“প্রতিবাদী কামাল লোহানী” —–জাঁ-নেসার ওসমান

জাঁ-নেসার ওসমান

“প্রতিবাদী কামাল লোহানী”

“ তোমার বাবাও একদিন লুঙ্গী, পরতো!!”
রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে থর থর করে, টেলিফোন রেখে, কাঁপছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী।
যে দেশের জন্য পাকিস্তানি শাসকের রোষানলে পড়ে জেল খেটেছেন, মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছেন, সেই দেশের সরকারি কর্মকর্তা তাঁর সাথে ঔধত্য দেখানোর র্স্পধা দেখায় কি ভাবে!!
এই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন বুঝি!!
রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশ যেতে হবে বৃটিশ পোষাক স্যুট-টাই পরে।
না, ভাষা সংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাম রাজনীতির ধারক শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী, দুশ বছরের বৃটিশ গোলামীর
আভরনে নিজেরে মোড়াবেন না, উনি তাঁর চিরাচরিত নিরাভরন বাংলার সাধরনের পায়জামা পাঞ্জাবী পরবেন।
গোল বাধলে এখানেই, জাতীয়তা বোধ ও বুর্জুয়া মানসিকতার দ্বন্ধ।
রাষ্ট্রীয় সফরে যাবেন স্যুট-টাই পরে, বিদেশিরা খুশী হবে, তা না ল্যাভেন্ডিস বাংলার বাঙালীর মতো,
পায়জামা পাঞ্জাবী পরে, যাবেন রাষ্ট্রীয় সফরে এ কি মানায়! আপনারাই বলেন?
চার্টাড প্লেন থেকে নামছেন প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা এক পায়জামা পাঞ্জাবী! এ কি মানায়!
শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানীর পূর্বপুরুষরা এসেছেন, আফগান-ইরান সীমান্ত এলাকার লোহান নামক জায়গা থেকে। যার জন্য এই এলাকার বাসিন্দাদের লোহানী বলা হয়।
যেমন ইস্পাহানের অধিবাসী, ইস্পাহানী, লেসবস দ্বীপের অধিবাসী, লেসবিয়ান, পাকিস্তানের অধিবাসী, পাকিস্তানি তেমনি।
অতএব বুঝতেই পারছেন নীতির প্রশ্নে শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী ভাংবেন তবু মচকাবেন না।
তা না হলে তো পাকিস্তানি আমলেই কালো কোট, জিন্নাহ টুপি, সাফারী মাফারী পরে, বনানীতে আইয়ুব খানের দেওয়া জমিতে বাড়ী বানিয়ে মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানিকে লাখ টাকায় ভাড়া দিতেন।
কষ্ট লাগে যখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনের সময় কোন এক পাতি মন্ত্রীর উপরোধ রাখেননি বলে তাঁকে বদলি করা হয়। কারণ প্রকৃত শিক্ষিত জন ছাড়া শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানীর মতো ব্যক্তিত্যদের র্মযাদা উপলব্ধি করবে কি রুপে।
“স্যার, একবার যদি কন্সিডার করেন, স্যার, রাষ্ট্রীয় ব্যাপার স্যার, প্রোটকল আছেনা স্যার।” বেশ বিনয়ের সাথে উপোরধ করলেন, ভ্রমণের মেহমান তালিকা তৈরীর কর্মকর্তা।
“আমার মনে হয় এ-যাত্রা আমায় বাদ দাও পরে কখনো সময় সুযোগ হলে না হয় আমি যাব।”
শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী স্যারের সোজা সাপটা জবাব।
“স্যার, জীবনে একবার স্যুট-টাই পরলে, কি এমন, মহাভারত অশুদ্ধ হবে, স্যার।”
“ দেখ, বাবা এ নিয়ে আমায় কোনো অনুরোধ করোনা, আমি জীবনে কখনো নিজের নীতির বাইরে যাইনি,
আশাকরি যাবও না, যে কটাদিন বেঁচে আছি, নিজের নীতিতে যাতে অটুট থাকতে পারি, এ-ছাড়া জীবনের কাছে আমাদের খুব কিছু চাওয়া পাওয়া নেই।”
বিষয়টা আর ভালো লাগছেনা শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী স্যারের।
“স্যার আর্ন্তজাতিক সফর, একটু র্স্মাট না হলে চলে স্যার?”
“র্স্মাটনেস কি তোমার জামা কাপড়েই! শেখ সাদীর গল্প শোনোনি! জামা কাপড়ে র্স্মাট হয় না, একটা জাতি র্স্মাট
হয় তার শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞাণ গরিমায়, স্যুট-বুটে নয়।”
“ স্যার, স্যুট তো স্যার আমরা সরকারি খরচেই বানাবো স্যার… ”
কথা শেষ হয়না কর্মকর্তার, শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী, উল্টো প্রশ্ন রাখলেন,“ বাংলাদেশের ক’জন, স্যুট পরে, আপনি কত জন কে সরকারি খরচে স্যুট বানিয়ে দিবেন, পারবেন সব বাঙালীকে স্যুটের আভরনে মুড়ে দিতে?”
“ তাহলে কি স্যার আপনি লুঙ্গি পরে রাষ্ট্রীয় ভ্রমণে যাবেন?”
“ ভুলে যেও না, তোমার বাবাও তোমাকে লুঙ্গি পরেই বড় করেছেন…” বলে ঠাস করে ল্যান্ড ফোনটা রেখে দিলেন শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী স্যার।
তখনো সেলুলার ফোন বাজারে আসেনি। শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী স্যারের এক সুহৃদের পরামর্শে ল্যান্ড ফোনের রিসিভারটা তুলে রাখলেন যাতে কেউ আবার ফোন করে জ্বালাতন করতে না পারে।
শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী স্যার আপনার এই নীতির প্রশ্নে অটুট থাকার যে সাহস আপনি আমাদের উপহার দিয়েছেন, তা আমরা আজীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবো।
আজ আপনার মত লড়াকু সংগ্রামী সুর্যসন্তানের বড় অভাব।
ভাগ্য ভালো যে তখনো বাংলাদেশে বিচারহীন মৃত্যুর মিছিল “অপারেশন ক্লীন র্হাট” শুরু হয়নি।
না হলে হয়তো শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানীর অকাল মৃত্যুতে,
“শ্যামা নৃত্য নাট্যের” বজ্রসেনের মতো আমরাও বলতাম,
“ক্ষমিতে পারিলাম না যে, ক্ষম হে মম দীনতা…

Share: