খুঁজেফেরা শওকত ওসমান ও ভুঁইয়া ইকবাল – জাঁ-নেসার ওসমান

খুঁজে ফেরা শওকত ওসমান ও ভুঁইয়া ইকবাল
– জাঁ-নেসার ওসমান

প্রথম পরিচয় আমার জন্মস্থান চট্টগ্রামের লালখানবাজার রোডের তাঁর নিজস্ব ফ্ল্যাটে।
হেতু, চট্টগ্রাম বাংলাদেশ টেলিভিশেনের জেনারেল ম্যানেজারি করার সময়, বিটিভি’র ডিজি, কবি জনাব আবদুল মান্নান স্যারের কিছু বই ভুঁইয়া ইকবাল স্যারের বাসায় পৌঁছে দিতে যাই।
আমি কথাশিল্পী শওকত ওসমানের কনিষ্ঠপূত্র শুনে আমাকে বললেন দাঁড়ান আপনাকে একটাজিনিস দেখায়, বলে ড্রইং রুম থেকে অন্দরে গেলেন ও প্রায় এক মিনিটের মাঝেই ফিরে এসে আমাকে একটা চিঠি দেখালেন, কথাশিল্পী শওকতওসমানের কবি আবুলফজলকে লেখা চিঠি। আব্বার হাতের লেখা দেখে আমার তো অন্য এক অনুভুতি। জনাব ভুঁইয়া ইকবাল দেখালেন যে, ১৯৬৯ সালের গণঅভ‚্যথানের সময় কবি আবুল ফজলকে লেখাচিঠি যেখানে কথাশিল্পী শওকত ওসমান জনাব আবুল ফজলকে লিখেছেন যে, পূর্ব-পাকিস্তানের নাম বঙ্গদেশ হতে পারে।

জাঁ-নেসার ওসমান

কথাশিল্পী শওকত ওসমান জনাব আবুল ফজলকে লেখা উনসত্তরের সেই চিঠি থেকে কটা পংতি তুলে ধরছি,

 

 

 

তারিখটা, ঢাকা,৩.১২. ’৬৯ “

শ্রদ্ধেয় ভাইসাহেব, আপনার নির্দেশ-অনুযায়ী প্রকাশক-কর্তৃক প্রেরিত সওগাত
“লেখকের রোজনামচা” আমার সামনে রয়েছে। আপনাকে ধন্যবাদ দেব না।
সম্প্রতি দেখে থাকবেন, চৌধুরী খালেকুজ্জামান একদা মুসলিমলীগের রথী ‘মোহাজ্বের এলাকা’ গঠনের ওকালতি করেছে। কালের কী করুণ ব্যাংগ! পঁচিশ বছর গেলনা, সব বমি মারফৎ বের করে. দিতেহয়েছে । পূর্বপাকিস্তান আর থাকবেনা। হবে বাংলা। ( আপনাকে অনুরোধ, আমরা ত চুপআছি, আপনি আমাদের মুখপাত্ররূপে বলবেন: ধ্বনি মাধুর্য্যের জন্য, ‘বঙ্গ দেশ’ হোক। ইংরেজীতে বেঙ্গল থাকবে।)
‘সমাগম’ উপন্যাসটা এত দিনে পড়ে শেষ করতে পেরেছেন কী? আপনার মতামত জানার খুব লোভ আছে।
আন্তরিক সালাম-অন্তে,

