দেশে করোনাতে মৃত্যু আবার বেড়েছে। করোনা শনাক্ত হবার ১৫০তম দিনে (গত ৪ আগস্ট) এসে স্বাস্থ্য অধিদফতর তার আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনাতে আক্রান্ত হয়ে ৫০ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরেররের তথ্য অনুসারে, ৪ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৪৪ ২০ জন। এদের সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৮৬০ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ২৩৪ জনের। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১ দশমিক তিন শতাংশ আর গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হিসেবে মৃত্যুর হারেএক দশমিক ৩৩ শতাংশ। প্রতি দশ লাখ জনসংখ্যায় মৃতের সংখ্যা ২০ জন।
দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষা শুরু হয় ২১ জানুয়ারি। আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত আট মার্চ, তার ঠিক ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর কথা জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( আইইডিসিআর)। এরপর থেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা দৈনিক ছিল না এবং পাঁচ এপ্রিল পর্যন্ত মোট মৃত্যুবরণ করেন আট জন। পুরো মার্চ মাসে করোনায় মৃত্যুবরণ করেন পাঁচ জন, এপ্রিলে ১৬৩ জন, মে মাসে ৪৮২ জন, জুন মাসে এক হাজার ১৯৭ জন, জুলাই মাসে এক হাজার ২৬৪ জন মারা গেছেন।
গত ৬ এপ্রিল থেকে নিয়মিত মৃত্যুর সংবাদ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর, ছয় এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০ জনের মধ্যে, ১০ থেকে ১৭ মে পর্যন্ত মৃত্যু হয় ১১ থেকে ১৯ জনের মধ্যে। দুই দিন পর ১৮ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত মৃত্যু হয় ২০ থেকে ২৮ জনের। আর গত ৩১ মে থেকে মৃত্যু সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ৩০-এর ওপরে চলে যায়। গত ৩০ জুনে করোনাতে একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যুর সংখ্যা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এদিকে, গত ২৮ জুন করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) টেস্ট বিনামূল্যে হওয়ার ফলে অধিকাংশ মানুষ উপসর্গ ছাড়াই পরীক্ষা করার সুযোগ গ্রহণ করছে। এ পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য অপ্রয়োজনীয় টেস্ট পরিহার করার লক্ষ্যে ফি নির্ধারণ করার কথা জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এখন থেকে বুথে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষায় ২০০ টাকা, বাসা থেকে সংগৃহীত নমুনায় ৫০০ টাকা ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীর নমুনা পরীক্ষায় ২০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
আর এ ফি নির্ধারণ, পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা, টেস্ট করাতে ভোগান্তি, টেস্টের রিপোর্ট পেতে দিনের পর দিন অপেক্ষাসহ নানা কারনে করোনার নমুনা পরীক্ষার হার কমতে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদফতর কোভিড-১৯ বিষয়ক প্রতিদিনের বুলেটিনে যে কোনও লক্ষণ-উপসর্গ থাকলেই মানুষকে করেনার পরীক্ষা করার জন্য অনুরোধ করছে। নমুনা পরীক্ষার হার কমার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে নতুন রোগীর সংখ্যা। বরং, খুব ধীর গতিতে হলেও নমুনা পরীক্ষা কমার ভেতরেই মৃত্যুহার বাড়ছে।
মূলত দেশে মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে করোনা অবস্থার অবনতি হতে থাকে, জুন মাসের শুরু থেকেই সেটা তীব্র আকার ধারন করে। জুলাইয়ের শুরুতে নমুনা পরীক্ষার হার কমার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে নতুন রোগীর সংখ্যা। বরং, খুব ধীর গতিতে হলেও নমুনা পরীক্ষা কমার ভেতরেই মৃত্যুহার বাড়ছে।
এদিকে, গত রোজার ঈদের মতো কুরবানীর ঈদের সময়ে ঢাকা থেকে মানুষের গ্রামে যাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পশুর হাট যাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কোরবানিও দিয়েছে মানুষ। যার কারণে মধ্য আগস্টে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সেই সঙ্গে বাড়বে মৃত্যুও।
দেশে প্রথম মৃত্যুর পর ১০০ মৃত্যু ছাড়ায় ২০ এপ্রিল, ২০০ মৃত্যু ছাড়ায় ৯মে, ৫০০ মৃত্যু ছাড়ায় ২৫ মে, এক হাজার মৃত্যু ছাড়ায় ১০ জুন, দেড় হাজার মৃত্যু ছাড়ায় ২১ জুন, দুই হাজার মৃত্যু ছাড়ায় তিন জুলাই, এর ১৪ দিনের মাথায় দুই হাজার ৫০০ মৃত্যু ছাড়ায় ১৭ জুলাই এবং মাত্র ১০ দিনের মাথায় গত ২৮ জুলাই সংক্রমণের ১৪৩ তম দিনে মৃত্যু তিন হাজার ছাড়ায়।
যদিও করোনা ট্র্যাকার ডট কম ওয়েবসাইটের বিশ্লেষণ অনুসারে, সর্বাধিক আক্রান্তের হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬তম স্থানে। তবে করোনায় সর্বাধিক মৃতের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২৮ তম স্থানে। এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে ভারত, ইরান, সৌদি আরব ও পাকিস্তানে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের মতে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হলে মৃত্যু হার কমে আসবে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অন্যদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মৃত্যু পরিস্থিতি তুলনা করা বেশ কঠিন। কারণ একেক দেশের পরিস্থিতি একেক রকম। আমাদের মৃত্যুহার আরও কমানো যেতো, যদি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতো। ব্যবস্থাপনার ঘাটতির জন্য এই মৃত্যুহার।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোরবানি ঈদের পর রোগী সংখ্যা না ছড়ানোটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, সেই সংখ্যা মৃত্যু হারও বাড়ছে, এটা উদ্বেগের কারণ।
তিনি আরও বলেন, উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া, মারা যাওয়া মৃত্যুহার মোট ল্যাবরেটরিতে কনফার্ম হওয়ার অর্ধেক হতে পারে, এর বেশি না। মৃত্যু জুলাইতে ৩০ থেকে ৪০ জনের গড় ছিল। মৃত্যু সংখ্যা ধীরে ধীরে হলেও বাড়ছে। আর চেষ্টা না করলে করোনাতে শনাক্ত এবং মৃত্যু আপনাআপনি ঠিক হবে, বরং বাড়তে থাকবে।
তবে সারা পৃথিবীতেই এখন মৃত্যু সংখ্যা কমে এসেছে জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ৩ আগস্ট বলেছে যত সংক্রমিত হয়েছে তার মধ্যে মৃত্যু সংখ্যা শতকরা এক ভাগের কম, দশমিক ছয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা এক দশমিকের ওপরে-বাংলাদেশে বেশি।