১২০+ (মেট্রোরেল, সেতু) | ২০+ (সৌর প্রকল্প, ক্যাম্প অবকাঠামো) |
| কারিগরি প্রশিক্ষণ | ৫ লাখ+ বাংলাদেশি | ১০,০০০ রোহিঙ্গা |
চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ
– তাৎক্ষণিক : ক্যাম্পে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার ও ইন্টারপোলের সহায়তায় মানবপাচার রোধ।
– মধ্যমেয়াদি : রোহিঙ্গাদের জন্য বায়োমেট্রিক কর্মপরমিট চালু ও স্থানীয়দের সাথে সমন্বিত অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ।
– দীর্ঘমেয়াদি : আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা ত্বরান্বিতকরণ ও আঞ্চলিক কম্প্যাক্ট চুক্তি বাস্তবায়ন।
বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন
_”জাপানের কৌশলগত দূরদর্শিতা বাংলাদেশকে দ্বিমুখী সংকটে ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করছে: একদিকে মানবিক দায়িত্ব, অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টিতে জাপানের নেতৃত্ব আরও প্রাসঙ্গিক।”_
— ড. ইয়ুকি তানাকা, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ।
উপসংহার
রোহিঙ্গা সংকট কেবল মানবিক ইস্যু নয়, এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। জাপান এই জটিল পরিস্থিতিতে তার ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশের পাশে থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দিচ্ছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী পুনর্গঠন থেকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলা পর্যন্ত জাপানের এই অংশীদারি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের পথকে প্রসারিত করেছে।
তথ্যসূত্র :
১. জাইকা: বাংলাদেশে জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতা (২০২৩)
২. ইউএনএইচসিআর: রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিস্থিতি (ডিসেম্বর ২০২২)
৩. জাপান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়: রোহিঙ্গা সংকটে নীতি কাঠামো (২০২৩)
৪. বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ: জাপানি সাহায্যের পরিসংখ্যান (২০২৩)