ইতি আপনার সুদীর্ঘ জীবনকামী

– স্নেহাবনত শওকত ওসমান”।

মহান কথাশিল্পী শওকত ওসমান

আমিতো চিঠি দেখে অবাক । প্রথম দেখাতেই লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে চিঠিটা চেয়ে বসলাম। উনি স্বভাবজাত স্মিত হাসি হেঁসে বললেন, এটা আপনাকে দেবার জন্যই বের করেছি। অনেক বছরধরে. এটাকে স্বযত্নে রেখেছি। খুব চিন্তা হতো এই ঐতিহাসিক চিঠিটার কি হবে। আপনার সাথে যে কোনোদিন দেখা হবে তা কখনো ভাবতেও পারিনি। আজ অনেকটা ভার মুক্ত হলাম। শওকত স্যারের প্রতি আমার ভালবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি আপনাকে কোনদিনও বোঝাতে পারবোনা। তাছাড়াও রিজিনাল চিঠিটার একটা ফটোকপি আমার কাছে আছে।
সেইদিন থেকে আপন ভায়ের চেয়েও বড় বন্ধু হয়ে উঠলেন জনাব ভুঁইয়া ইকবাল।
এখন থেকে তাঁর প্রকাশিত যে কোন লেখা পেলেই পড়ি ও কমেন্টস জানাই।
ক্রমে ক্রমে আমার চট্টগ্রাম টিভি ষ্টেশনের পালা শেষে ঢাকায় ফিরে আসি।
জনাব ভুঁইয়া ইকবালের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।
হঠাৎ একদিন ফোন পেলাম:
“জাঁ-নেসার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসান, আপনার আব্বার কটা বইয়ের প্র”ছদ এঁকেছেন? কিছুকি মনে আছে?”
“হপ্তম-পঞ্চম” কামরুল চাচার আঁকা। এটা নিশ্চিতে বলতে পারি। অন্য গুলোএকটু খোঁজ নিয়ে বলতে হবে,
সব মুখস্ত নেই।”
“একটু খোঁজ নিয়ে তাড়াতাড়ি জানাবেন। আমি সংবাদপত্রের জন্য একটা আলোচনা লিখছি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসানে রবুক-কাভারের উপরে।”
“আব্বার মানে, কথাশিল্পী শওকত ওসমানের কতগুলো বইয়ের প্র”ছদ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসান এঁকেছেন তা খুঁজতে যেয়ে পেলাম এক অজানা প্র”ছদপট জগৎ।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথমদিকে প্র”ছদপট শিল্পীর কোনোনাম থাকতোনা!!
ফলে বহু প্র”ছদপট শিল্পীর নাম আমাদের অজানাই রয়ে গেলো।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসান চাচার প্র”ছদপট খুঁজতে যেয়ে দেখি,শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসান ছাড়াও সদম্ভে বিরাজ করছেন, আবুল কাশেম, পুর্নেন্দু পত্রী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, রশীদ চৌধূরী, দেবদাস চক্রবর্তী, প্রনেশ মন্ডল, খালেদ চৌধূরী, কালাম মাহমুদ, জিলানী ওসমান, কাইয়ুম চোধুরী, তিলক বন্দোপাধ্যায়, রফিকুন নবী, হাসেম খান, রনেন কুশারি,অলোক ধর, এ, সাত্তার, আলী হুমায়ুন, আবুল বারক্ আলভী, রাগীব আহ্সান, সমর মজুমদার, মতলুব আলী, মর্তুজা বশীর কত নাম লিখব… এঁরা সবাই প্র”ছদপট এঁকেছেন।
আর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসান চাচার আঁকা প্র”ছদ খুঁজে পেয়েছি প্রায় এক’শরও বেশি।
জনাব ভুঁইয়া ইকবালতো প্র”ছদ শিল্পের এই অজানা জগৎের কথাশুনে আহাল্লাদে আটখানা\
যলদি আমাকে সব বইয়ের প্র”ছদ ও কবে প্রকাশিত তার তারিখ বা সালটা জানান। ব্যাপারটা খুবই সহজ, ক্যামেরাম্যান প্রান্তকে নিয়ে বাংলাএকাডেমি ও পাবলিকলাইব্রেরীতে দিপু সিদ্দিকী ও ডা মনোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসান চাচার যতপ্র”ছদ পেলাম তার, আর কবে প্রকাশিত কার লেখা সব ছবি তুলে উনার পুত্র অনিন্দ্য ইকবালের মেইলে পাঠিয়ে দিলাম।
উনার খুশীতে আমার ভীষণ ভালো লেগেছিলো। আরও ভালো লাগলো যে, উনি যদি এই সাহায্য টুকু না চাইতেন তাহলে আমি এসব কিছুই জানতাম না। পরে প্রথম আলোতে ভুঁইয়া ইকবালের প্র”ছদের, উপর লেখাটা ছাপার পর উনি আমাকে ফোন করলেন। লেখাটাপড়ে দেখলাম শেষ প্যারাতে আমার নাম ছেপেছেন।
আনন্দর আর সীমা নাই।
আবার একদিন, অবাক করা ফোন, “জাঁ-নেসার, আপনার আব্বার লেখা“শেখ্জী” ছোটগল্পটাকি,গল্পসমগ্রে আছে?”“জ্বী, না নেই্।” “ আপনি কি, নিশ্চিত?” “ জ্বী, ছোটগল্পের সমগ্রটা আমার হাতে রয়েছে।”
“তাহলে শুনুন, মিল্লাতপত্রিকার ঈদ সংখ্যায় আপনার আব্বার লেখা “শেখ্জী” নামে একটা ছোটগল্প পেলাম।”
“কোনসালে লেখা?” “ ১৩৫২, আর এখন চলছে বাংলা সন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, তারমানে প্রায় ৭৫বছর আগের ছাপা।” “স্যার যলদি একটা ফটোকপি পাঠান।” “জ্বী, পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
এমনিভাবে জনাব ভুঁইয়া ইকবাল কথাশিল্পী শওকত ওসমানের কবিতাসহ প্রায় সাতআটটি অগ্রন্থিত লেখা খুঁজে পাঠালেন। যেটা খুব যলদি বই আকারে বের হবে। দুঃখ স্যার দেখে যেতে পারলেন না।
একদিন উনার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়, কথায় কথায় বললেন “জানেন আমি যখনই কোনো পুরোনো ম্যাগাজিনে বা পত্রিকায় আপনার বাবার লেখা পাই তখন অপার এক আনন্দ ধারা আমার মাঝে কাজ করে।
তখন খোঁজার আগ্রহ আরোও বেড়ে যায়। শওকত স্যারকে সত্যিইপ্রাণ থেকে শ্রদ্ধাকরি।”
সেই সর্বজনশ্রদ্ধেয়, বাংলাএকাডেমিপুরষ্কার প্রাপ্ত জনাব ভুঁইয়া ইকবাল করোনা পরবর্তী জটিলতায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
কেউ বলুক আর নাই বলুক, সবার অজান্তেই কিন্তু  বাংলাসাহিত্যের বেশবড় একটা ক্ষতি হয়ে গেলো।
জানিনা আবার কবে জনাব ভুঁইয়া ইকবালের মতো বাংলাসাহিত্যের কোনোসেবক জন্মাবে??

– জাঁ-নেসার ওসমান একজন নিবেদিতপ্রাণ চলচ্চিত্র পরিচালক ও সমাজ চিন্তাবিদ কলামিস্ট ।

Share: